এস্রাজের রণধীর এবং রনধীরের এস্রাজ এই দুই অস্তিত্বই আক্ষরিকভাবে অবিচ্ছেদ্য। ১৯৮৫ সালে ফরাসী তথ্যচিত্র-নির্মাতা ক্লদ সোভাজোর সঙ্গে আলাপচারিতায় শিল্পী রণধীর রায় ব্যক্ত করেন- এস্রাজে তারের একেকটি ঝংকার যেন গানের একেকটি শব্দ। তবে কন্ঠ-সঙ্গীতের ধ্রুপদী বিন্যাস নয়, নানান রাগের মিলনে তাঁর নিজের তৈরি সুরবিন্যাস বাজাতেই তাঁর সবচেয়ে বেশি আনন্দ। স্বরচিত সুর-মূর্ছনাকে প্রাণ দিতে তিনি তাঁর এস্রাজকেও নতুন করে সাজিয়ে নেন। যন্ত্র ও যন্ত্রী একাত্ম হয়ে পড়েন বিভিন্ন রাগের সুরতালে। শিল্পী রণধীর রায় হয়ে ওঠেন এস্রাজের প্রাণপুরুষ। সঙ্গীতময় এই মানুষটিকে আরও নিবিড়ভাবে চিনে নেওয়া যায় অরিন্দম সাহা সরদার পরিচালিত তথ্যচিত্র ‘এস্রাজের রণধীর’-এ। এই তথ্যচিত্রটি আক্ষরিকভাবেই একটি সাক্ষীচিত্র- যা শিল্পী রণধীর রায়ের সমগ্র যাপনকে দর্শকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়।
সমগ্র তথ্যচিত্রে, নেপথ্যে যেভাবে রণধীরের ভাষ্য ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মনে হয় দর্শক-শ্রোতার সঙ্গে যেন সরাসরি কথোপকথনে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। শুরুতেই ধ্রুপদী সুরালাপ নিয়ে রণধীরের কথা শুনতে শুনতে কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় রিলের সংখ্যাগুলির উল্টো গুণতি – সেই সঙ্গে সময়ও পিছু হটে ফ্ল্যাশব্যাকে। সাক্ষীচিত্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গুনীজনের নাম ফুটে ওঠে স্ক্রিনে, শোনা যায় গায়কী আর গৎকারী নিয়ে রণধীরের আলোচনা আর সেই সঙ্গে অ্যালবামের সাদাকালো স্থির চিত্রগুলি দেখিয়ে দেয় ছেলেবেলা থেকে সুর আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের মাঝে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে শান্তিনিকেতনের ‘টুকু’ কীভাবে বেড়ে উঠেছিলেন। এস্রাজকে জড়িয়ে ধরে ছোটবেলার যে ভালোবাসার ছবি তা-ই যেন ভবিষ্যতের দিক-নির্দেশ হয়ে ওঠে। কথা চলতে চলতে শোনা যায় রণধীরের উদাত্ত হাসি আর পর্দায় স্পষ্ট হয় ছবির শিরোনাম। তারপরেই শুরু হয় তাঁর এস্রাজের মূর্ছনা। দূরদর্শনের রেকর্ডিং-এ দর্শক দেখে নিবিষ্ট এক শিল্পীকে — কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন বলেছেন ‘রণধীরের যে মগ্নতা তা শিল্পের মগ্নতা’।
এরপর সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রণধীর প্রসঙ্গে যখন এক উদ্দীপ্ত তারুণ্যের কথা উল্লেখ করেন সেসময় খোলা জানলার সামনে তাঁর মুখে যে উজ্জ্বল আলোর প্রতিফলন তা যেন রণধীরেরই উদাত্ততার বিচ্ছুরণ। তথ্যচিত্র যত এগোতে থাকে দর্শক শুধু এস্রাজ বাদক রণধীরকে দেখে না, সাক্ষাৎ করে এক উন্মুক্ত, আনন্দময় হৃদয়কে। দূরদর্শন থেকে সংগৃহীত রণধীর রায়ের অনুষ্ঠানের অংশগুলি পরিচালক এমন এক ফ্রেমের মধ্যে রেখেছেন, তা যেন ’৭০, ’৮০ র দশকের টেলিভিশনের সামনে নিয়ে যায় দর্শককে। সময় যেন থমকে দাঁড়ায় রণধীর রায়ের এস্রাজের সামনে।
পণ্ডিত অশেষ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা পণ্ডিত বিষ্ণু গোবিন্দ যোগ এই দুই গুরুকেই বারবার প্রণতি জ্ঞাপন করেছেন রণধীর। এস্রাজ নিয়ে অশেষ চন্দ্রের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গুরু-শিষ্যের নানা মুক্ত আলোচনা যে তাঁকে আরও বেশি ঋদ্ধ করেছিল এবং এস্রাজের সঙ্গে তাঁর বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করেছিল তা সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় রণধীরের ভাষ্যে। তবে গুরুর কাছে অধীত বিদ্যায় রণধীর নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। পারম্পরিক ধারাকে অনুসরণ করেও ক্রমশঃ যেমন নিজেকে সুরের উচ্চ আসনে উন্নীত করেছেন তেমনই নিজস্ব সুরব্যঞ্জনাকে আরও শ্রুতিমধুর করার প্রয়োজনে এস্রাজ যন্ত্রটিকেও উন্নত করে নিয়েছেন। শুধুমাত্র সঙ্গতযন্ত্র নয় একক পূর্ণতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এস্রাজ-বাদন, যা একাধারে শিল্পী এবং অন্বেষক রণধীর রায়ের অবদান। রণধীর যখন বলেন তাঁর নতুন এস্রাজের বিবর্তনের কথা সেসময় ক্যামেরাও ধীরে ধীরে সরতে থাকে পুরনো থেকে নতুন বাদ্যযন্ত্রের দিকে। পরিচালক দেখিয়ে দেন সেই পরিবর্তনের পর্যায়গুলি। শুধু এস্রাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়, রণধীর রায়ের অনুসন্ধিৎসু মন কখনও বানিয়েছে বিভিন্ন মডেলের এরোপ্লেন, কখনও বা চালিয়েছে রিমোট কন্ট্রোলের গাড়ি। নতুন রাগ, বন্দিশ, কিংবা নতুন গৎ রচনায় সুদক্ষ এক সুর-প্রণেতার পাশাপাশি এই সাক্ষীচিত্রে দেখা যায় এক নিবিষ্ট যন্ত্রী, এক সঙ্গীতমগ্ন শিল্পী, এক দরদী প্রশিক্ষক, এবং সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত, মানুষকে।
আলাপ থেকে দ্রুত লয়, রণধীরের সুরবিন্যাসকে সঙ্গী করে ক্রমশঃ এগোতে থাকে সাক্ষীচিত্র। বিভিন্ন বিদগ্ধজনের কথার মন্তাজে আবার কখনও তাঁর নিজের ভাষ্যে শিল্পী রণধীরের সমুজ্জ্বল ব্যাক্তিত্ব আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এই সাক্ষীচিত্রে। রনধীর নির্মিত এস্রাজ যন্ত্রটির খুঁটিনাটি বিবর্তনও বিশ্লেষিত হয় এই চিত্রভাষ্যে। বুদ্ধদেব দাস এবং রমিত রায়ের কথা থেকে জানা যায় এস্রাজের তড়ব ,তার, ছড়ি প্রভৃতি বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে রণধীরের নানান ভাবনা যা এস্রাজকে আরও শ্রুতিমধুর করে তোলে। যন্ত্র কিংবা বাদন-শৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে রণধীর ছিলেন একক সাধক। কিন্তু কোনো সৃষ্টি সম্পূর্ণ হলে তিনি ডেকে নিতেন তাঁর স্ত্রী আলপনা রায় কে। অ্যালবামের বেশির ভাগ ছবি সাদা-কালো বা সেপিয়া বর্ণক্রমে রাখলেও স্ত্রী আলপনার সাথে ছবিটিতে যে গোলাপি আভা যোগ করেছেন পরিচালক তা যেন এক সৃজনধ্যানীর আবেগ আর ভালোবাসার রঙ।
নানান কথা শুনতে শুনতে, অনেক কিছু দেখতে দেখতে দর্শক-মন যখন আবিষ্ট হয়ে পড়ে ঠিক তখনই হঠাৎ থেমে যায় সব কথা। শব্দহীন পলকে নেমে আসে মৃত্যুর কালো আঁধার। পর্দায় দেখা যায় শেষ বিদায়ের তারিখ- ২৪শে মার্চ ১৯৮৯। আরও অনেক সৃষ্টির সম্ভাবনা অকালেই থেমে যায় চিরতরে। খবরের কাগজে ছাপা শিরোনাম- ‘শেষ আসরে রনধীর’। কিন্তু সাক্ষীচিত্রটি এখানেই শেষ হয়না। আবার বেজে ওঠে রনধীরের এস্রাজ। আবির সিং খাঙ্গুরার মতো নতুন সঙ্গীত প্রজন্ম উদ্যত হয় রণধীর-চর্চায়। শান্তিনিকেতনের শান্ত প্রকৃতির মাঝে আবার অনুরণিত হয় রণধীরের এস্রাজ।
একেবারে শেষ দৃশ্যে দেখা যায় নির্মল নীল আকাশের গায়ে রনধীরের ছোটবেলার এক স্বপ্নের কথা- যে কোনোদিন কোনো বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার তাঁর ছবি তুলতে আসবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন হয়ত কিছুটা পূরণ হয়েছিল ক্লদ সোভাজো’র সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের সময়। তবে সম্পূর্ণ তথ্যচিত্রের কাজ অসমাপ্তই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু এবার সমাপ্তিতে ক্যামেরার শাটারের শব্দ যেন জানিয়ে দেয় যে এখন তিনি অনেক ঊর্ধ্বে থাকলেও নতুন ভাবে তাঁর অনন্য কীর্তি লেন্সবন্দী করার কাজ সম্পূর্ণ হল অরিন্দম সাহা সরদার পরিচালিত এই সাক্ষীচিত্রে।

এস্রাজের রণধীর সাক্ষীচিত্রের প্রচারপত্র । শিল্পী : রূপকথা সাহা সরদার
সাক্ষীচিত্রের Video link : https://youtu.be/UW70OtJZth0
মৌমিতা পাল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিল্পকলার ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর। ছাপাই-ছবি নিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং পুরস্কার প্রাপ্তি। পত্র-পত্রিকায় চিত্র সমালোচনা এবং শিল্প-ইতিহাস বিষয়ক লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। পেশা শিক্ষকতা ।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত