Jibansmriti Archive


পোস্টমাস্টার ও রতন। কলিকাতা ও উলাপুর গ্রাম। এই দুইয়ের ব্যবধান কোনোভাবেই ঘোচে না। আর চূড়ান্ত পরিণতিতে আসে নিষ্ঠুর অবহেলা আর করুণ বিচ্ছেদ। ‘… জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।‘ – গল্পের শেষে এমন তত্ত্ব কথা উদ্ধৃত করে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা হলেও তা কোনোভাবেই রতনের চোখের জল থামাতে পারে না, এক ’ অব্যক্ত মর্মব্যথা ’ পাঠক-হৃদয় কে আকুল করে তোলে, আর পাঠক এক আবেগ-আপ্লুত ক্যাথারটিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়।
এভাবেই রবীন্দ্রনাথের কিছু ছোট গল্পের বিশ্লেষণ রেকর্ড করা হয়েছে ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’ এর দৃশ্য- শ্রাব্য উপস্থাপনায়। শুধু বই নয় সাহিত্যের নানা দিকের সংরক্ষণও এই আর্কাইভের অন্যতম বিষয়। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আর্কাইভের অবেক্ষক অরিন্দম সাহা সরদার রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু ছোট গল্প বিষয়ে বাংলা ভাষার অধ্যাপক, গবেষক তথা বিশিষ্ট লেখক শ্রীমতী গোপা দত্ত ভৌমিকের আলোচনা রেকর্ড করেছেন, যা আগ্রহী পাঠককে এই গল্পগুলির অন্তর্নিহিত নিবিড় জগতকে অনুধাবন করতে এক দিক নির্দেশ করে। এই দৃশ্য-শ্রাব্য উপস্থাপনা তে মূল কাহিনি বিষয়ক আলোচনার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের অংশ বিশেষ যুক্ত করা হয়েছে চরিত্রগুলিকে আরও স্পষ্টভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করতে।
জমিদারির কাজে রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে এলেন সেসময় পল্লী-জীবন কে তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। পল্লীগ্রামের মানুষ, পল্লীপ্রকৃতি তাঁর মধ্যে গল্পধারার জন্ম দিয়েছিলো। যার মধ্যে অন্যতম ‘পোস্টমাস্টার। শ্রীমতী গোপা দত্ত ভৌমিক বলেছেন ‘ছিন্নপত্র’ তে এমনই এক পোস্টমাস্টারের কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন যিনি দৈবাৎ শহর থেকে গ্রামে এসে পড়েছিলেন। গল্পের পোস্টমাস্টারকেও কলকাতা থেকে উলাপুর আসতে হয়েছিল আর ‘ জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত’ হয়েছিল।

দৃশ্য-শ্রাব্যে ব্যবহৃত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি ছোটোগল্প অবলম্বনে নির্মিত তিনকন্যা চলচ্চিত্রের একটি গল্প ‘পোস্টমাস্টার’-র স্থিরচিত্র।

‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে গ্রাম্য বালিকা রতনের মনের অনুরাগ, প্রেম, ভক্তি, আবেগ, সেবাপরাণয়তা আবার কঠিন অবহেলায় তার হৃদয় উৎসারিত যন্ত্রণা এগুলিই মুখ্য চরিত্র। সেই ‘ সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ ’ করেছিল। পোস্টমাস্টার কি এই অনাথা মেয়েটিকে নিয়ে যেতে পারতেন না, ফেলে রেখে গেলেন তাকে কার কাছে—গোপা দত্ত ভৌমিকের এই প্রশ্ন বারবার পাঠককেও বিহ্বল করে। যে মেয়েটি তার জন্য সব দিয়েছে তার মঙ্গল-অমঙ্গল চিন্তা না করেই পোস্টমাস্টার নিজের সুবিধার্থে চাকরি ছেড়ে ফিরে গেলেন। এখানে মধ্যবিত্ত চরিত্র এবং পল্লীর দীন বালিকার মধ্যে বৈপরীত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শহর-গ্রাম, সবল-দুর্বলের মধ্যেও বৈপরীত্য প্রকাশ পেয়েছে এখানে। তাই বোধহয় সত্যজিতের চলচ্চিত্রে দর্শক শোনে পোস্টমাস্টারের গান জানা, পড়াশোনা শেখা বোন রানীর উচ্চকিত বর্ণনা। পুরুষ আর নারীর আবেগের তফাৎ ও যেন ফুটে উঠেছে এই গল্পে। গ্রামের অনভ্যস্ত, একাকী জীবনে রতনই হয়ে উঠেছিল পোস্টমাস্টারের একমাত্র আশ্রয়। নির্জন গ্রামে, বন্ধুহীন প্রবাসে রতন ই ছিল তার বন্ধু, বোন, মা আবার কখনও তার প্রেমিকাও হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু শুধু নিজের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে চাকরি ছেড়ে রতনকে ফেলে চলে যান পোস্টমাস্টার। রতনের নিঃস্বার্থ শ্রম, সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে বিশ্বাসের বদলে সে পেয়েছিল শুধু অবহেলা আর বিশ্বাসঘাতকতা। মূল গল্পের শেষে রতনের অশ্রুজলে ভেসে দাদাবাবুর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা থাকলেও, সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবিতে দেখিয়েছেন সমস্ত যন্ত্রণাকে চেপে রেখে রতন আবার নতুন পোস্টমাস্টারের জন্য কাজে লেগে পড়েছে। সত্যজিতের রতন অবহেলাকে কিছুটা অবজ্ঞা করেই শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই যেন তার জীবনের অমোঘ পরিণতিকে মেনে নিয়েছে। তবে ‘বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না…’ এ কথা সত্যি হলেও রতনের দিক থেকে ভাবলে ‘পোস্টমাস্টার’ এর মতো করুণ গল্প পাঠক বোধহয় কমই পেয়েছে রবীন্দ্র-রচনায়।

দৃশ্য-শ্রাব্যে ব্যবহৃত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি ছোটোগল্প অবলম্বনে নির্মিত তিনকন্যা চলচ্চিত্রের একটি গল্প ‘পোস্টমাস্টার’-র স্থিরচিত্র।

দৃশ্য-শ্রাব্য উপস্থাপনার লিংক : https://youtu.be/E2qf93Wvz_0

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৬ । ২৬ অগস্ট ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *