Jibansmriti Archive

শিল্পী : হিরণ মিত্র

পিকাসো কী করে পিকাসো হলো। শুধু স্পেনিয় বলে নয়, পারি শহরে ১৯০০ এ দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা নয়,বাড়ির নিশ্চয়তা ছেড়ে, পাশাপাশি স্টেইন সমর্থন পাওয়া, আশ্চর্য বিষয়। আফ্রিকা একটা বিশাল ভুমিকা নেয় একই সাথে, সাহস। ওই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে কিউবিজম,আফ্রিকাকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করা প্রায় চৌর্যবৃত্তির মতো,তার সাহস লাগে। শিল্প অভ্যাসের চূড়ান্ত দক্ষতা ওনার এই সাহস জুগিয়েছে। এ সাহস আমার থাকার কথা নয়। যাকে আজও সামান্য প্রচ্ছদ আঁকার উপর আর্থিকভাবে নির্ভর করতে হয়, ভবিষ্যতে খুবই হাস্যকর ভাবে এসব আলোচনা হবে, বিশ্লেষণ হবে, দূঃখ প্রকাশ করা হবে,বলা হবে প্রতিভার অপচয়, কিন্তু তাতে আজ আমার ভাত জুটবে না। আজকের সমস্যা আজকেরই সমস্যা। এখন ভাবার বিষয় এই দৈন্যতা নিয়েও কী করে শৈল্পিক টিকে থাকা যায় শুধু নয় আমার অস্তিত্ব কে গুরুত্বপূর্ণ করা যায়, ভিন্ন দিশা দেখানো যায়। আমি আমার অভিব্যক্তি নিয়েই বেশি চিন্তিত। তাকে কী করে বিশিষ্ট করে তোলা যায়, অগ্রজ শিল্পীদের থেকে প্রভাব মুক্ত করা যায়, হাতে বেশি সময় নেই।

শিল্পী : হিরণ মিত্র

আমি গত কয়েকদিন, পিকাসো কে নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রতিবেদন দেখছিলাম পর্দায়। মুল সমস্যা ডিসকোর্স। কার সাথে হবে? কে আমার প্রতি সৎ ভাবে আগ্রহী? আমার আজকের শৈল্পিক সমস্যাকে লোকেট করা, তার সমস্যার গভীরে যাওয়া। যাদের শিল্প নিয়ে পঠন পাঠন আছে তারা বেশির ভাগই অন্ধ বা একপেশে। তাদের পক্ষে এই আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে বোঝা সম্ভব নয়। যার জন্য আলোচনা জটিল হয়ে গেছে। যেহেতু আমার কাজের তথাকথিত সামাজিক আর্থিক বা গ্রহণযোগ্য সফলতা নেই, তাই তারা এই আলোচনায় অংশ নিতেই চায়না।কিন্তু হয়ত তাদের প্রভুত পড়াশোনা আছে। কিন্তু কোনো ফল নেই।

হঠাৎ করে একজন পিকাসো হওয়া সহজ কথা নয়। এমনকি তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া,বা তাকে অনুসরণ করাও বাতুলতা। তার থেকে একজন হিরণ মিত্র হওয়া তুলনামূলক ভাবে কিছুটা সহজ, সম্ভব, কিছুটা বাস্তবও বটে। কেউ কিছু মনে রাখবে না। এক জীবনে এর থেকে বেশি পাওয়া আশা করা বাতুলতা ছেলেমানুষি।

একজীবনে এত গুলো কাজের সুযোগ জোটানো, এত খাতা কলম ভরানো,সামান্য ক্যানভাসে আঁচড় কাটা খুব একটা সহজ কাজ আমার জন্য ছিলো না, কারণ আমার কৈশোর থেকে একার লড়াই, সামাজিক সমর্থন ছাড়াই এত পথ হেঁটে আশা ৮০ পার হওয়া কখনো মসৃণ ছিলো না। নিজের সাথে কিছু বোকা বোকা কথা। তবুও মনে হলো একটা বোঝাপড়া দরকার।

শিল্পী : হিরণ মিত্র

পিকাসোর, ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিজিম আর আমাদের মোদী মমতার ফ্যাসিজিম এক নয়। এটা আমাদেরও বুঝতে হবে। তার পাশে দক্ষিণ পন্থা কী, মেকি বামপন্থা কী, আমাদের অবস্থান কী তাও বুঝতে হবে। তৃণমূলের লোকের চোখে ধুলো দেওয়া বিজেপি বিরোধিতা ও  আর এস এস পন্থী হওয়া গোপনে তাও বুঝতে হবে। সজাগ থাকতে হবে। পিকাসোর কোনো রাজনৈতিক ভাবনা স্বচ্ছ ছিলো না। গেরনিকার ভাবনায় তোরা মারের ভুমিকা খুবই প্রধান ছিলো। ওর অবদান বিশাল। ডোরা ছাড়া এ কাজ করা অসম্ভব ছিলো। পিকাসোর আবেগ ও দক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কারণ এর প্রমাণ আমরা পাই পিকাসোর কান্নারতা রমনী দেখে। দীর্ঘকাল এই ইমেজ থেকে উনি বেরুতে পারেননি। গেরনিকা শেষ করার পর। এই রমনী ছিলেন আদতে ডোরা।

আগের ফ্যাসিস্তরা অনেক মোটা দাগের ছিলো, তাদের চেনা যেতো, এখনকার এরা খুবই সুক্ষ ও চতুর। চেনা সহজ নয়।

শিল্পী : হিরণ মিত্র

পিকাসো না হতে পারার অনেক অজুহাত দেওয়া যায়। ওইসব ভয়ংকর রমনী না পাওয়ার, চুরি বিদ্যা না জানার, ওই সময়ে না জন্মানোর, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ না দেখার, সর্বোপরি স্পেনিয় না হবার,কিন্তু কিছু তেই কোনো উত্তর নেই। তোমার সময়কে তুমি কী চোখে দেখো, সেটাই শেষ কথা। আমাদের মূল ইউরোপীয় শিক্ষায় কিছু মডেল বা আদর্শ কে পরিচয় করানো হয় এবং তার মতো হবার নির্দেশ থাকে। সমস্যা ঠিক এখানেই। ভিন্ন ভিন্ন শিল্প চর্চাকে পরিচয় করানো যথেষ্ট প্রয়োজন, কিন্তু তাকেই বা কিছু বিশেষ কে আদর্শ বানানো তে আমার আপত্তি। আজও আমাদের শিল্প শিক্ষায় এই রীতি বজায় আছে। আমার সমাজ আলাদা, আমার রাজনীতি আলাদা, আমার অর্থনীতি আলাদা, পরিবেশ, তাপমাত্রা সবই আলাদা, তাহলে কী শিক্ষা নেবো? প্রক্রিয়া কে নিতে পারি,তার দৃশ্য কথোপকথন এর ধারা কে নিতে পারি, প্রভাব কে এড়িয়ে। তাও প্রভাব পড়তে পারে, কাটানোও যায়। নিজের দর্শনকে পাকা করতে হবে, আগে।

শিল্পী : হিরণ মিত্র

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *