
অরিন্দম সাহা সরদার নির্মিত ‘মক্সা মানব’ একটি প্রত্যক্ষদর্শী স্মৃতি, ভূগোল, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মানবিকতার সংমিশ্রণে নির্মিত এক সংবেদনশীল সাক্ষীচিত্র। মাত্র বারো মিনিটের পরিসরে চলচ্চিত্রটি ডাঃ বিকাশকুমার চন্দ্রের জীবনযাত্রা, তাঁর উত্তরণের পথ, চিকিৎসা-বোধ ও সমাজচিন্তাকে এমনভাবে সংকলিত করে যে এটি শুধু একজন চিকিৎসকের জীবনলেখা নয়—বরং ভারতের মক্সা চিকিৎসার ইতিহাসে এক মানবতাবাদী আন্দোলনের নথি।
চলচ্চিত্রের নাম ‘মক্সা মানব’ নিজেই এই সাক্ষীচিত্রের কেন্দ্রীয় ভাবধারার সংকেত। ‘মক্সা’ শব্দটি একটি প্রাচীন পূর্ব এশীয় চিকিৎসাপদ্ধতিতে মক্সিবাসন থেকে আসে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি এমনি এক প্রক্রিয়া যেখানে তাপ, ঘ্রাণ ও ঔষধি উদ্ভিদ মিলেমিশে দেহকে মুক্তি দেয় ব্যথা ও অস্থিরতা থেকে। এই মক্সা-চর্চার মাধ্যমে যে মানুষ নিজেকে এবং অপরকে আরোগ্যের পথে পৌঁছে দেয়, তাকেই এই ছবিতে ‘মানব’ বলা হয়েছে—একজন এমন মানুষ যিনি চিকিৎসাকে পেশা নয়, বরং মানসিক দায়বদ্ধতার এক দৃষ্টান্তে পরিণত করেছিলেন। নামটি তাই দ্ব্যর্থক ও গভীর: চিকিৎসকের মানবিকতা তাঁকে ‘মক্সা’র মানবতর রূপে পরিণত করেছে, আর তাঁর মক্সা-চর্চাই তাঁকে মানুষের আরও কাছে নিয়ে গেছে।
ডাঃ বিকাশকুমার চন্দ্র ছিলেন এমনই এক বিরল ব্যক্তিত্ব—১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদের মালিহাটিতে জন্ম, কিন্তু কর্মজীবন কেটেছে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়িতে। কৈশোরে লেনিন, মার্ক্স, মাও—এই বিপ্লবী চিন্তাবিদদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর চিকিৎসা-চেতনার ভিতরেই গড়ে ওঠে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আদর্শ। প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতির বাইরে গিয়ে তিনি আগ্রহী হন আকুপাংচার ও মক্সিবাসনে। হিমালয়ে পাওয়া মক্সা গাছের একটি প্রজাতি তিনি স্থানীয়দের সাহায্যে সংগ্রহ করেন, নিজেই তা প্রস্তুত করেন এবং অসংখ্য রোগীর মধ্যে তার প্রয়োগ করেন। চিকিৎসার প্রতি তাঁর নিবেদন, সততা, এবং রোগীর প্রতি নিঃশর্ত দায়বদ্ধতা তাঁকে ‘ফাদার অফ ইন্ডিয়ান মক্সা’ উপাধি এনে দিয়েছে লোকমুখে । আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর গুরুত্ব এই জায়গায় যে চিকিৎসা যখন ক্রমশ খরচসাপেক্ষ হয়ে উঠেছে , তখন ডাঃ চন্দ্রের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানবিক চিকিৎসার মূলভিত্তি—দায়িত্ব, নৈতিকতা এবং রোগীর সঙ্গে আন্তরিক সংলাপ।
চলচ্চিত্রের সাউন্ডস্কেপে উৎসব মণ্ডলের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এই মানবিক অনুসন্ধানকে ভিজ্যুয়াল এবং আবেগের দিকে আরও গভীর করে তোলে। শুরুতে পাহাড়ি সুর, বাঁশির নরম অনুরণন এবং percussion-এর ছন্দ—এই সংমিশ্রণ একদিকে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের পরিবেশ তুলে ধরে, অন্যদিকে ডাঃ চন্দ্রের চিকিৎসাজীবনের ভূগোলগত প্রেক্ষাপটকে মিউজিকের মাধ্যমে অনুভবযোগ্য করে তোলে। যেন তাঁর জীবন ও কাজের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের প্রকৃতিই একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। যখন ক্যামেরা মক্সা পাতাগুলোর দিকে ফোকাস করে, তখন উৎসবের গিটারের তাল-ছন্দ চিকিৎসকের আবিষ্কারধ্যান ও পদ্ধতিগত নিখুঁততা তুলে ধরে—পাতার স্পর্শ, গন্ধ, টেক্সচার যেন ঐ সুরের সঙ্গে মিশে শরীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে। গিটার এখানে কেবল একটি সঙ্গীতযন্ত্র নয়—একটি লিরিক্যাল ইঙ্গিত যে ডাঃ চন্দ্রের গবেষণা ছিল গভীর, মনোযোগী এবং ছন্দবদ্ধ।
চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল ভাষাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। দার্জিলিংয়ের তিনধারিয়া অঞ্চলের সবুজ পাহাড়, আকাশের খোলামেলা স্বচ্ছতা, জঙ্গল-ঢাকা ঢাল—এই সবই মক্সা উদ্ভিদের উৎসভূমিকে প্রেক্ষিত দেয়। যেন প্রকৃতিও এই চিকিৎসকের নীরব সহযোগী। সাক্ষীচিত্রের শুরুতে সাদা-কালো ফ্রেমে ক্রেডিট এবং পাহাড়ি পথ ধরে একটি গাড়ির অগ্রসর হওয়া—এই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ইনট্রো দর্শককে সময়ের ধারাবাহিকতা অনুভব করায়; অতীতের স্মৃতি, পরিশ্রম, সংগ্রাম—সবই এই মনোক্রোম রঙে আবৃত। যখন চলচ্চিত্র রঙিন হয়ে ওঠে, তখন তা ইঙ্গিত দেয় বর্তমানের উজ্জ্বলতায় ফিরে আসা—যে যাত্রা অতীতের স্মৃতিতে বোনা হলেও রঙিন হয়ে ওঠে তাঁর অর্জন ও মানবিকতায়।
চলচ্চিত্রের সাক্ষাৎকার অংশে ডাঃ চন্দ্রের পরিবারের সদস্য—স্ত্রী অঞ্জলি চন্দ্র ও কন্যা সুলগ্না চন্দ্র, সহকর্মী ডাঃ ভবানীপ্রসাদ সাহু ও ডাঃ পিনাকী চক্রবর্তী, রোগী অশোক আগরওয়ালা এবং হিমালয়ান মক্সিবাসন প্রজেক্টের মিকমা লামা ও রূপক মজুমদার—এই সবাই মিলে একটি সমান্তরাল ইতিহাস রচনা করেন। তাঁদের স্মৃতিকথন প্রকাশ করে যে ডাঃ চন্দ্র ছিলেন একজন সৎ চিকিৎসক, কর্মীদের ন্যায্য পারিশ্রমিকে বিশ্বাসী নেতা, এবং একজন নিবেদিত পরিবার-মানুষ। এই বহুমাত্রিক চিত্র তাকে কেবল ‘মক্সা মানব’ হিসাবে নয়, বরং এক সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করে।
উপসংহার
‘মক্সা মানব’ একটি ক্ষুদ্র সময়সীমার মধ্যেও একটি বিরল জীবনের গভীরতা ধরতে সক্ষম হয়েছে। অরিন্দম সাহা সরদারের গঠন, ফ্রেমিং, শব্দ-রং-গতি—সব মিলিয়ে এটি কেবল একটি ডকুমেন্টারি নয়; এটি এক মানবিক আন্দোলনের রূপকথা। ডাঃ বিকাশকুমার চন্দ্রের জীবন আমাদের স্মরণ করায়—চিকিৎসা শুধু বিজ্ঞান নয়, এটি স্নেহ, সততা এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক অখণ্ড প্রতিশ্রুতি। তাঁর মক্সা-স্পর্শ শুধু চিকিৎসায় নয়, মানবতাকেও উষ্ণ করে; এবং এই চলচ্চিত্র সেই উষ্ণতারই ধারাবাহিক সাক্ষ্য।

সাক্ষীচিত্রের লিংক: https://youtu.be/H0uvpUCEUiE
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । বিশেষ প্রকাশ । ২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ২০২৫