বাংলা সংগীতের ইতিহাসে ১৯৩০-এর দশক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা আত্মপ্রকাশ করে—যাকে আমরা আজ ‘আধুনিক বাংলা গান’ নামে চিনি। এই অভিধাটি প্রথম দেখা যায় ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার ১৯৩০ সালের এপ্রিল সংখ্যায়, যেখানে বাংলা গানকে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত করা হয়। যদিও সেই সময়ে এই শ্রেণিবিন্যাসের কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি, তথাপি এই ‘আধুনিক’ শব্দটি একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সূচক হিসেবে উঠে আসে।
উনবিংশ শতকে বাংলা গান প্রধানত ছিল রাগাশ্রয়ী। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসাবে বৈঠকী গানকে উল্লেখ করা যেতে পারে, যা সাধারণত পরিবেশন করা হত নবাবি দরবার ও জমিদার বাড়ির গানের আসরগুলিতে। তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে এই ধারায় পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। গানের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে কাব্যিকতা, ব্যক্তিগত অনুভব ও আত্মপ্রকাশ। সংগীততত্ত্ববিদ রাজেশ্বর মিত্র তাঁর গ্রন্থ, ‘প্রসঙ্গ: বাংলা গান’-এ (১৯৮৯) লেখেন, এই নতুন ধারার গানকে বলা হয় ‘কাব্যসঙ্গীত’, যেখানে রচনার মূল ছিল গানের ভাব ও ভাষা—নয় স্রেফ রাগ-তাল।
এই সময়ে বাংলা গানে যে সাহিত্যিক পরিমিতি ও ভাবগত গভীরতা এসেছিল, তা নিয়ে তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় আলোচনা শুরু হয়। বিশেষভাবে ১৯৩৬ সালের ‘নাচঘর’ পত্রিকায় ‘আধুনিক বাংলা গান’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলা হয়, প্রাচীন বাংলা গানের কথার গুরুত্ব ছিল অপ্রধান। সেই গানগুলোর মূল আকর্ষণ ছিল সুরের জটিলতা ও তাল-মাত্রার অলংকরণে। অধিকাংশ নাট্য ও যাত্রার গান কাহিনীর সঙ্গে এতটাই যুক্ত ছিল যে তা নাটকের বাইরে আলাদা করে উপভোগযোগ্য ছিল না।
অপরদিকে, আধুনিক বাংলা গান সেই সীমাবদ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে। নাটকের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও, এই গানগুলো নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যিক ও সাঙ্গীতিক সত্তা অর্জন করে। গানের কথা এখন আর কেবল ছন্দের জন্য নয়, বরং অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে ব্যবহৃত হতে থাকে। নাচঘরের বক্তার মত অনুযায়ী, আধুনিক বাংলা গানের কথা কবিতার মতো পড়ে উপভোগ করা যায়, কারণ তারা নির্দিষ্ট রাগ-তালের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।
এই মতকে আরও দৃঢ়তা দেয় ১৯৪৭ সালের ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার একটি উদ্ধৃতি । সেখানে বলা হয়, আধুনিক গানের সুর ও ছন্দে এমন এক অভিনবত্ব রয়েছে যা আধুনিক মানুষের আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও আনন্দের প্রতিফলন। এই গানগুলোতে সুর তৈরি হয় কথার আবেগ ও তাৎপর্য বিবেচনা করে—ফলে গান হয়ে ওঠে একপ্রকার ব্যক্তিগত অনুভবের সংগীত; সেখানে ভাষা, সুর এবং কণ্ঠ একত্রে সৃষ্টি করে আবেগের সুরেলা অভিব্যক্তি।
আধুনিক বাংলা গান শুধু সুরের পরিবর্তন নয়—এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও মানসিক রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি। ১৯৩০-এর দশকে এই ধারার উত্থান বাংলা গানের ইতিহাসে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত।
সুচেতনা ভট্টাচার্য্য সঙ্গীত ইতিহাসের একজন পিএইচডি গবেষক। তার গবেষণার মূল বিষয় হল ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে বাংলার জনপ্রিয় গানের প্রেক্ষিতে কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেত্রী কানন দেবীকে কেন্দ্র করে একটি নারী কণ্ঠের নির্মাণ ও তার রূপায়ণ।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
Khb sundor lekha
পাশে থাকবেন। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।