
বিবাহ একটি সংস্কার হলেও তা দেশ-কাল-ভেদে একেকরকম হয়ে থাকে। বাঙালির বিবাহে আঞ্চলিকতা বজায় রেখেই তার রূপ হয় একেক রকম। তবে শুধু ভৌগোলিক অবস্থান বা স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব-ই নয়; পরিবারের নিজস্ব রীতিনীতি-ও তার আনুষ্ঠানিকতায় ছাপ রেখে যায়। তবে যে আচার-অনুষ্ঠানের বিশেষ বদল দেখা যায়না; তা হ’ল পাত্রপাত্রীর সাজসজ্জায়। এছাড়াও মাঙ্গলিক স্ত্রী-আচারের বিষয়টিও মোটামুটি একটি নির্দিষ্ট ধারাকেই মেনে চলে। বিবাহ একটি উপলক্ষ্যমাত্র; এটি আসলে গোষ্ঠীতান্ত্রিকতার একটি পর্বের উদযাপন। দুটি ভিন্ন বংশের নারী ও পুরুষ সম্মিলিতভাবে কোনও একটি গোত্রবংশের অংশীদারিত্বকেই স্বীকার করে নেয় বিবাহের মাধ্যমে। তবে একথাও সত্য যে পিতৃতান্ত্রিকতার যুগে নারীকে পরগোত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে সেই পুরুষেরই বংশবৃদ্ধিকে দেখা হ’ত। সময়ের পটভূমিকা পরিবর্তিত হওয়ায় এখন বিবাহের উত্তরকালে নারীরও নিজবংশের পরপ্রজন্মের সৃষ্টির দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। ফলে দুটি কুলেরই একসঙ্গে বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ মানবসমাজে এ এক নিয়মে পরিণত হয়েছে যে নতুন প্রাণসৃষ্টির জন্য একটি সংস্কারের প্রয়োজন। সুতরাং বিবাহের অনুষ্ঠান যাই থাকুক না কেন; তার উদ্দেশ্যের কোনও বৈচিত্র্য নেই।
বাঙালির ধারাবাহিক লোকাচার ও সংস্কৃতি যে পথ ধরে এগিয়ে চলেছে, তার প্রেক্ষাপটে যৌক্তিকতাকে অস্বীকার করা যায়না। নিছক আনন্দ, উৎসব বা শুধুমাত্র “অকরণে প্রত্যবায়”-এর ম’ত ব্যাপার এটি নয়। বরং এই ভাবনার কারণখানি বাঙালির বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রতিফলন। যে কোনও কৃষ্টি বা সংস্কৃতি যে একটি দিনের ফসল নয়; দীর্ঘদিনের পরম্পরা তাকে লালন করেছে। সামাজিক প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক একটি জিনিসের উদ্ভব হলে কালক্রমে তা প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রথার প্রতি বিশ্বাস তাকে করে তোলে পরম্পরা। সেই পরম্পরারই অভিজাত সংজ্ঞা ‘সংস্কৃতি’। ব্রত-পার্বণের আলপনায় দেখা যায় নারীমনস্ততত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। যা কামনা করা হয়, সেই জিনিসগুলিই ব্রতের আলপনায় আঁকা হয়ে এসেছে অবলীলাক্রমে। তাই বর্তমানে তা পারম্পরিক সংস্কৃতি।

যেহেতু বিবাহের ক্ষেত্রে সৃষ্টিতত্ত্বই ছিল সারকথা, তাই সৃষ্টিতত্ত্বের নানা প্রতীকী ব্যবহার বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ফুটে উঠেছে। প্রথমেই আসতে হয় টোপর ও মুকুটের প্রসঙ্গে। বিবাহ আসরে পাত্রের সাজপোশাকের সঙ্গে মাথায় শোলার টোপর পরানো হয়। অন্যদিকে পাত্রীর জন্য থাকে শোলার মুকুট। একুশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্তও বিবাহের দিনে পাত্রীর মাথায় কারুকার্য করা শোলার সাদা মুকুট থাকত। বউভাতের দিনে থাকত ফুলের সাজ। তাই সেদিকে মুকুট থাকলেও তা তৈরি হ’ত ফুল দিয়েই। এই টোপর বিভিন্ন ধরণের রয়েছে। শোলাশিল্পীরা তাদের যথাযথ দক্ষতায় সেটিকে সুন্দর ক’রে তুলতে চেষ্টা করেন। মুর্শিদাবাদে বিবাহে পাত্রের জন্যও ‘কুলো মুকুট’ থাকে। সেটিও শোলার তৈরি ও আকৃতিতে অনেকখানি শিলের ম’ত। বর্তমানে বিবাহের সময় শোলার মুকুট প্রচলিত থাকলেও বউভাতের দিনে আর মুকুট দেখা যায়না নববধূর সাজে। পাত্রের সাদা গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি, পাত্রীর রকমারি বেনারসি শাড়ি, অলংকারের সঙ্গে এই বিশেষ উপকরণের প্রয়োজন কি ছিল? যদি বলা হয় ‘হ্যাঁ’, তবে একথাও প্রমাণ করে দেওয়া যায় টোপর-মুকুটের আকারে সৃষ্টিতন্ত্রের প্রতীকী রূপ তথা নারী ও পুরুষের জননাঙ্গের ভাব ফুটে উঠেছে। একই কথা বলা যায় বধূবরণের আয়োজনেও। সাধারণতঃ পান, সুপুরি, কলা বরণের প্রধান উপকরণ। এই সুপুরি-কলার ছড়াকে একদিকে এবং পানকে অন্যদিকে রাখলে সেখানেও সেই একই রূপের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। পুজো-পার্বণের ক্ষেত্রে সৃষ্টিতত্ত্বের ভাবনা আসার পিছনে ছিল নদীমাতৃক দেশে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি। গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি। সূর্যের তেজোবীর্যের স্পর্শে উর্বর ভূমিতে ফসল ফলে। তাই সূর্য পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি ও ভূমি মাতৃশক্তির রূপান্তর। তাই বিবাহ এবং পুজোর বিধিতেও একই নিয়ম চলে এসেছে। বিবাহের পরে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করার সময়েই বধূকে দুধে-আলতায় পা দিতে হয়। এই দুধ এবং আলতার রং খেয়াল করলেই বোঝা যাবে তা বীর্য ও রজঃ ভাবের রূপক। বিবাহের সময় সেকাল থেকে পুরুষের পাটের জোড় পরিধানের প্রথা চলে আসছে। আবার নারীদের ক্ষেত্রে রাঙা চেলির ব্যবহার হ’ত একসময়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের শেষদিকে মিনির সাজসজ্জাতেও এমন উল্লেখ ছিল। এছাড়াও বিবাহের বেনারসির মধ্যে রক্তিম আভা নববধূকে অনুপমা ক’রে তোলে। বিগত শতকের শেষ তিন দশকে লাল বেনরাসির ব্যবহার একটু কম হতে থাকলেও বর্তমানে বাঙালি বিবাহের সাজসজ্জায় বেনরাসিতে সচরাচর রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে। এমনকি বিবাহিত নারীর শাঁখা-পলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। অর্থাৎ বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ‘সাদা-লাল’ রঙের মাধুরী। তা দুর্গাপুজোর দশমী হোক বা পয়লা বৈশাখ হোক বা কোনও উৎসব; সবেতেই এই দুটি রঙের প্রাধান্য থাকে। অথচ একথা হয়ত সহজে মাথায় আসেনা যে নিজ বংশ তথা জগতের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার একটি প্রবৃত্তি এর অন্তরালে রয়ে গেছে। তবে এই রীতি-রেওয়াজ সকলের জন্য বাধ্যতামূলক না হলেও লোকসংস্কৃতি যে নিতান্তই নন্দনতত্ত্ব বা গ্রামীণ কুসংস্কারে বোঝাই করা কোনও অর্থহীন অনুষ্ঠান নয়; বরং নৃতত্ত্বের আলোকে তার ব্যঞ্জনা অনেকখানিই আকর্ষক – একথা ভাববার সময় হয়েছে।

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫