সে একটা সময় ছিল যখন শিল্পী ছাড়া বিজ্ঞাপন হতো না।
দুরকম শিল্পী। ছবি আঁকার শিল্পী আর কাঠ খোদাই এর শিল্পী। কাঠ খোদাই করে ছাপার যোগ্য ব্লক তৈরী করতে হবে। তবে তো বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ হবে।
জগত এগোচ্ছে। মানুষের ভাবনা চিন্তা এগোচ্ছে, বলা ভাল টেকনলজি এগোচ্ছে। তাই এবার ছাপার জগতে এলো লিথোগ্রাফ। এইখানেই শিল্পীদের প্রয়োজনীয়তা বা কর্মব্যাস্ততা আরও বেড়ে গেল। এখানে শিল্পীরা বিজ্ঞাপনের ছবি তো আঁকতেনই তার সঙ্গে প্রচুর ঠাকুর দেবতার ছবিও আঁকতেন।
এ তো গেল বিজ্ঞাপন ও মুদ্রণ শিল্পের আদি যুগের কথা। যেখানে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে শিল্পীরা ছিলেন একাত্ম্য।
আমাদের আলোচ্য বিষয় বিজ্ঞাপন জগতে শিল্পীরা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন কি না।
আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে যে ফাইন আর্টসের সঙ্গে বিজ্ঞাপনী আর্টসের তফাত টা কোথায়। প্রথম টি শিল্পীমনের বাঁধন হীন ইচ্ছার প্রকাশ…. দ্বিতীয় টিতে বিজ্ঞাপিত বিষয়ের প্রয়োজনে শিল্পীকে এমন কাজ করতে হবে যা ক্রেতাদের এই বিজ্ঞাপিত বিষয় কিনতে প্রলুব্ধ করবে। তাই এখানে শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয় একটা প্রশ্ন চিহ্ন থেকেই যায়।
বিজ্ঞাপন জগৎ ঠিক শিল্পীদের জগৎ নয়। স্থুল ভাবে দেখলে বিপননের জগৎ। সেখানে মোদ্দা কথা বিক্রিবাটা। একটা সময়ে হয়তো সেটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্ত মানুষের সৃষ্টিশীল মন বিপননের শুষ্ক জমিতে জল সিঞ্চন করতে এগিয়ে এলো। এবং নতুন ভাবনার বিজ্ঞাপনের হাত ধরে বিপনন ব্যবসা ক্রেতাদেরও আকর্ষণ করতে সফল হলো। এই কর্মকান্ডে এবার চিন্তাশীল এবং সৃষ্টিশীল মানুষের প্রয়োজন হলো যার ফলে লেখক ও শিল্পীদের ডাক পড়ল। এই উত্তরণ বিগত দুশো বছরের দেশ বিদেশের বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপন জগতের আমূল পরিবর্তন নজর কাড়লো। টেকনলজির প্রভাবে বিজ্ঞাপন জগতে সৃষ্টিশীলতা অনেক বেড়ে গেল। নতুন নতুন অক্ষর বিন্যাস, ফটোগ্রাফি, ফিল্ম, উন্নত মুদ্রণ এবং পরবর্তী কালে কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক যান্ত্রিক সহায়তায় বিজ্ঞাপন ভাবনাকে অনেক আধুনিক করে তুললো। এবং শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতাকে প্রয়োজন মাফিক কাজে লাগাতে শুরু করলো। এর ফলে বিজ্ঞাপনের উৎকর্ষ আরও বেড়ে গেলো। কিন্ত এখানে যেটা লক্ষ্যণীয় তা হল সার্থক বিপননের বিজ্ঞাপন কিন্ত নির্ভর করে তার স্ট্রাটেজির ওপর। সেখানে কারুর স্বাধীনতা বা পরাধীনতার প্রশ্নই নেই। ক্রেতাদের আকর্ষণ ও বিক্রয়ের জন্য যে ভাবে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন তাই করতে হবে। বিজ্ঞাপন জগতের মহাগুরু ডেভিড ওগিল্ভী সাহেব দ্যর্থহীন ভাষায় বলেই দিয়েছেন
“Nothing is Creative unless it Sells”.
এবার আসি শিল্পীদের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে। একটি বিজ্ঞাপন সৃষ্টির পেছনে অনেকেরই অবদান থাকে। শিল্পীর কাজ হচ্ছে সবার ভাবনাচিন্তার শিল্প সম্মত রূপ দেওয়া। অনেক সময় বিভিন্ন শিল্পীর নিজস্ব স্টাইল বিজ্ঞাপনে কাজে লাগানো হয়ন। যেমন জগৎ বিখ্যাত সালভাদার দালি। তিনি অনেক বিজ্ঞাপনের কাজ করেছেন অবশ্যই তাঁর নিজস্ব স্টাইলে কিন্ত বিজ্ঞাপনের মূল ভাবনাটা বজায় রেখে। যেমন সঙ্গের ছবিটা।

এটি একটি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপন। বক্তব্য: ক্রেতারা যেন ইনভেস্টমেন্টের ভুতুড়ে, অবাস্তব জগতে হারিয়ে না যান। এই বক্তব্যের রূপ দিয়েছেন শিল্পী নিজস্ব স্টাইলে।
আবার নীলকমল প্লাস্টিক চেয়ারের বিজ্ঞাপন দেখুন।

বক্তব্য: তাদের তৈরী প্লাস্টিক চেয়ারের শক্তি। সার্কাসের পরিবেশে এক বিশালাকার হাতি এক ছোট্ট প্লাস্টিক চেয়ারে দাঁড়িয়ে। শিল্পী তার মনের মতন করে একটি অতি আকর্ষণীয় ছবি আঁকলেন যা ক্রেতাদের নজর কাড়লো।
তাহলে শিল্পীদের হতাশার কোন কারণ তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কিন্ত হতাশা অবশ্যই আছে। তা হল সমষ্টিগত ভাবে সৃষ্ট বিজ্ঞাপন যখন বিক্রেতার বা বিজ্ঞাপনী ভাষায় ক্লায়েন্টের পছন্দ হলোনা হতাশা তখনই।
তাই বিজ্ঞাপন জগতে স্বাধীনতা শুধু শিল্পী কেন, সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কারুর ই নেই। বেচাকেনার সুপার মার্কেটে তথাকথিত স্বাধীনতা শব্দ টা চিন্তা করাই অবাস্তব।

ছবি সংগ্রহ : মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫