ভারতীয় সংগীতের রেকর্ড ইতিহাসে Michael Kinnear-এর “The Gramophone Company’s First Indian Recordings (1899-1907)” একটি অভূতপূর্ব দলিল। এই বইটি কেবলমাত্র প্রথম দিককার রেকর্ডিংয়ের বিবরণ নয়, বরং এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক রূপান্তরের নথি—যেখানে ভারতীয় সংগীত প্রথমবারের মতো যান্ত্রিকভাবে সংরক্ষিত ও বিতরণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্নিয়ারের গবেষণা এই সময়কে একটি সঙ্গীত ঐতিহ্য ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সংযোগস্থল হিসেবে চিহ্নিত করে।
বাংলা গানের ইতিহাস এবং কানন দেবীর সংগীতজীবন নিয়ে গবেষণার সূত্রেই আমি শুরুর দিকের ইতিহাসটি ধরার প্রচেষ্টায় এই বইটির বহু খোঁজ করি। অবশেষে নিজের রিসার্চের কাজে গিয়েছিলাম জীবনস্মৃতি আর্কাইভ-এ। পুরনো রেকর্ড ও সংগীত বিষয়ক দলিল খুঁজতে খুঁজতেই এই আর্কাইভের কিউরেটর অরিন্দম সাহা সরদার তার কাছে সংরক্ষিত থাকা এই বইটি আমার হাতে তুলে দেন।
সেই সূত্রেই প্রথম বইটির সাথে পরিচয়, আর সংগীত, প্রযুক্তি ও ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের এই অভূতপূর্ব সংযোগ নিয়ে ভাবনা শুরু। বইটি কেবল রেকর্ডের ইতিহাস নয়, বরং একটি সময়ের শব্দ-নথি, যা ভারতীয় সংগীতচর্চার গোড়ার দিনগুলোকে অনন্য দৃষ্টিতে ধরেছে। সেই পাঠ-অভিজ্ঞতার ওপরেই ভিত্তি করে এই লেখাটি।

রেকর্ডিং যুগের সূচনা: একটি নতুন শ্রবণ অভিজ্ঞতা:
১৮৯৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি যখন ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে, তখন সঙ্গীত ছিল মূলত মঞ্চ বা রাজসভাকেন্দ্রিক পারফর্মিং আর্ট। রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে প্রথমবার সংগীত “বস্তু” হয়ে উঠল—যেটি এখন আর পরিবেশনের সময় বা স্থানের সঙ্গে বাঁধা নয়। কিন্নিয়ার দেখান কিভাবে কোম্পানির প্রথম রেকর্ড করা গানগুলি, যেগুলির বেশিরভাগই ছিল হিন্দুস্তানি ও লোকধর্মী, শ্রোতার ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে শুরু করল।
এই পর্বে রেকর্ড করা শিল্পীদের নাম বহুক্ষেত্রে অজানা রয়ে গেছে, কারণ কোম্পানি প্রথমে পারফর্মারদের নাম উল্লেখ না করে শুধুমাত্র গান বা রাগের নাম ছাপাতো। এটি একটি সাংস্কৃতিক দূরত্ব তৈরি করেছিল, যা কিন্নিয়ার সতর্কভাবে চিহ্নিত করেন। শিল্পীর পরিচয় ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে বাণিজ্যিকীকরণের পর।
কলোনিয়াল কাঠামো ও প্রযুক্তির আগমন:
বইটিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি দেখায় কিভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামোর ভেতরে একটি নতুন প্রযুক্তি ভারতীয় সমাজে ঢুকল। কিন্নিয়ার ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে জার্মান প্রকৌশলী এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা স্থানীয় সংস্কৃতিকে এক প্রকার “বাজারজাত” করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেন। এখানে ‘গ্রামোফোন’ ছিল শুধুই একটি যন্ত্র নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতাকারী—যার মাধ্যমে ‘ভারত’ ও ‘ভারতীয়তা’ একটি নির্দিষ্ট কাঠামোয় ধরা পড়ল এবং বিদেশি ব্যবসার পণ্য হয়ে উঠল।
এখানে প্রযুক্তির প্রভাব শুধু সংগীত পরিবেশনের প্রক্রিয়ায় নয়, বরং গান বাছাইয়ের মধ্যে, রেকর্ডিংয়ের দৈর্ঘ্যে, এমনকি পারফর্মেন্স স্টাইলেও দৃশ্যমান হয়। কিন্নিয়ার দেখান যে রেকর্ডিংয়ের সময়সীমা (প্রথমদিকে প্রায় ৩ মিনিটের মতো) শিল্পীদের গায়কীতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছিল। ফলত, খেয়াল বা ধ্রুপদী সংগীতের দীর্ঘস্থায়ী বক্রতা হ্রাস পায় এবং ছোট আকারে উপস্থাপিত হয়।
শহর, শ্রেণি ও শ্রোতার রূপান্তর:
কিন্নিয়ারের বইয়ে দেখা যায় কীভাবে এই রেকর্ডিং যুগ ধীরে ধীরে শ্রোতার ধারণা বদলে দেয়। আগে সংগীত ছিল সরাসরি পারফর্মেন্স নির্ভর, শ্রোতাও ছিলেন উপস্থিত। কিন্তু রেকর্ডের মাধ্যমে শ্রোতা হলেন অনুপস্থিত, এবং ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। এটি ভারতীয় সঙ্গীত চর্চায় এক নতুন ধারা সূচিত করে, যেখানে বাজার ও শ্রোতা একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা নিতে শুরু করে।
এই পরিবর্তন সর্বপ্রথম দেখা যায় কলকাতা, বোম্বে ও লাহোরের মতো শহরগুলিতে, যেখানে এক নবীন মধ্যবিত্ত শ্রেণি জন্ম নিচ্ছে এবং গ্রামোফোন একটি “স্টেটাস সিম্বল” হয়ে উঠছে। কিন্নিয়ার চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেন, কীভাবে এই শ্রেণি ঘরে বসে সংগীত শোনার অভ্যাস তৈরি করে এবং শিল্পীদের জনপ্রিয়তার সংজ্ঞাও বদলে যায়।
কিছু মুখ ও কিছু গল্প:
Kinnear তাঁর বইয়ে কিছু বিখ্যাত শিল্পীর প্রসঙ্গ টানেন—যেমন গওহরজান, যিনি রেকর্ড ইতিহাসের মহিলা তারকা হিসাবে সারা ভারতে খ্যাত হন। কিন্তু, আমরা যদি রেকর্ডিয়ের ইতিহাস দেখি, তাহলে ভারতের সর্বপ্রথম শিল্পী যাকে দিয়ে ইংল্যান্ডের রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার জি. এস. গেইসবার্গ রেকর্ড করান, ১৯০২ সালে, তিনি হলেন শশীমুখী। গানটি হলো ‘আমি কি সজনী কুসুমেরি’। কিন্তু গেইসবার্গের কাছে মনঃপূত হয়নি শশীমুখীর কন্ঠস্বর। তিনি শশীমুখী ও তার সাথে আর এক শিল্পী ফনীবালার সম্বন্ধে বলেছিলেন, “two nautch girls having miserable voices”। অতএব, গওহরজানই প্রথম তারকা হিসাবে রেকর্ডে প্রতিষ্ঠিত হন।
এছাড়াও বইটিতে উল্লেখ আছে কতিপয় ধর্মীয় বা আঞ্চলিক সংগীত রেকর্ডিং-এর, যেমন বাউল, কীর্তন বা আরবী-উর্দু গজল। এইসব ধারা একদিকে ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে ছিল “লোকজ” বা “এক্সটিক”, অপরদিকে এগুলির মধ্যেই ছিল স্বদেশি আবেগ ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সূত্র।

দলিল ও সংরক্ষণের মূল্য:
Michael Kinnear-এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল যে তিনি একাধারে একজন ইতিহাসবিদ ও সংরক্ষণকারী হিসেবে কাজ করেছেন। বইটিতে বহু বিরল রেকর্ডের তালিকা, ম্যাট্রিক্স নম্বর, রেকর্ডিং তারিখ, জায়গা, এবং পারফর্মারের নামও নথিভুক্ত রয়েছে। এই তথ্যসমূহ শুধু ঐতিহাসিক নয়, বরং সংগীত গবেষণার ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ।
বইটি থেকে বোঝা যায়, একটি রেকর্ড শুধুমাত্র শব্দ ধারণ নয়—তা সময়, স্থান, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে একটি দলিল। কিন্নিয়ার আমাদের শেখান, কীভাবে একটি ছোট ৭ ইঞ্চির শেল্যাক ডিস্ক আসলে একটি সভ্যতার ইতিহাস বহন করে।
অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে: “The Gramophone Company’s First Indian Recordings (1899-1907)” কেবল একটি ইতিহাস নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি। মাইকেল কিন্নিয়ার দেখিয়েছেন কিভাবে প্রযুক্তি, উপনিবেশ, ব্যবসা এবং সংগীত একসাথে মিলে একটি নতুন যুগের জন্ম দিয়েছিল। এই বই পাঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কেবল সংগীতও কীভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দলিল হয়ে উঠতে পারে। আর রেকর্ড, তা যতই পুরনো হোক, আজও আমাদের নতুনভাবে শুনতে শেখায়।

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫
Wow! Superb dear. একদম আমার পছন্দের স্টাইলে লিখছিস। Great. Hats off.