Jibansmriti Archive

মন্দার মুখোপাধ্যায় । ছোটোবেলায় নাচের সময় কোমরে বাঁধা আমার অন্নপ্রাশনের শাড়ি

আমার প্রথম শাড়ি হল, বাবার করে দেওয়া ভাগলপুরি সিল্কের ওপর একটি লাল টুকটুকে বাটিক। এটা পরেই আমার অন্নপ্রাশন হয়েছিল, যা সাদাকালো ছবিতে দেখেছি। সুখস্মৃতি বলতে, পরে আমার ছোট্ট মেয়ের গায়ে জড়ানো, সেই শাড়ি পরেই একটি রঙীন ফটো।


আমার চিত্রী বাবার ফরমায়েসি ছবি আঁকা বা নির্দিষ্ট কোনও চাকরিতে মন না থাকলেও, তিনি কিন্তু একনিষ্ঠ ভাবে মায়ের জন্য বাটিক শাড়ি এবং চামড়ার ব্যাগ ও রাইটিং কেস বানিয়ে দিতেন। আমাদের ফ্রকেও এঁকে দিতেন সুন্দর সব নক্সা ও ছবি; তো সেবারও মায়ের ইস্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশানের আগেই শাড়ি তৈরী; সাদা বিষ্ণুপুরী থানটা রাতারাতি রঙীন হয়ে গেল। সারা গায়ে লাল হলুদ বাটিকের ক্র্যাকের সঙ্গে, গাঢ় লাল রঙের টেম্পল পাড়; বড় দিদিমণির বক্তৃতার সঙ্গে শাড়িরও প্রশংসা হল বিস্তর; সেসময় আমরা মায়ের সঙ্গে থাকি দমদম মতিঝিলের সরকারি বাসায়; বাবা থাকেন তাঁর খড়দার বাড়িতে, সেই মস্ত স্টুডিওঘরে, নিজস্ব মহিমায়; লম্বা ছুটিতে ইস্কুল বন্ধ; তখন আমার বয়স কত আর হবে, বড় জোর দশ! মতিঝিল-সরকারি কোয়ার্টারের মাঠে, নতুন বন্ধু জুটিয়ে চুটিয়ে খেলা চলছে। মায়ের আলমারিতে কখনই চাবি থাকত না। মা-ও বাড়ি ছিলেন না তখন; সেদিন কী মনে হল, মায়ের ওই নতুন বাটিক শাড়িটা দেখতে পেয়েই, ফ্রকের ওপর যেমন-তেমন করে জড়িয়ে খেলতে নেমে গেছি ; টিংটিঙে পায়ে লাফানো বা দৌড় দেবার সময় হাঁটু অবধি তুলে ছুটবার কথা নিশ্চয়ই মনে ছিল না; তবু যে ছেঁড়েনি, এই রক্ষে; হয়তো নতুন ছিল বলেই। বিকেল ফুরোবার আগেই মাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেই, ছুটে বলতে গেছি, ‘আর একটু খেলি… সন্ধে হলেই বাড়ি ঢুকে যাব’ ; তখন আর মাথাতেও নেই যে, আমার পরণে ফ্রকের ওপর মায়ের সেই নতুন সিল্কের শাড়ি; মা শুধু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আগে বাড়ি ঢোকো’; মা বিশেষ বকতেন না , কিন্তু গম্ভীর হয়ে গেলেই ভয় করতো; মায়ের পেছন-পেছন বাড়ি ঢুকতেই, চটাস করে গালে এক চড় এবং কান মোলা ; আমি তো অভিমানে ঘাড় গোঁজ; তখনও মাথায় ঢুকছেনা যে, অন্যায়টা কী! ঠাকুমার টুকটাক চাপড় বা বাবার রাম- ধমকে অভ্যস্থ থাকলেও মায়ের ওই গায়ে-হাত তোলায় , ভীষণ অপমান হয়েছে; তার ওপর খোলা দরজাটা বন্ধ না-করেই আমার গা থেকে শাড়িটা খুলে নিয়ে, আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে, শাড়ি হাতে মা ঘরে ঢুকে যাওয়ায়, দু’চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। হঠাৎ দেখি দরজার কাছে বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন, যা একেবারেই কাকতালীয়; তখন হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে আমি শুধু বলে চলেছি, ‘ওটা তো শাড়ি নয়, বাবার আঁকা; তাই পরেছি’। কোন কথা না-বলে, আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে এলেন বাবা; মায়ের কাছে সব শুনলেন; কাঁদতে-কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; আদর করে জাগিয়ে , মা যখন রাতের খাবার খেতে ডাকলেন, এক ঘুম দিয়ে উঠে দেখি বাবা কখন চলে গেছেন।

বাবার নিজের ধুতিতে রাতারাতি এঁকে দেওয়া শাড়ি


পরদিন সন্ধেবেলা বাবা যখন আবার এলেন, আমরা দু’বোন মায়ের কাছে পড়া শেষ করে, সবে তখন এঘর-ওঘরে ঘুরঘুর করা শুরু করেছি ; আমাকে কাছে ডেকে ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার নিজের শাড়ি; না জিজ্ঞেস করে এবং অনুমতি না নিয়ে কখনও কারও শাড়ি পরবে না’। সেসময় হাতের কাছে নতুন কোনও শাড়ি না-থাকায়, নিজেরই একটা ধোয়া ধুতির ওপর তুলি ধরে ফেব্রিক পেইন্ট করে দিয়েছেন। সে-বয়সে এর মর্ম বুঝিনি; বোঝবার কথাও তো নয়। কিন্তু বিশেষ কিছু একটা যে ঘটে গেল, তার একটা আন্দাজ হয়েছিল। কারণ ভয়ানক রেগে গিয়েছিলেন মা। এই বছরই আমি হস্টেলে ভর্তি হই, ফলে সে শাড়ির কথাও আর ওঠেনি। ক্লাস সিক্সে পড়বার সময় বাবা চলে যান; ফলে, ছবি আঁকতে-আঁকতে, বাড়ি-বাড়ি খেলার পাটও উঠে যায় ক্রমে। এর প্রায় তিরিশ বছর পর সেই শাড়িটি বার করে, মা আমাকে দেন , যা অপূর্ব আদর ও যত্নে রাখা ছিল; কিন্তু সেই দশহাত ধুতি তখন আর আমার শরীরে কুললো না; মেয়েকে পরাতে গিয়েও দেখলাম, আঁকা বাদ দিয়ে সাদা অংশগুলো বড় মলিন হয়ে গেছে। একবার ভাবলাম , পুরোটাই বাঁধিয়ে একটা দেওয়াল ঢাকি; তাঁর সেদিনের অসহায় কষ্ট , প্রতিবাদ সব যেন ধরা আছে এক উত্তাল ঢেউয়ের মতো ফুঁসে ওঠা নক্সায়; অবশেষে সময়ের পলেস্তারা খসিয়ে, সাদা অংশগুলো বাদ দিয়ে, মরচে রঙের নতুন একটা হাফ-তসর শাড়িতে সেই আঁকা টুকরোগুলোই মোহময় জুড়ে দিলেন, পূর্ণিমা দি – নৃত্যগুরু পূর্ণিমা সিং। পুনর্নির্মাণে এবার তা আমাকে জড়িয়ে ধরল। এই শাড়ি পরে, কলেজে এলাম, পি এইচ ডি পদকের সম্মান নিতে। এখনও এটাই আমার একমাত্র প্রিয় শাড়ি; এবং অবশ্যই আমার নারী হয়ে ওঠার সুরুয়াৎও বটে…।।

আমার মেয়ে মধুজা-র গায়ে জড়ানো আমার অন্নপ্রাশনের শাড়ি

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫

3 Responses

  1. অসামান্য মধুর,এবং সুন্দর স্মৃতি,এই অমূল্য সৃষ্টির আনন্দ তোমার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি।ভারী ভালো লাগলো পড়ে।

  2. সুন্দর স্মৃতির কথা খুবই ভাল লাগলো ।

  3. অসাধারণ দিদি। উত্তাল ঢেউ এর মতো শাড়িটা। আর অন্নপ্রাশন এর শাড়িটাও খুব মিষ্টি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *