আমি এমন একজন মানুষের সম্পর্কে জেনেছি যিনি পুরো দেশ,সমাজ তথা সংস্কৃতির কাছে একজন আদর্শ। তিনি কে সেটা নাহয় সব শেষে জানতে পারবেন, আগে এটা জানা প্রয়োজন তিনি একজন ধর্মে-ধর্মে যে বিভেদ,তাকে ভেদ করে সমাজের কল্যাণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তাহলে শুরুটা খুব ছোট থেকেই করা যাক। ১৯৭১ সাল। আমাদের গল্পের নায়ক তখন স্কুল পড়ুয়া। একদিন স্কুল যাওয়ার সময়ই তৎকালীন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক বা পুরাতত্ত্ববিদ সম্মাননীয় তারাপদ সাঁতরার সাথে দেখা হয়, যখন তিনি এবং তার কয়েকজন সাথী পাথরা-র খোঁজ করেন। কৌতূহল বসতই গ্রামের এক ছোট্ট খুদে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন বলে তাদের সঙ্গে এগিয়ে চলে। রাস্তা দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় সামান্যই কিছু কথাবার্তা হয় এবং জঙ্গলে ভর্তি সেই মন্দিরগুলোতে নিয়ে যায়। কথোপকথন সূত্রে ছোট্ট ছেলেটি বুঝতে পারে মন্দির গুলোর আসল গুরুত্ব কতটা। তখন তার ছোট্ট মনটিতে মন্দির গুলোর সম্পর্কে বেশ আগ্রহ জন্মায়, বুঝতে পারে এগুলোকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব। বাড়িতে ফিরে মন্দির গুলোর সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানেন এবং তারাপদ সাঁতরার সঙ্গে মোটামুটি ভাবে যোগাযোগ রাখার ফলে তিনি নানা সময়ে উৎসাহিত করেন মন্দিরগুলো বাঁচানোর ব্যাপারে এবং একদিন বলেন, ‘শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ করলে হবে না এই মন্দিরগুলি তোমাকেই রক্ষা করতে হবে বাঁচাতে হবে, এসব তোমার সম্পদ আমাদের সম্পদ।’ এই একটি লাইন তার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দাঁড়ায়। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই মন্দির বাঁচানোর যুদ্ধে নেমে পড়ে সে। প্রতিকূলতাকে কীভাবে প্রত্যাহত করবে তার সামান্যটুকু ধারণাও ছিল না, কিন্তু যে চেতনা এতদিন পর্যন্ত কারোর মধ্যে ছিল না সেটি কত অনায়াসেই এই ছোট বয়সে আকর্ষিত করল এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি তার লড়াইয়ের প্রথম ধাপটা যেটা নেন সেটা হল-নানা সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে একটা বার্তা পৌঁছানো– আমরা মানুষ, হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী গোষ্ঠী সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমরা মানুষ। আমাদের এই ছোট্ট গ্রাম এমন এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী যা সচরাচর কোথাও দেখা যায় না। তাই আমাদের উচিত রাষ্ট্রীয় সম্পদকে রক্ষা করা। লাইন দুটো হয়তো বলা খুব সহজ কিন্তু এই প্রাথমিক ধাপ কে বাস্তবায়িত করা যে কতটা কঠিন সেটা একমাত্র আমাদের গল্পের নায়কই জানেন। বেশ কিছু বছর কেটে যায়। ১৯৯১ সালে তাদের স্থানীয় একটি ক্লাবের মধ্যে একটা ছোট্ট আলোচনা সভার আয়োজন হয় এবং সেখানে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়। সংগঠনের গুরুত্ব বুঝে গ্রাম শুধু নয়, শহরের বেশ কিছু নামী গুণী ব্যক্তি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এই পদক্ষেপে।
সংগঠনের নাম হয় “পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি” (Pathara Archaeological Preservation Committee)। কমিটির সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হয় জেলাশাসক অর্থাৎ এসপি, ডিএম, বেশ কিছু কলেজ-ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের হেড, মেদিনীপুর কলেজের প্রফেসর সহ সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু সমস্ত কিছুর পূর্বে বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা প্রয়োজন, তাই তৎকালীন গ্রাম পঞ্চায়েত সাহায্য করে, ফলত গ্রামের সকলেই খুব উৎসাহিত হয় এবং সেই দিনটি একটা মেলার মতোই রূপ ধারণ করে। বস্তুতপক্ষ কমিটি বা তার সদস্যদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেটা হচ্ছে তখনো অনেক মানুষই স্থাপত্যগুলোর গুরুত্ব বুঝতে নারাজ। কিন্তু মিডিয়ার সহায়তায় পাথরার জনপ্রিয়তা বেশ বেড়ে যায় এবং নানা জায়গা থেকে টুরিস্ট আসতে শুরু করে। ১৯৯৩ সালে রেডিওতে ঘোষণা হল সাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য রক্ষার্থে আমাদের নায়ক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কবীর পুরস্কারে পুরস্কৃত হচ্ছেন। ১৯৯৪ সালের ১৩ ই আগস্ট প্রথমবার দিল্লি গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড: শংকর দয়াল শর্মা কবীর পুরস্কার তুলে দেন। ব্যাপারটির গুরুত্ব প্রণব মুখার্জির কাছে পৌঁছে যায় এবং তিনি ধর্মপুর আইআইটির আর্কিটেক্ট ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে একটি প্রজেক্ট বানিয়ে দিতে বলেন। ঘটনা ক্রমে তিনজন উচ্চপদস্থ প্রফেসর গ্রামে এসে ১৫ দিন সময় নিয়ে একটি প্রজেক্ট রেডি করেন এবং প্রণব মুখার্জির কাছে পৌঁছে দেন। ১৯৯৫ সালে প্রজেক্টটিকে মাথায় রেখে ১৫ লক্ষ টাকার বাজেট তুলে দেওয়া হয় এবং উদ্দেশ্য ছিল ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির গুলোর সংস্কার। কিন্তু এখানে একটি সমস্যার উদঘাটন হয়, জেলা শাসক থেকে টাকা যখন পঞ্চায়েত এবং বিশেষ কিছু রাজনৈতিক মানুষের কাছে পৌঁছায় তখন তাদের বক্তব্য মন্দির সংস্কার না করে ভাঙ্গা নদীর পাড় সারাই করতে হবে। এর বিরুদ্ধে কমিটি বিরোধিতা করে এবং আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৯৫ সালের স্যাংশন হওয়া ২০ লক্ষ টাকা ১৯৯৮ সালে প্রথম ব্যবহৃত হয়, হ্যাঁ, মন্দির সংস্কারের কাজেই। এসময়ে কমিটি থেমে থাকেনি। তাদের একটা লক্ষ্য হয় রাজ্য নয়, সেন্ট্রাল আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের হাতেই পাথরার ৪২ টি মন্দিরের দায়িত্ব তুলে দেওয়া, এর জন্য দিল্লি সহ বেশ অনেক জায়গাতেই প্রচার শুরু হয়। তৎকালীন রেলমন্ত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জির সাথে যোগাযোগ ঘটে এবং বার্তা পৌঁছে যায় তখনকার কালচারাল ডিপার্টমেন্ট মিনিস্টারের কাছে। সাফল্যের আর একটা নতুন ধাপ, ৪২ টি মন্দিরের মধ্যে ৩৪ টি মন্দির সংলগ্ন ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই একটি সাফল্য কিন্তু সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙে দেয়। হিন্দু মুসলমান এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগোতে থাকে। এরপরে ২০১২ সাল পর্যন্ত উনিশটি মন্দির সংস্কৃত হয়। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয় ১৯৯৮ সালে যে জমি অধিগ্রহণ করা হয় তার যে মালিক তারা ২০১২ সালে তাদের জমি বাবদ টাকার আবেদন করে।
আমার এতটা লেখার কারণ এই একটাই সমস্যার সমাধান করার প্রচেষ্টা। সাধারণ মানুষের যে জমি অধিগ্রহণ করা হয় তাদের নানান আর্থিক সমস্যা মিটতে পারতো ওই জমির টাকা দিয়ে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতই আমার গল্পের নায়ক সেই টাকা দাবির লড়াইটা ২০২৫ সালেও জিততে পারলেন না। হ্যাঁ তিনি ইয়াসিন পাঠান, তার নাম হয়তো অনেকেই জানেন কিন্তু আরো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। সাধারণ মানুষগুলো চেয়ে আছেন ইয়াসিন পাঠানের দিকে, আর ইয়াসিন পাঠানের একমাত্র চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সাধারণ মানুষগুলো তাদের প্রাপ্য অর্থটা ফিরে পাবে তো? কিন্তু ২০২৫-এ এসেও কোন সুরাহা পায়নি। কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকার কেউই আর কোন সফল উদ্যোগ নিতে পারেনি। যে মানুষটা নিজে সাম্প্রদায়িকতার বেড়া জাল ভেঙে রাষ্ট্রের তথা মানব কল্যাণের জন্য উদ্যোগী হন, যে মানুষটা কবীর পুরস্কারে পুরস্কৃত হন তার এই লড়াইয়ের জন্য, সে কি ন্যায় এর প্রত্যাশা করতে পারেন না? প্রশ্নগুলো থেকে যায় উত্তর গুলো খুঁজে বার করা এতটা সহজ নয়। তাই আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে না, মানুষ হিসেবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য।
অদ্রিত হালদার দ্বাদশ শ্রেণি, বাণীপুর বাণীনিকেতন হাই স্কুল,উত্তর ২৪ পরগনা
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
অদ্রিতের এই লেখাটি আরো অনেক ছাত্র ছাত্রীকে উৎসাহিত করবে
আরও লেখ। বড় মানুষ হও!