Jibansmriti Archive

‘…..আপনার স্ত্রীর নাম কী ছিল।’

আমি কহিলাম, ‘নৃত্যকালী।‘

  এই বাক্য বিনিময়ের পরেই গল্পের সমস্ত অলৌকিক নির্মাণ আবার ফিরে আসে বাস্তব সত্ত্বায়। ১৮৯৬ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অলৌকিক ছোট গল্প ‘মণিহারা’ পাঠকের সামনে এক অদ্ভুত দ্বৈত আখ্যান তৈরি করে। এখানে শুধু দুই কথক, দুই শ্রোতা নন; তার সাথে পুরুষ-নারীর দুই সত্ত্বা, আবার বাস্তব-পরাবাস্তব দুই জগতের এক রহস্যময় সীমারেখায় এসে দাঁড়ায় পাঠক। এ গল্প হতেও পারে ভূতের আবার নাও হতে পারে। আবার এখানে আছে গল্পের মধ্যে গল্প। ‘মণিহারা’, ‘কঙ্কাল’, ‘ক্ষুদিত পাষাণ’ – এই ছোটো গল্প গুলির মধ্যে মূল গল্পের মধ্যে আছে একটা ফ্রেম গল্প। ‘মণিহারা’ তে ফ্রেম গল্পে রয়েছে ফণীভূষণ আর সেই মাস্টারমশাই আর ভেতরের গল্পে রয়েছে ফণীভূষণ আর তাঁর স্ত্রী মণিমালিকা।

   এভাবেই রবীন্দ্রনাথের কিছু ছোটো গল্পের বিশ্লেষণ রেকর্ড করা হয়েছে ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’-এর দৃশ্য-শ্রাব্য উপস্থাপনায়। শুধু বই নয়, সাহিত্যের নানা দিকের সংরক্ষণও এই আর্কাইভের অন্যতম বিষয়। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আর্কাইভের অবেক্ষক অরিন্দম সাহা সরদার রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছোটো গল্প বিষয়ে বাংলা ভাষার অধ্যাপক, গবেষক তথা বিশিষ্ট লেখক শ্রীমতী গোপা দত্ত ভৌমিকের আলোচনা রেকর্ড করেছেন, যা আগ্রহী পাঠককে এই গল্পগুলির অন্তর্নিহিত নিবিড় জগতকে অনুধাবন করতে এক দিক নির্দেশ করে।

    নারী-মনের এক অন্য দিক ‘মণিহারা’ গল্পে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ভালোবাসাহীন নিস্পৃহতার মধ্যে শুধুই অলঙ্কারের লোভ, যা এক প্রকার বিকার। সেসময় সাধারণ মেয়ে মানুষের যে সংজ্ঞা ছিল স্বামী, সন্তান নিয়ে ঘরকন্যায় ডুবে থাকা, সেই সংজ্ঞা কেই প্রশ্ন করে মণিমালিকা। সে স্বামীকে ভালোবাসে না, হয়ত সন্তানও চায় না। সে শুধুই আঁকড়ে রাখে তার নিজের জমা পুঁজি, তার অধিকার, তার সিন্দুক ভর্তি  গয়না, যা সে প্রাণ থাকতে নিজের থেকে আলাদা হতে দেয় না। ফণীভূষণ তাকে যতই ভালোবাসে সেগুলি সবই অলঙ্কারে রূপান্তরিত হয়ে সিন্দুকে চলে যায়, হৃদয়ে জমা হয় না। নিজের পুঁজি বাঁচানোর তাগিদে মণিমালিকা ছিল অসমসাহসী, অচেনা গ্রামতুতো পরিচয়ের এক ব্যক্তির সঙ্গে সে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে পড়ে শুধুমাত্র ফণীভূষণ যাতে সেই গয়না আবার না দাবী করে বসে।

দৃশ্য-শ্রাব্যে ব্যবহৃত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি ছোটোগল্প অবলম্বনে নির্মিত তিনকন্যা চলচ্চিত্রের একটি গল্প ‘মণিহারা’-র স্থিরচিত্র।

গোপা দত্ত ভৌমিকের মতে আদর্শ ভৌতিক গল্প এমনই হয় যা আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক সীমারেখায় দাঁড় করিয়ে দেয়। সমস্তটাই নির্ভর করে এক সূক্ষ্মবোধের ওপর। সরাসরি কিছু বলা হয় না, শুধু এক অদ্ভুত অলৌকিক আবহ তৈরি হয়। তার মধ্যেই এখানে দেখা যায় এক অদ্ভুত দাম্পত্যের সম্পর্ক, যেখানে একে অন্যের থেকে দূর প্রান্তবর্তী হয়ে থাকে, আর সেই সঙ্গে ভৌতিক আখ্যানের মধ্যে দিয়ে রচিত হয় এক ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি। যদিও সত্যজিতের চলচ্চিত্রায়ণে দর্শক এক রহস্য-আচ্ছন্ন, ভৌতিক আবহই দেখে। কিন্তু মূল গল্পের শেষে যখন স্ত্রীর নাম উচ্চারিত হয় ‘নৃত্যকালী’ সে সময় যেন এতক্ষণ যে কুহক তৈরি হয়েছিল তা হঠাতই ছিন্ন হয়ে পাঠককে নিয়ে আসে বাস্তবের মাঝে আর কথকের হাস্যরসও যেন খানিকটা মিলে যায় সেই বাস্তবের সাথে।

অধ্যাপিকা গোপা দত্ত ভৌমিক

প্রাবন্ধিক গোপা দত্ত ভৌমিকের জন্ম ১৯৫৬ সালে হাওড়ায়। পিতৃ মাতৃবংশের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লায়। বাবা শ্রী যতীশচন্দ্র দত্ত ও মা শ্রীমতী নীলা দত্ত দুজনেই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। গোপা শিক্ষালাভ করেছেন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। লেডি ব্রেবোর্নের অধ্যক্ষ, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য — এই সব প্রশাসনিক পদের গুরু দায়িত্ব সামলেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। প্রকাশিত বই — প্রবন্ধসংগ্রহ, গল্প উপন্যাসের পাঠপ্রসঙ্গ, কথার অলিন্দে ইত্যাদি। গল্প লেখেন। প্রিয় যাপন — বিচিত্র প্রসঙ্গে বাছবিচারবিহীন অহেতুক পুস্তকপাঠ, গান শোনা, বিশেষ করে দেশি বিদেশি ধ্রুপদী সংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত, চিত্র ও ভাস্কর্যের প্রদর্শনীতে মুসাফিরগিরি, সর্বোপরি বন্ধুসংসর্গ।

সাক্ষীচিত্রের লিংক : https://youtu.be/fJRSt7uqxlE

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৫ । ১০ অগস্ট ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *