– যে কোনো মেয়ের মন নিমেষে কেড়ে নেওয়ার মতো রূপবান ছিলে তুমি যুবক বয়সে, যে বয়সে তোমাকে আমি প্রথম দেখি।
– তোমার মেয়ে-মনটি তাহলে কাড়তে পারলাম না কেন বলতো?
– কী অপূর্ব গানের গলা ছিল তোমার।
– তাতেও তোমার মন ভোলাতে পারিনি।
– বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং সঙ্গীতশাস্ত্র বিষয়ে তোমার পড়াশোনা ছিল বিস্তর।
– তবুও তুমি আকৃষ্ট হওনি এই অধমের প্রতি।
– অল্প বয়সেই তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেছিলে এবং বিজ্ঞান ব্যতীত সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, দেশোন্নয়ন, এবং শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তুমি নিয়মিত লেখালেখি করতে।
– তোমার মন গলাতে পারিনি তাতেও।
– তুমি ভেবেছিলে, বড় কঠিন ধাতুতে গড়া আমার মন।
– ঠিক বলেছ। কত কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন তা কি তোমার জানা আছে?
– জানি। গভীর মনোকষ্ট ভুলতে তুমি তোমার প্রতি প্রেমে বিভোর বয়সে অনেক ছোট তোমার এক ছাত্রীকে বিয়ে করে ফেলেছিলে। আমাকে জানিয়েছিলে সে খবর।
– মনে আছে তাহলে? তিন দশক পরেও? তবে শোনো তার পরের কথা। শত চেষ্টা করেও পাষান হৃদয়ের সেই মেয়েকে আমি আজও ভুলতে পারিনি।
– এটাই যে আমি চেয়েছিলাম, হুমায়ুন। তুমি জান না, প্রথম দিনেই আমি তোমার চোখে আমার সর্বনাশ দেখেছিলাম। বিশ্বকবি-কথিত ‘সর্বনাশ’! কিন্তু তোমাকে বুঝতে দিইনি কিছুই।
– কী বলছ তুমি, মোহর? কেন বলোনি তুমি? জীবনভর তুমি আমাকে এত কষ্ট দিলে? দিতে পারলে?
– পারলাম। পারলাম বলেই আজকের তোমাকে পেলাম আমি। পেয়েছি তোমাকে সারাজীবনে আমার। তোমাকে আমি হারাইনি। হারাবার কষ্ট আমাকে পেতে হয়নি !
– তুমি কী বলছ এসব?
– তুমি বুঝবে না। পুরুষমানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। পুরুষ-হৃদয় ধায় না-পাওয়া প্রাণের দিকে হরিণের বেগে। তারপর পাওয়া হয়ে গেলে চাওয়াও উবে যায় কর্পূরের মতো।
– ঠিক নয়। ঠিক নয় একটুও তোমার এই কথা, মোহর। তাই যদি হত তাহলে তোমাকে আজও আমি আকুল প্রাণে চাই কেন বল?
– কাছে পাওনি বলে।
– মিথ্যা। মিথ্যা। মিথ্যা।
– সত্য। সত্য। সত্য। তোমার আমার প্রেম অনন্তকালের জন্য সত্য হয়েছে, হুমায়ুন।
– কীভাবে?
– তোমার বিয়ের খবর জানার বেশ কয়েক বছর পর আমিও আপনজনদের পছন্দ করা একজনকে বিয়ে করে ফেলি সামাজিক চাপের কারণেই। আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় একজন মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে না করে বেঁচে থাকার অনুমোদন পায় না। পদে পদে তাকে ঠোক্কর খেতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
– তারপর? তুমি সুখী হয়েছ, মোহর?
– সেকথা বলব বলেই আজ তোমার মুখোমুখি হয়েছি। তোমার কাতর মিনতি সত্ত্বেও আগে তা ঘটাতে পারিনি।
– বল তাহলে, শুনি।
– প্রথম দিন থেকেই ঊষর মরুভূমির জীবন কাটিয়ে চলেছি আমি বিয়ের পর, হুমায়ুন। সে ঊষরতা সহনীয় করে তুলি কীভাবে জান? তুমি যত মধুর শব্দ ব্যবহার করে আমাকে ডাকতে সেগুলি নিয়ে আজও মনে মনে খেলা করি। সেভাবে রোজ দিনের কেজো কথাবার্তার মাঝে বন্দি হয়ে থাকা মনের মুক্তি খুঁজি।
– কেন? তোমাকে আর কেউ আদর করে মধুর স্বরে ডাকে না? ডাকেনি কোনোদিন?
– না। ডাকার মানুষটি সেসব বোঝে না। নিতান্তই অন্তর্মুখী কথাহারা মানুষ সেই ব্যক্তিটি। ভালোবাসার কোনো প্রকাশ তার মধ্যে ঘটে না। অদ্ভুত স্বভাবের একজন।
– তোমার খুব কষ্ট হয়, না মোহর?
– না। প্রথম প্রথম হত। এখন আর হয় না। ওকে বুঝতে সময় লেগেছে। তারপর বোঝার পর মেনে নিয়েছি। বরং ওর জন্য আমার কষ্ট হয়। মন খুলতে পারে না পৃথিবীর কোনো মানুষের কাছে এমন একজন ব্যক্তি ও। আমার তো তা নয়। কত মানুষ রয়েছে আশে-পাশে আমার। তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারাও আমার কাছে নিজেদের মনকে মেলে ধরে। আর আমার নিভৃত অন্তরে রয়েছে একজন। সে এখন দখল করে নেয় আমাকে। বলে, কাছে এসো। আরও, আরও কাছে। একেবারে বুকের মাঝখানটিতে।
– মোহর, মোহর, তুমি জান না অমূল্য মোহরের মতো আমার বুকের সিন্দুকে আমি আজও লুকিয়ে রেখেছি তোমাকে। সেখান থেকে তাকে কেউ নিয়ে নিতে পারবে না।
– আমার কাছে থাকা মানুষটি এমন করে কথা বলা দূরে থাক, ভাবতেও পারে না। আচ্ছা বল তো হোমার, ( অবাক হচ্ছ? আমি তোমাকে মনে মনে এই নামেই ডেকেছি। তুমি শোননি, কেন না মুখে কখনও বলিনি।) তুমি আমার জীবনে এলে পালটে যেতে না? ভুলে যেতে না ভালোবাসার ভাষা? সত্যি বল।
– আমার ভালোবাসা আজও ফুরায়নি। কখনও ফুরাবার নয়। কেন তুমি বোঝ না, মোহর?
– জান হোমার, আমার মেয়েকে তোমার কথা বলেছি সব। সে কি বলে জান? বলে, আমি ভুল করেছিলাম। প্রশ্ন করে- কি পেলে জীবনে তারপর? ভালোবাসা পেলে?
– তুমি কি উত্তর দিয়েছ তোমার মেয়েকে? ভুল হল, তোমার মেয়ে নয়। ও তো আমারও মেয়ে।
ওরা আজকালকার মেয়ে। সোজাসাপটা বোঝে, কথা বলে। আমার মেয়ে, আবার, মনে হয় কিছুটা ওর জন্মদাতার মতো। অন্তত বাইরে তেমন প্রকাশ করে না মনের আবেগ। ওর কথা শুনে হাসি। কিছু বলিনি। প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমার এই প্রয়াসের কথা শুনলে ও হয়ত হাসত। হয়ত বলত- এত কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয়? তাই ওর প্রশ্ন শুনে নিরুত্তর থেকেছি।
– তুমি বহুদিন ধরে লেখালেখি করছো এবং জানতে পেরেছি বেশ খ্যাতি হয়েছে তোমার। সেদিক থেকে ভালো আছো, বল?
– আছি। হোমার, খ্যাতি নিয়ে মানুষ বাঁচে না। বাঁচার জন্য চাই ভালোবাসা- সীমাহীন ভালোবাসা। আমি তা পেয়েছি এবং তাই বেঁচে আছি। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরেই আজ আমার বেঁচে থাকা। মরুভূমির পথ চলাকে সহনীয় করে তোলা।
– আমি জানতাম, তুমি একদিন নাম করবে। তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। আজ তা সত্যি হয়েছে। আমি যে তাতে কী সুখী ! কেবল কষ্ট পাই কি ভেবে জান? এই তুমি আমার হলে না ! তোমার কাছে থাকা মানুষটির ভাগ্যের কথা ভেবে হিংসে হয়।
– সেই মানুষটি সর্বক্ষণ বই মুখে নিয়ে সময় কাটায়। বউ নয়, বই-ই তার প্রকৃত সঙ্গী। কিন্তু অবাক কাণ্ড কি জান? আমার কোনো লেখা অথবা বই সে ভুলেও পড়ে না।
– সত্যি?
– সত্যি। তুমিও কাছে থাকলে তা-ই করতে মশাই ! আর তাই তো আমি তোমাকে কাছের হতে দিইনি।
– ভুল। ভুল। ভুল। ভুল করেছিলে, মোহর।
– তুমি দেখি, আমার মেয়ের মতো কথা বললে।
– ও তো আমারও মেয়ে। তাই একরকম কথা বলেছি আমরা। বুঝলে হে, মেয়ের মা?
– কোনো কোনো প্রেমহীন কান্নামুখর রাত কাটাতে কাটাতে শুনতে পেয়েছি তোমার আকুল স্বর – ‘ আমার কেবল একটাই ভাবনা জান? যদি তোমাকে আমি সুখী করতে না পারি? কথা দাও মোহর, চলে যাবে না তো আমাকে ফেলে? ‘
– তুমি সুখ পাওনি, মোহর? এ কি ! তুমি কাঁদছ?
– কেউ জানে না, হোমার। ভেবেছিলাম তোমাকেও বলব না। বলার মতো কথাও নয়।
– আমাকেও বলবে না? এই তোমার ভালোবাসা যা নাকি এতকাল ধরে বাঁচিয়ে রেখেছ? আর বাঁচিয়ে রাখবে বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে?
– আমি বেঁচে আছি হোমার, আর সেই সঙ্গে বাঁচিয়ে রেখেছি – তোমার-আমার প্রেমকে। আর আছে এই কথার কোলাজ।
হোক না তা কাল্পনিক !
মীরাতুন নাহার-এর জন্ম উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বৌলগাছি গ্রামে ১লা এপ্রিল, ১৯৪৯ সালে নানার বাড়িতে। ১৯৬৯ সালে কলকাতা লেডি ব্রেবোর্ণ কলেজের দর্শনশাস্ত্রের সাম্মানিক স্নাতক। ১৯৭১ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৯০ সালে পি.এইচ.ডি. উপাধি লাভ করেন। ১৯৭৫-২০০৯ পর্যন্ত তিনি কলকাতার ভিক্টোরিয়া কলেজে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপনা শেষে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে পত্রিকা (দোলন চাঁপা) সম্পাদনা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণমূলক সংগঠনে বিভিন্ন পদের দায়-দায়িত্ব পালন সহ রেডিও-টেলিভিশন-সেমিনার-কনফারেন্স প্রভৃতিতে নিয়মিত অতিথি ও বক্তার ভূমিকা গ্রহণে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিরন্তর লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটে তাঁর। বিবিধ বিষয়ে তিনি বহু বছর ধরে নিয়মিত গ্রন্থ রচনার কাজেও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পারিবারিক জীবনে তিনি এক কৃতী কন্যাসন্তানের জননী এবং তাঁর জীবনসঙ্গী সদ্য প্রয়াত একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
ওনাকে প্রথম চিনি সুশীল সমাজের মিছিলে।
তারপর থেকেই ওনার বক্তব্যে নজর রেখেছি । মৃদু স্বরে স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের বিশ্বাসকে উনি যে দৃঢ়তায় ব্যক্ত করেন তা আমাকে আকর্ষণ করে। এই অন্ধকারে কিছুটা হলেও আলোর খোঁজ পাই।
পাশে থাকবেন। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।