অণুগল্প
রেণুকা পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসে কী যে ভাবছিল এতক্ষণ! এই ঘাটটা তার খুবই ভালো লাগার জায়গা। এখানে বসলে তার মনের সব ঘা-গুলো শুকিয়ে যায়। আজ তাই দুপুরের সব কাজ সেরে এখানে এসে বসে বসে কত কথা ভাবতে ভাবতে সে আনমনা হয়ে গিয়েছিল। সে ভাবছিল কেন সে বুকজোড়া হাহাকার নিয়ে আজও নিত্যানন্দের ঘর করছে। প্রথম প্রথম বিয়ের পর খটকা লাগলেও স্পষ্ট করে বোঝেনি বলে সে থেকে গেছে স্বামী ব্যক্তিটির ঘরে। কিন্তু তারপর যখন বুঝে গেল তখনও থেকে গেল কেন তার সঙ্গে! আসলে সে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি। কোথায় যাবে? কোথায় হবে তার শান্তির আশ্রয়? সে ভেবে ভেবে দিশা পায় নি। আজও পায় না। ধনী বাপের সন্তান সে। পঞ্চম সন্তান। তার আরও চার বোন আছে। একজন বিধবা। মা-বাবার কাছে থাকে। বাকি তিনজন স্বামীর ঘর করছে। সে কোথায় গিয়ে উঠবে? মা-বাবার কাছে? আরেকজন বাড়তি বোঝা হয়ে? কী বলবে তাদেরকে? আত্মীয়-স্বজনরাই বা কী ভাববে? পড়শি-রা? অমন নিরীহ, শান্ত দেবতার মতো স্বামীকে ছেড়ে কেউ বাপ-মার ঘাড়ে চাপে? সে তো প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে জেরবার হয়ে যাবে! কী বলবে সে? বলবে—‘আমার স্বামী পাগল’? কেউ বিশ্বাস করবে না। সে-ও বোঝাতে পারবে না! তাহলে? মাধ্যমিক পাশ বিদ্যে নিয়ে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। ধনী ঘরের সন্তান হিসেবে বড় হয়ে পরের ঘরে ঝি-গিরিও করতে পারবে না। তাহলে? ভেবে কূল-কিনারা পায় না সে। আজও সেসব কথাই ভাবছিল ঘাটে বসে। কয়েকটা শালিক জলে মুখ ডুবিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে কোথায় যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল। ওরাও যেন তাকে হারিয়ে দিয়েছে। ওরাও বেঁচে আছে। সে কেন পারছে না অমন করে বাঁচতে মানুষ নামক প্রানী হয়েও! হুঁশ ফিরল ঘাড়ের ব্যথায় হাত পড়তে। নিত্যানন্দের ভিতরের দৈত্য বেরিয়ে পড়ে মাঝে মাঝে তার উপর দৌরাত্ম্য করে! আঘাত হানে। বিনা দোষেই। বাইরের দেবতা তখন কোথাও নিরুদ্দেশে যায়। কালও ঘটেছিল তেমন কাণ্ড! বেশ কিছুদিন কাটার পর এরকম ব্যাপার ঘটে অকস্মাৎ কোনো হেতু ছাড়াই। যেমন গতকাল ঘটল।
কোথাও কিছু না। নিত্যানন্দ হঠাৎ তার চুলের মুঠি ধরে শোওয়া অবস্থা থেকে টেনে তুলে এই-মারি কি সেই-মারি ভাব করে বলতে থাকল—‘সেদিন কী বলেছিলি মাগী, মনে আছে? না? এখন ন্যাকা সাজা হচ্ছে? দেব এক লাথি পেটে? আমি পাগলা? হ্যাঁ? বল এখন আরেকবার!’ রেণুকা নিশ্চুপে মার খায়। গালি শোনে। নিত্যানন্দের দৈত্য তারপর তাকে ছেড়ে যায়। সে তার বউকে তখন রেহাই দেয়। রেণুকা দশ বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে এই জীবন। দেবতা নিত্যানন্দ সকলের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে যে রেণুকা এই সব ঘটনার কথা বললে তারা কেউ-ই বিশ্বাস করবে না। নিত্যানন্দ একটি স্কুলে কেরানীর কাজ করে। তার কাজে কোন ভুল হয় না। সকলে তার মিষ্টি স্বভাবের প্রশংসা করে। তবে সংসারের কোন কাজ-ই সে করে না। করলেও সব এলোমেলো ভাবে করে। রেণুকাই সব সামলে নেয়।
ঘাটের সিঁড়ি ছেড়ে ধীরে ধীরে সে পায়ে পায়ে ঘরে এসে পৌঁছোয়। আচমকা ঘাড়ে পড়ল জোরালো শক্ত হাতের আঘাত। সে চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল।
‘—এতক্ষণ কী করছিলি? নাকী কান্না চলছিল বুঝি? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা!’ ঠিক সেই সময় দরজায় টোকা পড়ল—
‘নিত্যানন্দ! নিতাই! ঘরে আছো না কি?’ তখন দৈত্য মুহূর্তে দেবতার খোলসে ঢুকে পড়ল।
‘কে? সুমন্তদা? এস। ঘরের ভিতরে এস।‘ সুমিষ্ট স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠল নিত্যানন্দ ঘরের দরজা খুলে দিয়ে। রেণুকা সরে গেল সেখান থেকে। ফাঁড়া কাটল সেদিনের মতো তার।
নিত্যানন্দ ও সুমন্ত মণ্ডল ধীর স্বরে আলাপে মগ্ন হয়ে গেল। রেণুকা চা বানাতে বসল। তার চোখের জল মিশতে থাকল গরম চায়ের সঙ্গে একাকার হয়ে।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫