Jibansmriti Archive

জাংদোক পালরি

জাংদোক পালরি একটি তিব্বতি ধর্মীয় স্থাপত্য। না, কোন দুর্বোধ্য তিব্বতি বিষয়ের অবতারণা করছি না। আমাদের কাছাকাছি, বাঙালির চেনা চৌহদ্দির মধ্যেই অপরিচয়ের দূরত্ব নিয়ে অবস্থান করছে এমন একটি বিষয়ে কিছু কথা লিখতে বসেছি।

সাধারণত মন্দির, মসজিদ, গির্জা, মঠ ইত্যাদি ধর্মীয় স্থাপত্যের নাম থেকে আমরা তার পরিচয় সম্পর্কে একটা আন্দাজ পেয়ে থাকি। উপরের চারটি শব্দের প্রথম তিনটি শুধু উপাসনালয়, কিন্তু মঠ হল মূলত সাধকদের বাসস্থান, অবশ্যই সাধন ভজনের স্থান সহ। বাংলা অভিধানে মন্দির ও মঠের অর্থ একই বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মে অন্তত মন্দির শব্দের অর্থ মঠের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়ে মন্দির সহ সন্ন্যাসীদের আখড়া বোঝায়। দক্ষিণ ভারতে যদিও মন্দির সংলগ্ন সাধকদের বাসস্থান থাকেই এবং তারা সম্পূর্ণ স্থানটিকে দেবস্থানম নামে উল্লেখ করে। বাংলায় কিন্তু আমরা মন্দির বলতে বুঝি যেখানে দেবতার পুজো হয়। তেমনই গৌড়ীয় মঠ শব্দটা শুনলে আমরা বিশেষ একটি গোষ্ঠীর আখড়া এবং সংলগ্ন মন্দির বুঝি। মঠ মন্দির নিয়ে শুরুতেই এই যে শিবের গীত গাইছি তার কারণ হল একটি বিশেষ ধরনের তিব্বতি মঠ আজ আমার লেখার বিষয়।

থাংকায় জাংদোক পালরি

অন্যান্য ধর্মের মতো বৌদ্ধ ধর্মেও স্ব স্ব স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্য সহ সাবেক বিহার, স্তূপ ইত্যাদির সঙ্গে হিমালয় অঞ্চলের বজ্রযানী গোমপা, চোর্তেন ইত্যাদি ধর্মীয় স্থাপত্যের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। জাংদোক পালরি হল এমনই একটি বিশেষ বজ্রযানী স্থাপত্য যাকে আমরা সাধারণ বৌদ্ধ মঠ ভাবি, কিন্তু আসলে তা শুধু মঠ নয়, আরও বিশেষ কিছু। সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় জাংদোক পালরি একটি বৌদ্ধমঠ বিশেষ, কিন্তু সব বৌদ্ধমঠ জাংদোক পালরি নয়। ঠিক যেমন সব মঠেই মন্দির আছে কিন্তু সব মন্দির মঠ নয়।

গুরু পদ্মসম্ভব

জাংদোক পালরির শব্দগত অর্থ তাম্রপর্বত, কিন্তু ব্যঞ্জনা একেবারে ভিন্ন। এই তামা রঙের পর্বতের কিন্তু কোন ভৌগোলিক অস্তিত্ব নেই। এর উৎস তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে গুরু পদ্মসম্ভবের সঙ্গে জড়িত একটি কিংবদন্তী। সেই কিংবদন্তী বলে যে গুরু পদ্মসম্ভব তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত করে তাঁর বিশুদ্ধ ভূমি তাম্রপর্বতে চলে যান। তাম্রপর্বত মহাজাগতিক সমুদ্রে এক মণ্ডলাকৃতির দ্বীপ। সেখানে এক সহস্রদল পদ্মের উপর হীরকদ্যুতিময় ত্রিতল প্রাসাদে গুরু পদ্মসম্ভব সদা বিরাজ করেন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা সাধনায় সিদ্ধি পেলে সেই বিশুদ্ধ ভূমি লাভ করেন ও পদ্মসম্ভবের দর্শন পান; অতএব তাম্রপর্বত হল বজ্রযানীদের স্বর্গ। এই আধ্যাত্মিক ধারণাটিকে বৈকুণ্ঠের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা সহজ হবে।

গুরু রিনপোচে

সেই যে পদ্মসম্ভবের চির অবস্থানের অলৌকিক প্রাসাদ তার প্রতিরূপ হিসেবে নির্দিষ্ট একটি স্থাপত্যরীতির অনুসরণে মন্দির তৈরি করা হয় যাকে জাংদোক পালরি বলে। সে মন্দিরের প্রধান দেবতা অবশ্যই গুরু পদ্মসম্ভব। আরও বিস্তারে যাওয়ার আগে মনে হয় একটু বলা প্রয়োজন যে কে এই পদ্মসম্ভব।

শত সহস্র কিংবদন্তী জড়িয়ে থাকলেও পদ্মসম্ভব কিন্তু আদতে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি যার সময় কাল অষ্টম শতাব্দী। তিনি একজন ভারতীয় বৌদ্ধ যোগী ছিলেন এবং তিব্বতে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে তিব্বতিদের কাছে দ্বিতীয় বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর তিব্বতি নাম গুরু রিনপোচে যার অর্থ মূল্যবান। কথিত যে বুদ্ধের বাণী ছড়িয়ে দিতে তিনি তুষারাচ্ছন্ন হিমালয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পায়ে হেঁটে ঘুরেছিলেন, তাই তাঁর মূর্তির পায়ে তুষার-জুতো থাকে যা আর কোন বৌদ্ধ মূর্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তাঁর ঐতিহাসিকতার প্রমাণ হিসেবে বহু তথ্য আছে যার মধ্যে দুটির উল্লেখ করতে চাইব। গুরু রিনপোচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল তিনি পালি এবং সংস্কৃতে লেখা বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন। এই কাজে আরেক ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন তাঁর সঙ্গে – বৌদ্ধ দার্শনিক আচার্য শান্তরক্ষিত। তিনি রাজা থ্রিসোং দেৎসেনের রাজত্বকালে তিব্বতের প্রথম বৌদ্ধ মঠ সাম্যে গোমপা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দ্বারাই প্রতিষ্ঠা পায় তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের চারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন নিংমা সম্প্রদায়। নিংমা অর্থ প্রাচীন অর্থাৎ যারা প্রাচীনতম অনুবাদ থেকে পাওয়া শিক্ষা অনুসরণ করে। বলা হয় যে সেই অষ্টম শতাব্দীতে শুরু হওয়া নিংমা স্কুলের গুরুশিষ্য পরম্পরা আজও অটুট। এখানেই জানিয়ে রাখি যে জাংদোক পালরি মন্দির কিন্তু নিংমা সম্প্রদায়ই তৈরি করে।

জাংদোক পালরির প্রাথমিক ধারণা

এবার কিছু মিথ প্রসঙ্গে আসা যাক। তাঁর জন্ম এবং মৃত্যু দুই রহস্যে ঢাকা। সবচেয়ে প্রচলিত কিংবদন্তী মতে তিনি প্রাচীন ভারতের ওড্ডিয়ান রাজ্যের একটি হ্রদে ভেসে থাকা সহস্রদল পদ্মের ভিতর থেকে অষ্টম বর্ষীয় এক বালক রূপে আবির্ভূত হন। তাই তাঁর নাম পদ্মসম্ভব। এই অলৌকিক আবির্ভাবের সমান্তরাল আরও বহু কাহিনি আছে। কিন্তু এই ওড্ডিয়ান রাজ্যের কথা বারবার ফিরে আসে সব গল্পে। এই ‘ওড্ডিয়ান’ হয়ত ‘উদ্যান’ শব্দের অপভ্রংশ। ফা হিয়েনের ভারত ভ্রমণ বর্ণনায় উড্ডিয়ান ভ্রমণের কথা আছে যেখান থেকে তিনি গান্ধার যান। একদল গবেষকের অনুমান পদ্মসম্ভব বর্তমান পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকা অঞ্চলের মানুষ ছিলেন যেখানে তখন বৌদ্ধ ধর্মের যোগাচার ধারা প্রবল ছিল। তিব্বতে পঞ্চান্ন বছর কাটানোর পর তিনি অন্তর্হিত হন এবং তার পর থেকে তিনি মহিমময় বিশুদ্ধ ভূমি তাম্রপর্বতে অধিষ্ঠিত।

জাংদোক পালরির সম্প্রসারিত ধারণা

পদ্মসম্ভবের মূর্তিলক্ষণগুলি এতটাই বিশিষ্ট যে তাঁকে আলাদা করে চিনে নেওয়া খুব সহজ। তাঁর বিস্ফারিত চোখে রাগ কিন্তু মুখে বেশিরভাগ সময় হাসি থাকে। নাকের নীচে সরু গোঁফ ও থুতনিতে আজকের স্টাইল স্টেটমেন্টে যাকে গোটি বলে ঠিক তেমন দাড়ির আভাস। ডান হাতে বজ্র, কোলের উপর খোলা বাঁ হাতের তালুতে নরকপাল যার উপর অমৃত কলস রাখা। বাঁ কাঁধে হেলান দিয়ে রাখা থাকে খট্বাঙ্গ, যে বস্তুটি শৈব কাপালিকদের খট্বাঙ্গের তিব্বতি রূপ। মাথায় থাকে বিশেষ পদ্মটুপি যার শীর্ষে অর্ধ-বজ্র উষ্ণীষ। পায়ের তুষার-জুতোর কথা আগেই বলেছি।

জাংদোক পালরির মডেল

এবার জাংদোক পালরি প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এই তাম্রপর্বতের প্রাসাদের ধারণা বা বর্ণনার সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা রিনপোচের পূর্ণাঙ্গ জীবনী ‘জাংলিং-মা’ নামক পুঁথিতে। এরপর সময় যত এগিয়েছে মন্দির সহ তাম্রপর্বতের কল্পনা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে পুঁথি ও থাঙ্কায়। কিন্তু স্থাপত্যরীতি একই থেকেছে, যা সাধারণ বৌদ্ধ মন্দিরের থেকে বেশ আলাদা। তিনতলা মন্দির প্যাগোডা শৈলীতে ধাপে ধাপে ছোট হয়ে চূড়ায় পৌঁছবে। প্রতিটি তলায় খিলান সহ চারটি দরজা থাকবে। আর সব মিলিয়ে আটটি স্তম্ভ থাকবে। প্রথম তলে গুরু রিনপোচে, দ্বিতীয় তলে অবলোকিতেশ্বর এবং তৃতীয় তলে অমিতায়ুস থাকবেন। সম্পূর্ণ মন্দিরের উপর একটি রামধনু রঙের চক্র থাকবে। বৌদ্ধ শৈলীর নানা কারুকাজ, অলঙ্করণ সহ মন্দিরের বাইরেটা হবে নীল রঙের। ভিতরের দেওয়ালে দেওয়ালে পদ্মসম্ভবের বিভিন্ন রূপ ও কাহিনি চিত্রিত থাকবে। এই হল প্রাচীন পুঁথির নির্দেশ অনুযায়ী আদর্শ জাংদোক পালরি মন্দিরের নির্মাণশৈলী। সাধারণত একটা চার দরজাওয়ালা চৌকো সুবিশাল ধ্যানের ঘর বা ওই জাতীয় পরিসরের উপর মন্দিরের প্রধান তিনটে তলা তৈরি করা হয়। সেক্ষেত্রে দেখতে চারতলা লাগলেও আসলে নীচের তলাটা দ্বীপ হিসেবে ধরতে হবে তখন।

নামদ্রলিং মঠের জাংদোক পালরি মন্দির

একেবারে কপিবুক জাংদোক পালরি মন্দির দেখেছি একমাত্র কুশলনগরের নামদ্রোলিং বৌদ্ধমঠে। সে এক চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। তখন জানতাম ভারতে বুঝি এই একটিই এই ধরনের মন্দির আছে। সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে ‘সম্ভবত ভারতের একমাত্র’ এই বাক্যবন্ধ লিখেছিলাম। ভাগ্যিস ‘সম্ভবত’ কথাটা জুড়েছিলাম। কারণ আমার রাজ্যেই যে এদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাংদোক পালরি মন্দির আছে তা কুড়ি বছর আগের অদীক্ষিত চোখের দেখায় চিনতে পারিনি। বাঙালির কত কালের চেনা কালিংপঙের দুরপিন দাঁড়া বৌদ্ধমঠ আসলে একটি জাংদোক পালরি মন্দির। মূর্তি গড়ার সময় শিল্পীরা যেমন কিছু নির্দিষ্ট অপরিহার্য মূর্তি লক্ষণ বজায় রেখে বাকিগুলো অনুসরণ না করার স্বাধীনতা নিয়ে থাকেন, এখানেও তাই ঘটেছে। এর স্থাপত্য মিশ্রিত শৈলীর, সাধারণ গোমপার চৌকো ভবনের উপরে আরও দুটি প্রতীকী তল নির্মিত। আর অবশ্যই পদ্মসম্ভব মূল দেবতা, সঙ্গে নিংমা সম্প্রদায়ের প্রাচীন সিদ্ধাচার্যদের মূর্তিও বিরাজিত। খিলান সহ দরজা চারটিই, দেওয়ালে রিনপোচের আট রূপের ম্যুরাল। সবমিলিয়ে অনবদ্য মঠটি।

নামদ্রোলিঙের মন্দিরচূড়া

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *