Jibansmriti Archive

শিবরাম চক্রবর্তী 

মালদা জেলার চাঁচর সিদ্ধেশ্বরী ইন্সটিটিউশন তখন বিশাল বড় এক ইস্কুল। নামডাক তার পর্যাপ্ত। সেই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে বোধহয় বিখ্যাততম নাম শিবরাম চক্রবর্তী। বাংলা রসসাহিত্যের একচ্ছত্র সম্রাট। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে সারা দেশ তখন জেগে উঠেছে প্রবল পরাক্রমে। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। সেখানকার কিশোর-তরুণ-ছাত্রদল সহিংস স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে উন্মুখ। মারতে হবে ব্রিটিশদের, না হলে বিদায় নেবে না শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারীরা। এরকম একটি গোপন ষড়যন্ত্র রূপায়িত করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল শিবরামের স্কুলটিকে, আর সেই হত্যাকার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্বয়ং শিবরামকে!

   ঘটনাক্রম খানিক এই রকম: বিলেতে যুদ্ধ বেঁধেছে। বাংলাদেশে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি হচ্ছে। ইস্কুলের ছেলেদের সেনা বাহিনিতে নেবার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব দলবল নিয়ে স্কুলে এসেছেন। স্কুলের মাঝখানে ড্রিল মাঠ, সেখানে সামিয়ানা খাটিয়ে সভা হচ্ছে। চারদিকে সাজো সাজো রব। মঞ্চে চেয়ার সাজিয়ে বসেছেন সাহেব, রেকটার, হেডস্যার। অন্যেরাও আছেন। সাহেব যখন বক্তৃতা দিতে উঠবেন তখুনি গুলি চালাতে হবে শিবরামকে- এমনই নির্দেশ এসেছে গুপ্তদল থেকে। ক্লাস টেনের ছাত্র শিবরাম বসে আছেন সামনে। প্যান্টের পকেটে পিস্তল। তাতে ভরা তাজা কার্তুজ। ম্যাজিস্ট্রেটকে লক্ষ করে গুলি চালাবার দায়িত্ব তাঁর‌ই।

       মাস কয়েক আগে স্কুলের ক্লাসে হেডস্যার সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলেন বড় হয়ে কে কি হতে চাও। চিরকাল এসব প্রশ্নের উত্তরে ছাত্ররা বলে ডাক্তার কিম্বা শিক্ষক হতে চাই। এখানেও তাই হল। শুধু শিবরাম বলল সে বড় হয়ে দেশপ্রেমিক হতে চায়। হেডস্যার খুশি হলেন ঠিকই, কিন্তু আসল ঘটনা ঘটল স্কুল শেষের পর।

       সহপাঠী সতীশ পাকড়াও করল তাকে- “আমাদের দলে তোকে চাই।” ব্যাস। বিপ্লবী দলে নানা তালে-গোলে যুক্ত হয়ে  গেলেন কিশোর শিবরাম। গুপ্ত সমিতির সেন্টার কোথায়, কে দলের লিডার, আর কে কে আছেন, কিছুই জানা যায় না। শিবরাম শুধু চেনেন ওই সতীশকেই। সমিতি থেকে শিবরামের নতুন নামকরণ করা হল- সুরেন। দলীয় নাম। এই নামে চিঠি-পত্রে আসবে গোপন নির্দেশ। তবে সবই সাংকেতিক ভাষায়। এভাবেই একদিন একটা পার্সেল এল। তাতে তিনটে পিস্তল। প্রচুর কার্তুজ। “পিস্তল-কার্তুজ এল কেন রে?” সতীশকে জিজ্ঞেস করেন শিবরাম। “আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্য। স্বদেশী-ডাকাতি করতে হবে না? নইলে টাকা আসবে কোথা থেকে?” সতীশের নির্লিপ্ত উত্তর।

       “ডাকাতিও করতে হবে? সত্যিকারের ডাকাতি?”

        “অবশ্যই। আমরা প্রথম ডাকাতি করব কলিগ্রামের ফকির সরকারের বাড়ি।“

    সিঙ্গিয়ার আমবাগানে শুরু হল পিস্তলের নিশানা প্র্যাকটিস। হাজার হাজার আম গাছ। জঙ্গলের মত নির্জন। দিনের বেলাতেও কেউ খুব একটা ঢোকে না এই বাগানে। গুলির আওয়াজ কারও কানে যাবে না। হাত যখন নিশানায় জবরদস্ত হয়ে উঠল শিবরামের, তখন নির্দেশ এল এবার খতম করতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটকে।

       আসছে শনিবার সেই দিন।

   “যেমন ঢিলে শার্ট পরে রোজ স্কুলে যাস তেমন ভাবে যাবি না কিন্তু। ভারী কোট আর প্যান্ট পরবি। তাহলে তোর  পকেটের পিস্তলটা কারও নজরে পড়বে না। তৈরি থাকিস। আমি এসে ঠিক সময়ে নিয়ে যাব। আমার সঙ্গে প্যান্ডেলে যাবি, ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেব।” সতীশের নির্দেশ শুনে শিবরামের বুকের ভিতর ঢাক পিটাতে থাকে।

     শনিবার এল। সতীশও এল। শিবরামের পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে একবার পরখ করে নিল সে। বন্ধুর প্রস্তুতিতে খুশি- “এই সপ্তাহেই আমাদের গুপ্ত সমিতির ‘অমর শহীদ সিরিজ’-এ তোর জীবনী বেরিয়ে যাবে। তুই অমর হয়ে যাবি। লোকের মুখে মুখে তোর নাম ছড়াবে। ক্ষুদিরাম আর শিবরাম- একসাথে বলবে দেশের লোক।” 

     শিবরাম বুঝতে পারেন না এখুনি তার শহীদ হবার কথা আসছে কেন! তবু আসন্ন কর্তব্য তাকে চিন্তিত করে তোলে। আসলে শিবরাম তখনও জানতেন না তার কাজ শেষ হতে না হতেই তাকে লক্ষ করে গুলি চালাবে সতীশ। দল থেকে এমন নির্দেশই এসেছে। ধরা পড়ে গিয়ে শিবরাম যদি গোপন কথা বলে দেন, তাই স্কুলের মাঠেই মরতে হবে তাকে। 

        মঞ্চের একদম সামনেই বসলেন শিবরাম। দু-সারি পিছনে সতীশ। তার কোটের পকেটে হাত। শিবরামও তার মত কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পিস্তল পাকড়ে বসে আছেন। তার পাশে বসে আছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক হাবিলদার। আড় চোখে মাঝে মাঝে তাকে দেখে নিচ্ছেন শিবরাম- কিছু বুঝতে পারছে না তো!

        গুলি চালানোর পর কীভাবে পালাবেন, সেটাই মনে মনে ভেবে নিচ্ছেন শিবরাম: সাহেবের পতন এবং মৃত্যুর সাথে সাথে দারুণ হই-চই পড়ে যাবে। হট্টগোলের মধ্যে ভেঙে যাবে সভা। সবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিশ। কে কোথায় পালাবে তার ঠিক থাকবে না। সেই সুযোগে শিবরাম ঘাড় গুঁজে ভিড়ের ভিতর ঢুকে পড়বেন। সেখান থেকে সটান চলে যাবেন সামসিতে। সামসি থেকে কলকাতা।

        পর পর ভাষণ চলছে। প্রথমে হেডস্যার, তারপর রেকটার কামাখ্যাবাবু। বাঙালি যুবকদের সামনে নিজের বীরত্ব দেখানোর এটাই নাকি দুরন্ত সুযোগ, সেনা বাহিনিতে যোগদান করুক স্কুলের বীর ছাত্রদল- এমনই মতামত তাঁর। সবশেষে ভাষণ দিতে উঠলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট। যুদ্ধক্ষেত্রের নানা রোমাঞ্চকর কাহিনি অনর্গল বলে যাচ্ছেন তিনি। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে প্রত্যেকের। এরপরেই সাহেব তার সৈন্যবাহিনিতে যোগ দেবার ডাক দিলেন ছাত্রদের। আছে নাকি এই স্কুলে তেমন অকুতোভয় ছাত্র?- জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। ঠিক তখুনি সাহেবকে গুলি করবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন শিবরাম। তার দেখাদেখি উঠে দাঁড়াল সতীশও। 

        দুই ‘বিপ্লবী’ দাঁড়ানোর সাথে সাথেই হাততালিতে ফেটে পড়ল সভা। সবাই ধরে নিল এরা সেনাবাহিনিতে যোগ দেবে, তাই উঠে দাঁড়িয়েছে তারা। তাদের জন্য গর্বিত স্কুলের সবাই। অভিবাদনের বন্যায় ভেসে গেল দুই কিশোর। ম্যাজিস্ট্রেট  সাহেব শিবরামকে মঞ্চে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন সেইদিন।

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস 

প্রথম বর্ষ । শারদ প্রকাশ । ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *