Jibansmriti Archive

ছবি – নিমাই ঘোষ । সৌজন্য – সাত্যকি ঘোষ

সিনেমা যখন থেকেই মধ্যবিত্ত জীবনের ঘরের কথা হয়ে উঠল, তখন থেকেই আর শুধু সিনেমার গল্প নয়; বরং যাকে নিয়ে গল্প, সেই চরিত্র-ও দর্শকের কাছে জীবন্ত রয়ে গেল চিরদিনের জন্য। পুরাণ, ইতিহাস ঝেড়ে ফেলে এবারে গল্প হ’ল “আমি-তুমি” র কথা। তাই সিনেমার নামেও বদল আসতে লাগল। উত্তমকুমার বা সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমার একটা ব্র্যাণ্ড হয়ে উঠলেন। এই জুটির সিনেমায় বাঙালির জীবনের ওঠাপড়ার যা যা কথা বলা যায়, তার সবটাই আসতে লাগল। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘মরণের পরে’, ‘সদানন্দের মেলা’য় গল্পের কথকতাই ছিল সিনেমার ফোকাসে। কোথাও মেসবাড়ির গল্প, কখনও সদ্য দেশভাগের স্মৃতি, আবার বাড়ির মালিকানা নিয়ে সমস্যা তখন কলকাতার অলিগলিতে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। তার ছিলনা কোনও লজ্জা বা আব্রু। সমকালীন পরিস্থিতি বাংলার জীবনযাপনকে কিছুটা টালমাটাল দশায় ফেলেছিল তো বটেই। ১৯৫৪ সালের অগ্রদূতের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ এমনই এক সুপারহিট ছবি যেখানে নায়ক-নায়িকার কথা তারা নিজেরাই বলবে। ঠিক তার আগেই ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ রিলিজ করেছিল। তবুও সেখানে বিশু (উত্তমকুমার) ও সতীর (সুচিত্রা সেন) মাঝে একটা পর্দা রয়ে গেছিল গ্রামীণ সংস্কারের। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকেই এই জুটি স্বাবলম্বী হয়ে উঠল। এরপর থেকেই তাদের নায়ক-নায়িকার জায়গা থেকে সরানো যায়নি। ‘শাপমোচন’-এর পারিবারিক অভিশাপ কেটে যাচ্ছে বা শঙ্কর ‘সবার উপরে’তে তার বাবার থেকে অপবাদের কালো দাগ সরাতে পেরেছে, নায়িকার জন্যই। ভালো ক’রে খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সময়কার উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমাগুলোতে তাদের কাজকর্ম, প্রেম-ভালোবাসা হলেও পরিবারকে উপেক্ষা ক’রে নয়। ‘সাগরিকা’য় আবারও বদল এ’ল। এই প্রথম এই জুটির এমন এক সিনেমা যেটা নায়িকার নামেই। এই নামে এক রোমান্টিকতা মিশে আছে। এ যেন সত্যিকারের এমন স্বপ্নে দেখা নায়িকা। ‘হারানো সুর’, ‘পথে হ’ল দেরী’তেও বাধা, বিরহ, বিচ্ছেদের সুর রয়েছে, কখনও পথ দু’দিকে চলেছে আপন তালে কিন্তু সেই দূরত্বকে তারাই দূর করেছে। ‘চন্দ্রনাথ’-এ স্ত্রী ও পরিবারের দ্বন্দ্ব থাকলেও যেহেতু তা শরৎসাহিত্যের চিত্রায়ন, তাই সেখানে নতুনের প্রত্যাশা থাকতে পারেনা। এসব পেরিয়ে ১৯৫৮ সালে যখন নীরেন লাহিড়ীর পরিচালনায় বড় পর্দায় আসে ‘ইন্দ্রাণী’, তখন থেকেই বদলে গেল এই জুটির আবরণ। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কাহিনি অবলম্বনে সিনেমাটি তৈরি হলেও তখন এই ছবির আবেদন ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। ইন্দ্রাণী একজন চাকুরীজীবি নারী। অন্যদিকে তার স্বামীকে এক ধরণের বে-রোজগেরে বলা যায়। একান্নবর্তী পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক অশান্তিকে ফেলে তারা নতুন নীড়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। এই ইন্দ্রাণী কে? বৈদিক সাহিত্যে ইন্দ্র ‘দেবরাজ’। পুরাণের যুগে তার স্ত্রী পৌলোমী শচী। ইন্দ্রের স্ত্রী ব’লেই তার নাম ‘ইন্দ্রাণী’। সেই চরিত্রের বিশেষ অবদান ছিলনা পুরাণে। এই নামটিকেই অসাধারণ কৌশলে তুলে ধরেছিলেন কাহিনিকার তথা পরিচালক। এমন এক নারীচরিত্র যে একসময় অপ্রধান থাকলেও এবারে হয়ে উঠছে প্রধান। ‘সাগরিকা’, ইন্দ্রাণী’ এবং পরবর্তীতে ‘বিপাশা’, ‘কমললতা’ও নায়িকাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চেয়েছে কিন্তু ‘বিপাশা’ সেই পঞ্জাবের নদীর ম’তই চড়াই-উতরাই পথে বয়ে চলেছিল বা কমললতা শ্রীকান্তের পাশে থাকা শ্রীকান্তেরই এক অবচেতন মনের কোমল সত্তা। বিপাশা যেখানে লড়াই করে তার প্রেমিক দিব্যেন্দুর স্বার্থেই, সেখানে ইন্দ্রাণী একসময় তার স্বামীর স্মৃতি ধরেই নিজের ম’ত ক’রেই জীবনস্রোতে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকের এই সিনেমা তুলে ধরেছে এক উপার্জনক্ষম বিবাহিত বাঙালি নারীর সংকল্পকে। সে তার শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দেয়নি। আবার তেমনই দাম্পত্য জীবনের মনান্তরকেও প্রশ্রয় দেয়নি। বাবার আদুরে মেয়ে ইন্দ্রাণী ছিল নারীর মনোবল না ভেঙে দেওয়ার এক প্রতীক। সে পারে এবং তার সেই জয়ে তার সঙ্গী হয়ে থেকেছে তারই নিজের ধৈর্য। বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও দীর্ঘদিন সে স্বামীর কোনও সন্ধান পায়নি। অবশেষে সে ফিরে গেছে সেই নিরুদ্দেশ স্বামীর কাছেই। এ তার আত্মসমর্পণ নয়; এ শুধুই ভালোবাসার জোর। যখন তার স্বামী নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন তাদের দ্বন্দ্ব কোথায় যেন মলিন হয়ে গেছে। তার সাধ পূরণ হয়েছে। ডুবে যাওয়া সূর্য আবারও উদিত হয়েছে। সে ভালোবেসেছে, বাড়ির অমতে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে, শ্বশুরবাড়ির পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারলে পথের সন্ধানে বেরিয়েছে ও শেষে স্বামীর কাছেই ফিরে এসেছে। তার মধ্যে ছিলনা কোনও অহেতুক আত্মগরিমা। তাই বাংলা সিনেমার এই উত্তম-সুচিত্রা জুটির এমনই এক documentary হয়ে আছে যেখানে দর্শক খুঁজে নিতে পারে সমস্যা সমাধানের রাস্তা। ১৯৭০-এর দশকে ‘নবরাগ’-এও দাম্পত্য জীবনের সমস্যা রয়েছে কিন্তু দ্বন্দ্বটা ছিল সন্তানের অভিভাবক হয়ে উঠতে পারায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অমর্যাদা ‘ইন্দ্রাণী’-তে উঠে আসেনি। এই সিনেমা বুঝিয়েছিল স্বামী, স্ত্রী দু’জনেরই নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা উচিত। একে অন্যের সঙ্গী হতে পারে, সমব্যথী হতে পারে কিন্তু একে অন্যের ‘দায়িত্ব’ নয়। ইন্দ্রের জন্য ইন্দ্রাণী নয়; বরং ইন্দ্রাণীকে সঙ্গে নিয়েই থাকুক ইন্দ্র।

জীবনস্মৃতি আর্কাইভের সংগ্রহ থেকে

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস । শুচিস্মিতা চট্টোপাধ্যায়

প্রথম বর্ষ । বিশেষ প্রকাশ । ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *