
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার নগরসংস্কৃতির ভেতরে নারী শিল্পীদের ভূমিকা ধীরে ধীরে নতুন মাত্রা লাভ করে। এই পরিবর্তনের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন ইন্দুবালা—গায়িকা, অভিনেত্রী এবং জনসম্মুখে নিজস্ব কণ্ঠস্বর স্থাপন করা একজন শিল্পী। তাঁর জীবন এবং পারফর্মেন্স শুধু সঙ্গীতচর্চার ইতিহাস নয়, বরং নারীসত্তার প্রকাশ ও জনমঞ্চে স্বীকৃতির এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসও বটে।
ইন্দুবালা মূলত কলকাতার চিত্তবিনোদনের জগৎ থেকে উঠে এসেছিলেন, যেখানে থিয়েটার, গানের আসর, ও নাট্যসংগীত মিলেমিশে এক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিসর তৈরি করেছিল। ইন্দুবালার কণ্ঠ ছিল সরল অথচ শক্তিশালী—শ্রোতার হৃদয়ে সহজে পৌঁছানো যায় এমন একটি মধ্যমূর্তির আবেগ।
ইন্দুবালা শুধুমাত্র স্বভাবগত প্রতিভার ওপর নির্ভর করেননি। আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার, অতীত দিনের স্মৃতি থেকে জানা যায় তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ সম্বন্ধে । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিল প্রখ্যাত গায়ক গৌরীশঙ্কর মিশ্র, ও কালীশঙ্কর মিশ্রের থেকে। পরবর্তীকালে তিনি ঠুংরি, দাদরা, চৈতী ইত্যাদির শিক্ষা নিয়েছিলেন গহরজানের থেকে। ইন্দুবালা তাঁর সাক্ষাৎকারে জানান গহর তাকে মুজরার পরিবেশে কি ধরণের গায়নভঙ্গি লাগে, এবং সেখানে কি প্রকারের আচার পালন করতে হয়, ইত্যাদির শিক্ষাও দিয়েছিলেন। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূলভিত্তি, স্বরবিন্যাস, লয় ও তালের নিয়ন্ত্রণ এবং সঙ্গীতে সংযত ভঙ্গিতে আবেগপ্রকাশ শিখতে পেরেছিলেন।
এই শিক্ষার প্রভাব ইন্দুবালার কণ্ঠে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কণ্ঠে সুরের নিখুঁততা, উচ্চারণের পরিষ্কারতা এবং আবেগের সূক্ষ্মতা প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে “ও রে মাঝি তরি হেথা” গানে এই প্রশিক্ষণের ছাপ দৃশ্যমান। গানের মৃদু ওঠানামা, আবেগের সংমিশ্রণ এবং রেকর্ডিংয়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কণ্ঠের শক্তিশালী উপস্থিতি সবই তাঁর শিক্ষার ফল।
রেকর্ড কোম্পানিগুলি কলকাতায় গান রেকর্ড করা শুরু করার পর নারীকণ্ঠের বাণিজ্যিক মূল্য আবিষ্কৃত হয়। ইন্দুবালা ছিলেন সেই প্রথমদিকের শিল্পীদের একজন, যাঁদের গান রেকর্ড হয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তাঁর কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণ, আবেগময় ভঙ্গি এবং এমন এক স্বর-পরিসর ছিল যা যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শ্রোতাকে মুগ্ধ করত। বাঁধন সেনগুপ্ত উল্লেখ করেছেন, তাঁর গায়ন সহজ অথচ গভীর; এখানে শাস্ত্রীয় নিয়ম নয়, বরং মানবিক স্পর্শই শ্রোতাকে আকর্ষণ করত।
প্রার্থনা পুরকায়স্থ তাঁর গবেষণায় ইন্দুবালার স্ক্র্যাপবুক বিশ্লেষণ করেছেন। এতে আছে আমন্ত্রণপত্র, ছবি, ফুলের তোড়া, পত্রিকা কাটা ও দর্শকদের দেওয়া চিঠি। এই নথিপত্রগুলো থেকে বোঝা যায়, ইন্দুবালা কীভাবে জনসমক্ষে নিজেকে গড়েছিলেন। একদিকে তিনি গায়িকা, অন্যদিকে সমাজে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য একজন নারী হিসেবে নিজেকে ধারাবাহিকভাবে নির্মাণ করেছেন। তাঁর পারফর্মেন্স কেবল গানেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি নিজের উপস্থিতিকে একটি সাংস্কৃতিক বয়ানে পরিণত করেছিলেন।
ঔপনিবেশিক কলকাতার সমাজে একজন নারী শিল্পীর উপস্থিতি ছিল জটিল। একদিকে সমাজ তাঁকে ‘নাচগানের মেয়ে’ হিসেবে সীমাবদ্ধ করতে চাইত, অন্যদিকে তাঁর শিল্পের মধ্যে ছিল এক অস্বীকারযোগ্য শক্তি। ইন্দুবালার প্রশিক্ষণ এবং পারফর্মেন্স কৌশল তাঁকে জনমঞ্চে আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি দিত। শ্রোতারা কেবল কণ্ঠ শুনতেন না; তারা অনুভব করতেন এক শিল্পীর নিজস্ব নৈপুণ্য এবং পারফর্মেন্সের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন। স্ক্র্যাপবুক এবং পারফর্মেন্স নথি দেখায়, তিনি নিজের কণ্ঠ এবং পারফর্মেন্সে শাস্ত্রীয় প্রশিক্ষণ ও আবেগময়ী ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা একত্রিত করে একটি নতুন ভাবে নারীর উপস্থিতি তৈরি করেছিলেন।
কালচারাল হিস্ট্রির দৃষ্টিতে, ইন্দুবালার জীবন প্রমাণ করে যে ইতিহাস কেবল ঘটনার নয়, কণ্ঠ, দেহ এবং পারফর্মেন্সেরও। তাঁর কণ্ঠে আমরা শুনি এক যুগের প্রতিধ্বনি—যেখানে নারীর কণ্ঠ প্রথমবার জনমঞ্চে স্বীকৃত হতে শুরু করেছিল। গানগুলিতে লোকসঙ্গীত, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত ও নাট্যসংগীতের ছোঁয়া রয়েছে, যা তাঁকে সংস্কৃতির সংযোগস্থলে দাঁড় করায়।
পারফর্মেন্স সামাজিক ও নৈতিক সীমার মধ্যেও আত্মপ্রকাশের পথ হয়ে দাঁড়ায়। ইন্দুবালার মতো শিল্পীরা দেখিয়েছেন, নারীসত্তা কেবল গৃহের ভেতরে নয়, মঞ্চেও সমান সত্য। তাঁর আবেগ, দেহভঙ্গি এবং উপস্থিতি একত্রে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ভাষা গড়ে তোলে, যা পরবর্তীতে কলকাতার সংগীত ও নাট্যসংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
ইন্দুবালার জীবন ও পারফর্মেন্স আমাদের স্মরণ করায়, কণ্ঠের মধ্যেও ইতিহাস লেখা যায়—যেখানে শব্দ, আবেগ এবং নারীসত্তা মিলেমিশে এক নতুন সাংস্কৃতিক চেতনা সৃষ্টি করে।

ইন্দুবালার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতার রামবাগান অঞ্চলে, যা তৎকালীন সময়ে রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলের নারীরা সমাজের চোখে প্রান্তিক, কলঙ্কিত এবং সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে বাদ পড়া বলে বিবেচিত হতেন। কিন্তু ইন্দুবালা সেই জায়গা থেকেই উঠে এসে দেখিয়েছিলেন—এই নারীরাও শিল্পী হতে পারেন, তাঁদেরও কণ্ঠ আছে, তাঁদের জীবনও ইতিহাসের অংশ।
নিজের জনপ্রিয়তা ও সামাজিক স্বীকৃতি লাভের পর ইন্দুবালা সেই জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বরং তিনি রামবাগানের মেয়েদের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছিলেন। বাঁধন সেনগুপ্তের সাক্ষাৎকারভিত্তিক নথি ও স্থানীয় রেফারেন্স অনুযায়ী, তিনি পরবর্তী জীবনে রামবাগানে বসবাসকারী কিছু নারীকে শিক্ষা এবং শিল্পচর্চার সুযোগ করে দেন। এই উদ্যোগগুলির মাধ্যমে ইন্দুবালা রেড লাইট এলাকার মেয়েদের একটি “এজেন্সি” বা স্বতঃসিদ্ধ পরিচয় গড়ে তুলতে সাহায্য করেন—যারা ছিল মূলত সমাজের চোখে ‘পতিতা’।
এই কাজের মাধ্যমে ইন্দুবালা নিজেও একটি নতুন সামাজিক অবস্থান তৈরি করেন। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যিনি একদিকে রেড লাইট এলাকার জন্মসূত্রের কলঙ্ক বহন করছিলেন, অন্যদিকে সেই কলঙ্ককেই সাংস্কৃতিক মর্যাদায় রূপান্তরিত করেছিলেন। রামবাগানের মেয়েদের জন্য তাঁর এই কাজ নিছক দানশীলতা নয়, বরং একধরনের সামাজিক সক্রিয়তা (activism), যেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন—নিজস্ব শিল্পচর্চা এবং পারফর্মেন্সের মাধ্যমে নারীরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে নিতে পারে।
এইভাবে, ইন্দুবালার কণ্ঠ ও কাজ একত্রে এক নতুন ধরণের নারীর উপস্থিতি তৈরি করে, যেখানে শিল্প ও সমাজ একে অপরের পরিপূরক। তাঁর জীবন তাই শুধু গানের ইতিহাস নয়; এটি উপনিবেশিক সমাজে নারীস্বাধীনতার প্রথম সূক্ষ্ম আকারগুলির একটি প্রতীক।
এই লেখাটি আমি শেষ করতে চাই ইন্দুবালার লেখা একটি চিঠি সমরেশ বসুর স্ত্রী গৌরী বসুর উদ্দেশ্যে যা আনন্দবাজার পত্রিকায় পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়। গৌরী বসু ইন্দুবালার কাছে ১৯৬৪-৬৫ সালে গান শিখতে আসতেন এবং ইন্দুবালার খুব স্নেহের পাত্রীও ছিলেন। এই চিঠিটি প্রমাণ করে সেই সময়ে একজন নারী গায়িকার শিল্পী হিসাবে জনপ্রিয়তা থাকলেও তার সামাজিক অবস্থান কেবলই সঙ্ঘাতের দ্বারা জর্জরিত। ইন্দুবালা লিখছেন, “ তোমাদের তুলনায় আমার ধরনধারণ, মেজাজ কি মিল হতে পারে মা? না না, নিজেকে কোনো দিক থেকে আমি ক্ষমা করতে পারিনা আজ পর্যন্ত। কেন, কেন আমি ভদ্রঘর থেকে ইন্দুবালা হতে পারিনি। কীসের জন্য এই পল্লীর মেয়ে আমি? জানো মা গৌরী! দুনিয়াশুদ্ধু সকলে বলে আপনি ভদ্রপল্লীতে যান, স্কুল করুন – – আপনার জিনিস সব দান করুন, শেখান ইত্যাদি ইত্যাদি। তাকি হয় নাকি?… এই পাড়ায় তিন পুরুষের বাস কি ভাঙতে পারি! পারবো না! কারণ ভগবান যে শাস্তি দিয়েছেন মাথা পেতে নিয়েছি। কিছু তো লুকোইনি। মানা (পালিত পুত্র প্রণব) জানে যে তার জীবনে সে যখন অভিজাত পাড়ায় বাড়ি করবে তখন তার মা কোনোদিনও যাবে না। শেষ জীবনে কোথায় মরব জানি না, তবু এই পাড়ায় মরবার আশা রাখি”।
গ্রন্থতালিকা
১. চট্টোপাধ্যায়, আশীষ। অতীত দিনের স্মৃতি। আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৭৩।
২. পুরকায়স্থ, প্রার্থনা। “Outing Pleasure and Indulgence: Indubala’s Scrapbook and the Red-Light Dances of Calcutta।”ContemporaryTheatre Review, ২০২১।
৩. সোম, শোভন। দশটি টাকা আর একটি বাটি মাংস। আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯৯৯।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । বিশেষ প্রকাশ । ১৯ অক্টোবর ২০২৫