
২০১৬ সালে নির্মিত অরিন্দম সাহা সরদারের তথ্যচিত্র “অর্ঘ্য” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন, ২২-শে শ্রাবণ, ঘিরে এক গভীর আবেগময় ভ্রমণ। জীবনস্মৃতি আর্কাইভের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তৈরি এই ডকুমেন্টারিটি সুর, দৃশ্য ও স্মৃতির বুননে রবীন্দ্রনাথের অমৃতযাত্রা ও সৃষ্টিশীল উত্তরাধিকারকে নতুনভাবে সামনে আনে। এটি শুধু একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তকে নথিভুক্ত করে না—বরং দর্শককে স্মৃতি, দর্শন ও সঙ্গীতের মাধ্যমে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। চলচ্চিত্রটির প্রতিটি দৃশ্য, শব্দ ও শব্দাতীত নীরবতা রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন ও মৃত্যু সম্বন্ধীয় ভাবনার সঙ্গে মিশে আছে।
চলচ্চিত্রের সূচনা হয় এক করুন বাঁশির সুরে, যা মুহূর্তেই দর্শককে শোক ও শ্রদ্ধার আবহে নিমজ্জিত করে। বাঁশির সুর এখানে শুধু শোকের প্রতীক নয়—এটি একধরনের সান্ধ্য বাঁশি, যা দিনের সমাপ্তি এবং জীবনের অবসানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই পর্দায় ফুটে ওঠে রবীন্দ্রনাথের বিরল আলোকচিত্র—যার কিছু তাঁর জীবনের শেষ পর্বের, আর কিছু তাঁর মৃত্যুদিবসের পরিবেশকে ধারণ করছে। এই ছবিগুলো যেন সময়ের ফটোগ্রাফিক দরজা, যা দর্শককে ১৯৪১ সালের সেই মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
ডকুমেন্টারির অন্যতম উজ্জ্বল মুহূর্ত রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব কণ্ঠে কবিতা পাঠ—“যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে”। এই পাঠ মৃত্যুকে ধীরে ধীরে আগত এক গোধূলির সঙ্গে তুলনা করে, যা তাঁর কাছে আতঙ্ক নয় বরং গ্রহণযোগ্য এক রূপান্তর। দর্শনের দিক থেকে এটি তাঁর জীবনমুখী ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ—মৃত্যু মানে জীবনের পূর্ণতা ও আত্মসমর্পণ।
সোনাঝুরি জঙ্গলে প্রবেশের সময় ক্যামেরার রঙিন থেকে সাদা-কালোতে রূপান্তর একটি শক্তিশালী ভিজ্যুয়াল প্রতীক। রঙিন দৃশ্য বর্তমানকে বোঝায়, আর সাদা-কালো আমাদের ইতিহাসের ভেতরে টেনে নিয়ে যায়—যেখানে ব্যক্তিগত স্মৃতি ও জনস্মৃতি একাকার হয়। এই পরিবর্তন চলচ্চিত্রের বর্ণনায় সময় ও স্থানের সেতু নির্মাণ করে।
সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিনের স্মৃতিচারণ চলচ্চিত্রটিকে আবেগময় ও প্রামাণ্য করে তোলে। তিনি স্মরণ করেন তার বাবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যাওয়ার স্মৃতি। তখন কবি অচেতন অবস্থায় ছিলেন, তবু জীবিত। এই ব্যক্তিগত সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা কেবল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের তথ্যই নয়, সেই দিনের আবহ, নীরবতার ভার, এবং অনুভূতির সূক্ষ্মতা দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়। এইভাবে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা জনস্মৃতিকে আরও গভীর ও জীবন্ত করে তোলে।
কল্পিকা মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রপাঠ শ্রাদ্ধের আচারকে চলচ্চিত্রে জীবন্ত করে তোলে। মন্ত্রপাঠ এখানে শুধু ধর্মীয় আচার নয়—এটি আত্মার যাত্রাপথে শুভাশিসের প্রতীক। কুশল রায়চৌধুরীর বাইশে শ্রাবণ থেকে পাঠ করা অংশে দেখা যায় ঘনিষ্ঠরা কীভাবে কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন—যা সমষ্টিগত শোকের এক সামাজিক প্রতিচ্ছবি।
প্রসূন দাশগুপ্তের কণ্ঠে “কে যায় অমৃতধামযাত্রী” গানটি মৃত্যুকে অমৃতলোকের যাত্রা হিসেবে তুলে ধরে, যা রবীন্দ্রনাথের দর্শনের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে। এখানে সুর এবং কথার মিলনে মৃত্যু এক মহিমান্বিত রূপ পায়। কাজী নজরুল ইসলামের “রবিহারা” কবিতাটি তথ্যচিত্রে ব্যবহার করা হয়, যা তিনি নিজ কণ্ঠে সুরেশ চক্রবর্তীর অনুরোধে বেতারকেন্দ্রে পাঠ করেছিলেন। তাঁর গান “ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে” মৃত্যুকে বিশ্রামের রূপে দেখায়—যেখানে বিশ্রাম মানে মুক্তি।
দেবব্রত বিশ্বাসের “তোমার অসীমে” শ্রাদ্ধে ব্যবহারের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে একধরনের আধ্যাত্মিক সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। গানটি সীমাহীন মহাকালের সঙ্গে আত্মাকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রতীক।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন—মৃত্যুকে অমৃতলোকে যাত্রা এবং সর্বত্র নিজের অস্তিত্ব বিলীন করার চিন্তা—এই চলচ্চিত্রের মূল সুর। তাঁর কবিতা “Where the mind is without fear” এখানে কেবল একটি রচনা নয়; এটি মুক্তি, উন্মোচন এবং ভয়মুক্ত চেতনার ঘোষণা। মৃত্যুর আগে তাঁর ভাবনার শীর্ষ বিন্দুতে ছিল এমনই এক মুক্তির দর্শন।
কবিতা শেষে ক্যামেরার ধীরে ধীরে মাথা থেকে পায়ের দিকে নামা ফ্রেমটি দ্ব্যর্থহীন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পাশাপাশি একটি দার্শনিক ইঙ্গিত দেয়—মাথা অর্থাৎ চিন্তা থেকে পা অর্থাৎ ভূমি পর্যন্ত যাত্রা জীবনের চক্র সম্পূর্ণ হওয়ার প্রতীক। মানুষ যেমন শেষ পর্যন্ত শিকড়ে ফিরে যায়, তেমনি রবীন্দ্রনাথও তাঁর দর্শনে মানুষকে প্রকৃতি ও উৎসের সঙ্গে মিলিয়ে দেন।
চলচ্চিত্রের সমাপ্তি প্রসূন দাশগুপ্তের কণ্ঠে “একি করুণা করুণাময়” দিয়ে, যা করুণার মধ্য দিয়ে শোককে পরিশুদ্ধ করে। এটি এক প্রকার চূড়ান্ত অর্ঘ্য, যা বেদনা ও কৃতজ্ঞতাকে একসঙ্গে ধারণ করে।
সব মিলিয়ে, “অর্ঘ্য” কেবল একটি তথ্যচিত্র নয়—এটি স্মৃতি, দর্শন ও শিল্পের সমন্বয়ে নির্মিত এক অঞ্জলি। প্রতিটি গান, পাঠ ও দৃশ্য এখানে প্রতীকী ভাষায় কথা বলে, দর্শককে বাইশে শ্রাবণের ভেতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের অমৃতযাত্রার সঙ্গী করে তোলে।
দৃশ্য-শ্রাব্য উপস্থাপনার লিংক : https://youtu.be/Dvm8Qg9zXlM
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৬ । ২৬ অগস্ট ২০২৫