Jibansmriti Archive

সাক্ষীচিত্রের স্থিরচিত্র – ১

‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’ (উত্তরপাড়া) নির্মিত ‘যদি সত্যি কথা বলো’ শীর্ষক সাক্ষীচিত্রটি দেখার সৌভাগ্য লাভ করে মুগ্ধচিত্ততা নিয়ে মনে হল— এটি এই সময়কালের জন্য বিরলতম উপহার, যেটি পাওয়া সম্ভব হল জীবনস্মৃতি আর্কাইভের কর্ণধার, নিরন্তর সৃজনশীল কর্মসাধনায় নিমগ্ন অরিন্দম সাহা সরদারের গবেষণা, সম্পাদনা ও পরিচালনায়। যে কোনো গবেষণা-প্রেমিক মনের ভাবনার ভুবনে আলোড়ন তুলে দেওয়ার মতো সম্পদ এই সাক্ষীচিত্রে ভরে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান রচনায় সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করার প্রয়াস গৃহীত হয়েছে মাত্র— সামর্থ্য সম্পর্কে সংশয় থাকা সত্ত্বেও।

পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্যকে লেখা অন্নপূর্ণা দেবী-র চিঠির একটি অংশ । সাক্ষীচিত্রের স্থিরচিত্র – ২

আমার সংশয়

পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, যাঁর আসল নাম যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, একজন অকৃত্রিম সঙ্গীত সাধক ব্যাক্তিত্ব এবং তিনি আপন প্রতিভাবলে সরোদ নামক যন্ত্রবাদনে যে মৌলিকতা ও নতুন নতুন আবিষ্কার করার নমুনা বা দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অভাবনীয়— এক কথায় বিস্ময়কর। আলোচ্য তথ্যচিত্রটি দেখে সেসব জানতে পেরেছি। জানার আনন্দে আপ্লুত হয়েছি। কিন্তু পরম স্নেহভাজন অরিন্দমের কাছ থেকে আহ্বান পেয়ে তীব্র সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল মন—আমি কী এ বিষয়ে লেখার অধিকারী!

অতঃপর তর্ক-বিতর্ক চলল মনের অন্দরে। চলতেই থাকল। অবশেষে সেসবের অবসান ঘটল। অধিকারবোধ মাথা তুলল। বলল— অধিকার আছে। ভাবতে বসে শেষ পর্যন্ত সংশয় দূর করে অধিকারকে বুঝে নিতে পারলাম। নিজে সঙ্গীত চর্চার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলেও পরিবারের (পরিণয়-পূর্ব এবং পরবর্তী জীবনে) সংগীতময় পরিমণ্ডলে শৈশব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময় কাটানো এবং সংগীতকে হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ পাওয়া নামক সৌভাগ্য কম মানুষই লাভ করে। আমার বাবা যৌবনে এস্রাজ শিখেছিলেন। আমার বাবার দুর্লভ সংগ্রহে ছিল মাইকবিহীন অতি শোভনসুন্দর কাঠ দ্বারা নির্মিত একটি গ্রামোফোন এবং সেকালের প্রায় সকল নামী দামী শিল্পীদের গাওয়া সঙ্গীতের রেকর্ড-সম্ভার। সেসবের মধ্যে উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ-র বেহালা-বাদনের একটি রেকর্ডও ছিল। আমি শুনেছি বহুবার কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর এই প্রতিভা নিয়ে আলোচনা আমি অন্তত শুনতে পাইনি। আমার অগ্রজ, প্রবাদপ্রতিম লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কপি-গায়ক হয়ে উঠেছিলেন এবং কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গে থেকে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন লোকগীতির গায়ক হিসেবে। বিবাহসূত্রে আমার জীবনসঙ্গী মানুষটি বাহাদুর খাঁ-র শিষ্য হিসেবে প্রতিদিন প্রায় সারারাত জেগে সরোদ বাজিয়েছেন কিন্তু যৌবন বয়স থেকে জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত এবং কখনও কাউকে শোনানোর তাগিদে তাড়িত হননি। আপন আনন্দে বিভোর থেকেই এই সংগীতময়তা জীবনে বাস্তবায়িত করেছিলেন তিনি। মাত্র কিছুদিন আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন।

আট কানের সরোদ বাদ্যযন্ত্র কোলে আফসার আলি ও পাশে মীরাতুন নাহার

আক্ষেপ দেখা দিল অন্তরে—মিতবাক, বাস্তবজীবনবোধহীন মানুষটির কাছে যতীন ভট্টাচার্যের নাম শুনিনি। আজ বেঁচে থাকলে তাঁর কাছে জানতে চাইলে নিশ্চয়ই জানতে পারতাম এই সরোদ-সাধক মানুষটির কথা। আমাদের একমাত্র কন্যাসন্তান নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী গ্র্যান্ড পিয়ানো বাজাতে শিখেছে। এত সব কথা মনের মধ্যে দামামা বাজানো শুরু করাতে অধিকারবোধ জাগলো মনে। অতঃপর কলম তুলে নিতে হল হাতে।

পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য । সাক্ষীচিত্রের স্থিরচিত্র – ৩

সাক্ষীচিত্র বার্তা

এই তথ্যচিত্রটি মূলত দুটি বার্তাই দেয়—গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। সেই সঙ্গে বহু মূল্যবান অজ্ঞাত তথ্যজ্ঞাপকও এই সৃজনকর্মটি। বিস্তৃত এই শিল্পকর্মটি দুটি প্রধান ভাগে পরিবেশিত হয়েছে সেকারণেই। প্রথমাংশে পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য যে কেবল সঙ্গীতশিল্পী মাত্র নন, একজন প্রকৃত সঙ্গীতপ্রতিভা সে সত্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাঁর সন্তান ও অন্যান্য আত্মজনদের মন্তব্যের মাধ্যমে। তাঁর পুত্র পণ্ডিত অমিত ভট্টাচার্যের ভূমিকা সেক্ষেত্রে অন্যতম।

পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য-এর পুত্র নাদ সাধক পণ্ডিত অমিত ভট্টাচার্য স্থিরচিত্র – ৪

বেদান্তবাগীশ দীননাথ দেবশর্মা ও বিনোদিনী দেবীর পুত্র পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য (১৯২৬-২০১৬) নানাভাবে প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন যে, তিনি উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং তাঁর কন্যা, বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব অন্নপূর্ণা দেবীর শিষ্যত্ব বরণ করে নিয়ে নিজের বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সম্পূর্ণ কানাড়া রাগ তৈরি ও ব্যবহার, সরোদের আট কানের বদলে নয়টি কান, নারকেলের মালার জবার বদলে মহিষের শিং দিয়ে নির্মিত জবা বা নকল নখের ব্যবহার প্রভৃতি নব নব আবিষ্কার-ভাবনা তাঁর শিল্পী সত্তা নয়, প্রতিভা সত্তার পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।

উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-এর মতো নয়টি কানের সরোদ তিনি আজীবন বাজিয়েছেন স্থিরচিত্র – ৫
মহিষের শিং দিয়ে নির্মিত জবা । স্থিরচিত্র – ৬

তিনি ১৯৪৯ সালে বাবা আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সেনিয়া বীণকার রবাবীয়া ঘরানার সাধক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হন। বাবা তাঁর ইমন বাজানো শুনে মন্তব্য করেছিলেন প্রথম সাক্ষাতেই—এর মাথা আছে। শিক্ষা নেই। তারপরই তাঁকে শিষ্যত্বের স্বীকৃতি দেন। টানা ৭ বছর ধরে তিনি সরোদ সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। সারা ভারত ভ্রমণ করে অনুষ্ঠান করেছেন। জন্ম বেনারসে। সেখানেই কেটেছে অধিকাংশ সময়। উচ্চ শিক্ষাও লাভ করেন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রমী সঙ্গীত-প্রতিভা। তিনি সরোদ-বাদনে পাখোয়াজ ব্যবহারেও অভিনবত্ব ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। হৈমন্তী নামক নতুন রাগ ও তাল ব্যবহারেও তিনি পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছিলেন। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বাস্তব সত্যটি হল, উস্তাদ বাবা ও তাঁর সুযোগ্য কন্যার শিষ্যত্ব মেনে তিনি সরোদ-বাদনকে মন্ত্র সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সাক্ষীচিত্রের প্রথম বিভাগে এভাবে তাঁর অভিনব অবদানের কথা সঙ্গীত জগতের বিভিন্ন গুণীজনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। তবে তাঁরা সকলেই অনুরাগী ভক্তমহলের বাসিন্দা হলেও তথাকথিত অতিখ্যাত সঙ্গীত জগতের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পান নি সেভাবে এবং তাঁরা তা চানও নি।

সাক্ষীচিত্রের স্থিরচিত্র – ৭

সাক্ষীচিত্রের দ্বিতীয়ার্ধে পরিবেশিত বাস্তব তথ্যাদি হৃদয়বিদারক এবং একই সঙ্গে অবিশ্বাস্য। পণ্ডিত হিসেবে সঙ্গীতমহলে স্বীকৃতি পাওয়া মানুষটি রেডিও, দূরদর্শন, রেকর্ড তৈরি, ভারত জুড়ে অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করতে পারলেও ঈর্ষাপরায়ণ, সাধনা বর্জিত সামান্য চর্চায় খ্যাতি অর্জনকামীদের চক্ষুশূল হলেন তিনি। তিনি সাধনাকে অর্থ রোজগারের পেশায় পরিণত করতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী দীপালি ভট্টাচার্যের মুখে শোনা গেল পরিবারে অসহনীয় অর্থাভাবের কথা এবং এমন তথ্যও জানা গেল যে, সাধক মানুষটির সেদিকে কোনো হুঁশ থাকত না কখনও। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণত বাস্তববোধ বর্জিত মানুষ।

পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য-এর স্ত্রী দীপালি ভট্টাচার্য । সাক্ষীচিত্রের স্থিরচিত্র – ৮

প্রখর সত্য হল, এমন বিপন্নতা তাঁকে কখনও বিচলিত করেনি। কিন্তু বিপদ ঘনীভূত হল অন্য দিক থেকে। তিনি সঙ্গীত-প্রতিভা হিসেবে যে মর্যাদা পেলেন সর্বত্র তা দেখে সাধনা থেকে দূরে থাকা সঙ্গীতশিল্পীরা প্রবল ঈর্ষাপরায়ণতা ও প্রচার এবং প্রতিষ্ঠাকামিতাবশত সরল প্রাণের মানুষটির প্রতি সর্বপ্রকার শত্রুতার সম্পর্কে লিপ্ত হলেন। এক এক করে সর্বক্ষেত্র থেকে তাঁর বিতাড়ন শুরু হয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করল। তিনি বিদ্বান ছিলেন। ভালো লিখতে পারতেন। লিখলেন- ‘উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও আমরা’ নামক গ্রন্থ। দুটি খণ্ডে। সততা ও সত্যনিষ্ঠা বশত বহু অপ্রিয় সত্য তিনি জানিয়ে দিলেন পাঠকমহলে। বৈরিতা তীব্র আকার ধারণ করল। পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য অভাবনীয় ধ্বংসের মুখোমুখি হতে বাধ্য হলেন। তারপরও তিনি বলতে পেরেছিলেন – যা ঘটবার তা ঘটবেই। কিছু করার নেই। সরল চিত্তের এই মানুষটি এভাবেই সহজভাবে কঠোর বাস্তব সত্যকে জীবনে মেনে নিতে পেরেছিলেন।

পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য । সাক্ষীচিত্রের স্থিরচিত্র – ৯

আমার আনন্দ

যদি সত্যি কথা বলো  – আমাকে অনির্বচনীয় আনন্দলাভে সহায়তা দিয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও আমি শৈশব থেকে খুঁজে ফেরা মনকে আজও হারাইনি। আমি খুঁজে ফিরেছি প্রতিভা ও মানুষের সমন্বিত রূপ মেলে যার মধ্যে সেই ব্যক্তিত্ব। না পাওয়ার হতাশা চূড়ান্ত। সামান্য কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাঁচিয়েছে আমাকে। হ্যাঁ, বাস্তবেই—ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়। কিন্তু সাহিত্য ও শিক্ষাজগতে মিলেছে তেমন মাত্র কয়েকজন। সঙ্গীতমহলে মেলেনি। কাজী নজরুল ইসলাম একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম সেক্ষেত্রে। অতঃপর পেলাম পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্যকে—জীবনস্মৃতি আর্কাইভের অবদান। তিনি ছিলেন যেমন অকল্পনীয় প্রতিভাধারী সঙ্গীত-ব্যক্তিত্ব এবং সেই সঙ্গে বাস্তববোধমুক্ত সরল-সহজ চিত্তধারী মানুষ। এই দুইয়ের মিলন খুব কম মানুষেই ঘটে। পন্ডিত যতীন ভট্টাচার্য তাই নিজের মধ্যে এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।

এই বাস্তব তথ্য আমার জন্য দুর্লভ বাস্তব সত্য এবং সেকারণে সেটি জেনে আমি গভীর আনন্দ লাভ করেছি।

উপসংহার

জীবনস্মৃতি আর্কাইভের কাছে সঙ্গীতানুরাগী মহলের প্রকৃত সঙ্গীত-প্রতিভার ভক্তদের ঋণ অপরিশোধনীয় হয়েই থাকবে। হারিয়ে যাওয়া দামী বস্তু ফিরে পেলে যেমন আনন্দ মেলে, হারিয়ে যাওয়া খাঁটি মানুষকে খুঁজে পেলে তার মূল্য সহস্র কোটি গুণ বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে আনন্দও। এইপ্রকার সৃজনকর্মে বহু গুণী ব্যক্তিত্ব সানন্দে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন উন্মুক্ত চিত্তে যাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো বেমানান মনে হয়। তবে আমার আরেকজন স্নেহভাজন (ফটোগ্রাফার) ঋষিতা সাহা সরদারকে ‘সাবাস’ না বললে যে অন্যায় ঘটবে সেটি না ঘটানোই সঙ্গত বলে মনে হয়!

সাক্ষীচিত্রের পোস্টার

সাক্ষীচিত্রের লিংক : https://youtu.be/0MjU8iBZvQ8

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫

One Response

  1. Panditjir shree chorone Amaar koti koti Pranam.

    Panditjir byapare kichu bola mane surjo ke aalo dekhano.
    Pt. Amit ji keo srehdha janai. Uni gharana ke egiye rakhchen.

    Pranam.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *