ঔপনিবেশিক বাংলার সংগীত-সংস্কৃতিকে বিশ্লেষণ করতে গেলে নারীকণ্ঠের ইতিহাসকে শুধুমাত্র নন্দনতত্ত্বের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। এটি আসলে একটি প্রযুক্তিগত মধ্যস্থতা, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সংযোগে গড়ে ওঠা এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। নারীকণ্ঠের পরিবর্তন বোঝা মানে কেবল কণ্ঠস্বরের ভিন্নতা বোঝা নয়; বরং তা বোঝায় প্রযুক্তির সাথে নারীদের সমঝোতা (negotiation), এবং সংগীতকে ঘিরে গড়ে ওঠা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
তওয়ায়েফ সংস্কৃতি ও প্রাথমিক গায়নরীতি
ঔপনিবেশিক আমলে পেশাদার সংগীতচর্চার প্রধান বাহক ছিলেন তওয়ায়েফ ও বাইজিরা। তাঁদের সংগীতকলা ছিল একদিকে কোঠাভিত্তিক চর্চা ও শাস্ত্রীয় ধারার বাহন। সামাজিকভাবে ‘অভিজাত’ পরিসরে তাঁরা স্থান পাননি, বরং প্রান্তিক ও কলঙ্কিত পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন। তবু তাঁরা খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা ইত্যাদি ধারা বহন করে সংগীতের মূল ভিত্তিকে টিকিয়ে রাখেন। রাজসভা সংস্কৃতির অবসানের ফলে এই শিল্পীরা ক্রমশ কলকাতা, বেনারস ও মাদ্রাজের মতো শহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তাঁরা নতুন অভিজাত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন এবং ধীরে ধীরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন। যেহেতু ভদ্রঘরের নারীরা তৎকালীন নাট্যমঞ্চে অংশ নেননি, তাই এই পেশাদার নারীরাই আধুনিক শহুরে সংস্কৃতিতে সংগীতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
গ্রামোফোনের আগমন ও প্রথম রেকর্ডিং
১৯০২ সালে কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানির অফিস স্থাপন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কোম্পানির রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ফ্রেডেরিক গাইসবার্গ ভারতীয় সংগীতশিল্পীদের রেকর্ড করতে চান স্থানীয় বাজার দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে প্রবল অনীহা লক্ষ্য করা যায়—প্রথমত, তাঁরা তাঁদের ঘরানার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে ভয় পান কারণ নিজস্ব শিক্ষা জনতার কাছে প্রকাশ করলে তাদের সাঙ্গীতিক অনুকরণ অন্যরাও করতে শুরু করবে; দ্বিতীয়ত, রেকর্ড করলে গলা নষ্ট হবে বলে কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন অনেকে। ফলে নারীরাই প্রথম এগিয়ে আসেন। গাইসবর্গ প্রথম শশিমুখীর গান রেকর্ড করেন যেটি প্রথম রেকর্ড হিসাবে ইতিহাসে চিহ্নিত। শশিমুখী গেয়েছিলেন, “আমি তো সজনী কুসুমেরই”। গাইসবর্গ রেকর্ড করলেও তাঁর শশিমুখীর কণ্ঠস্বর পছন্দ না হওয়ায় প্রকৃত প্রথম রেকর্ডিং তারকা হয়ে ওঠেন গৌহর জান।
প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও কণ্ঠস্বরের ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য
গ্রামোফোনের প্রাথমিক প্রযুক্তি কেবলমাত্র মধ্যম স্বরাংশ ধারণ করতে পারত। নিম্ন স্বর (bass) ও উচ্চ স্বর (treble) প্রায় সম্পূর্ণ হারিয়ে যেত। ফলে রেকর্ডকৃত কণ্ঠস্বর শোনাত নাসাল বা ধাতবসদৃশ। পুরুষ কণ্ঠও এর ফলে প্রায়শই নারীকণ্ঠের মতো শোনাত। অন্যদিকে, যেহেতু মাইক্রোফোন তখনো ব্যবহৃত হয়নি, তাই থিয়েটার বা কোঠায় গান গাওয়ার অভ্যাস অনুযায়ী শিল্পীরা উচ্চপিচে, প্রবল স্বরপ্রক্ষেপণে গান গাইতেন। সেই রীতিই রেকর্ডে স্থান পায়। উদাহরণস্বরূপ, আঙুরবালা বা ইন্দুবালার কণ্ঠে আমরা শুনি প্রবল projection, যা তাঁদের প্রশিক্ষণ ও কোর্টেসান-ঐতিহ্যের ফল।
বিদ্যুৎচালিত রেকর্ডিং ও নতুন সম্ভাবনা
১৯২০-এর দশকের পর থেকে যখন বিদ্যুৎচালিত রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হলো, তখন প্রযুক্তিগত দৃশ্যপট আমূল বদলে গেল। মাইক্রোফোন, প্রি-অ্যাম্প্লিফায়ার ও অ্যাম্প্লিফায়ার ব্যবহারের ফলে নিম্ন ও উচ্চ—উভয় স্বরই ধরা সম্ভব হলো। এর ফলে কণ্ঠস্বর পেল নতুন গভীরতা ও পূর্ণতা। loud projection-এর প্রয়োজনীয়তা কমে এল। গানের ধরণও পাল্টাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে জন্ম নিল আন্তরিক গায়নরীতি, যেখানে আবেগ, সূক্ষ্ম অলঙ্কার ও স্বরের মৃদু ওঠানামা রেকর্ডে ধরা সম্ভব হলো। এই পরিবর্তন নারীকণ্ঠে এক মৌলিক রূপান্তর ঘটায়।
গানের ধারার রূপান্তর ও কণ্ঠস্বরের ভিন্নতা
প্রযুক্তির এই রূপান্তর গান গাওয়ার ধরন তথা genre-এর সঙ্গেও যুক্ত। গ্রামোফোন যুগের প্রাথমিক রেকর্ডিংগুলোতে আমরা দেখি খেয়াল, ঠুমরি বা অন্যান্য আধাশাস্ত্রীয় ধারার আধিক্য। শিল্পীরা তাঁদের কণ্ঠস্বরকে জোরালো করে উপস্থাপন করতেন। কিন্তু মাইক্রোফোন ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাংলা গান ও চলচ্চিত্র সংগীত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই ধারার মূল কেন্দ্র ছিল আবেগের সূক্ষ্ম প্রকাশ।
এই প্রেক্ষাপটে কানন দেবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও তাঁর কণ্ঠস্বর উচ্চপিচ ছিল, তিনি কখনোই গৌহর জান বা ইন্দুবালার মতো জোরালো প্রক্ষেপণ ব্যবহার করেননি। বরং তিনি মধ্যম স্বরে সংযত ভঙ্গিতে গাইতেন, যেখানে আবেগ ও স্বরের সূক্ষ্মতা মুখ্য হয়ে ওঠে। এই ধারা নারীকণ্ঠে আধুনিকতার এক নতুন নন্দনতত্ত্ব গড়ে তোলে, যা বাংলা সিনেমার সংগীতে গভীর প্রভাব ফেলে।
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও প্রযুক্তিগত নির্ধারণবাদ তবে কণ্ঠস্বরের এই রূপান্তরকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নতির ফল বলা ভুল হবে। প্রযুক্তি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিলেও, সংগীতশিল্পীদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, শিক্ষণপদ্ধতি ও ব্যক্তিগত নান্দনিকতার প্রভাব সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দুবালা যেহেতু গৌহর জানের কাছে তালিম নিয়েছিলেন, তাই তাঁর কণ্ঠে ঠুমরি ও খেয়াল পরিবেশনার কোর্টেসান প্রভাব সুস্পষ্ট ছিল। মাইক্রোফোন যুগেও তিনি প্রবল projection বজায় রাখেন। অন্যদিকে, কানন দেবীর কণ্ঠস্বর শহুরে আধুনিকতার নান্দনিকতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা এক ভিন্ন কণ্ঠ-নন্দনকে সামনে আনে।
উপসংহার
সর্বোপরি বলা যায়, ঔপনিবেশিক বাংলায় নারীকণ্ঠের রূপান্তর ছিল প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির আন্তঃসম্পর্কে গড়ে ওঠা এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। গ্রামোফোন প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা যেমন কণ্ঠস্বরকে নাসাল ও প্রক্ষেপণমুখী করে তুলেছিল, তেমনি মাইক্রোফোন যুগের আবির্ভাব নতুন এক অন্তরঙ্গ, আবেগঘন কণ্ঠস্বরকে সম্ভব করেছে। কিন্তু এই রূপান্তর কোনোভাবেই একমাত্র প্রযুক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়নি; বরং শিল্পীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রশিক্ষণ ও নান্দনিক নির্বাচনের সঙ্গে প্রযুক্তির সংলাপেই নারীকণ্ঠের আধুনিক রূপ নির্মিত হয়েছে।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । শারদ প্রকাশ । ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫