
বেশ অনেকটা সময় ধরে যে সামাজিক ও দার্শনিক অচলাবস্থা এবং অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে বারবারই মনে হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা–র একটি নতুন পাঠ হতে পারে চলচ্চিত্রের ভাষায়। সেই উপন্যাসেও বর্ণিত এক অবক্ষয়ের উপাখ্যান। আজকের সময়টা একটি সুদূর ইতিহাসের স্থান, কাল এবং সামাজিকতার আয়নায় এক নতুন বিন্যাসে প্রতিফলিত হতে পারে। সময়ের দূরত্বে ধূসর সেই মানুষজন হয়ত কিছুটা আলোকিত হবে এই সময়ের ক্ষীণ উদ্ভাসে। আজকের সমাজ নানা মেরুর দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভক্ত, এক জটিল বিন্যাসে বিস্তীর্ণ। এর মাঝে আধুনিক মননের এক চিকিৎসকের দোদুল্যমানতা বর্তমানের নানা সংকটের অনুষঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক সেটা বোঝার চেষ্টা করেছি এই চলচ্চিত্রের বয়ানে। শশী নিজের গ্রামীণ সমাজকে এক বিশেষ ভঙ্গীতে সংস্কার করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার ফল হয়েছিল বিপরীত। কোথায় আটকে পড়ল শশী? শশীর নিজের জীবনকে ঘিরে এক ধরনের রোমান্স আছে। কিন্তু সে এমন এক জগতে বাস করে, যে তার চারপাশের মানুষের সঙ্গে কোনও অর্থবহ সংলাপ গড়ে তুলতে পারে না। ক্রমাগত ঢুকে পড়ে নিজেরই তৈরি একটা ছোট পৃথিবীতে, যেখানে শুধু আত্মকথন সম্ভব। তাই শেষ পর্যন্ত যে যাপনকে শশী তাচ্ছিল্য করেছে চিরকাল সেই দেশজ জীবনধারার সঙ্গে এক অস্বচ্ছন্দ দ্বান্দিকতায় জড়িয়ে পড়ে, ‘সামাজিক সংস্কার’-এর সব প্রচেষ্টা তার ব্যর্থ হয়েছে।

হয়ে ওঠা:
এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে চেষ্টা করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি মাঝে মাঝে চিত্রনাট্যটি বার করে পড়েছি এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে বদলেছি। ছবিটি আদৌ নির্মিত হবে কি না জানা ছিল না, কিন্তু আমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে লোকেশন খুঁজে বেরিয়েছি। মনে মনে চিত্রকল্প বুনেছি।

যখন শেষ পর্যন্ত সমীরণ দাস এবং তাঁর ক্যালাইডোস্কোপ ছবিটি প্রযোজনা করতে এগিয়ে এলেন, তখন শিল্পী নির্বাচন ও দল গঠন করাটাও এক কঠিন কাজ ছিল। আমি এমন একটি দল চেয়েছিলাম যারা শুধু অভিনয় বা কারিগরি দক্ষতায় পারদর্শী নয়, বরং এই কাহিনির অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত ও সৌন্দর্যকে গভীরভাবে বুঝতে চেষ্টা করবেন। ছবির সময়কাল বুঝতে আমি সমকালীন সাহিত্য পড়তে শুরু করি – বিশেষ করে বিভূতিভূষণ এবং তারাশঙ্কর। এবং মানিকের অন্যান্য লেখাগুলি। এবং আমার সহশিল্পীদের কিছু বই পড়তে বলি, যাতে তাঁরা ঐ নির্দিষ্ট সময় ও স্থান সম্পর্কে একটি অনুভব গড়ে তুলতে পারেন। আমার চলচ্চিত্রের বিন্যাসে আমি মূলত শশীকে অনুসরণ করেছি। সে কোনও রূপান্তরের কর্তা নয়; বরং ভালোবাসা হোক বা সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ—সব কিছুতেই তার নিস্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা তাকে এক বিপর্যস্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। এই ছবির কাহিনী একটি সংকীর্ণ, রক্ষণশীল গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে আবর্তিত,তবুও এই ছবির নারীদের দৃঢ়তা এবং স্বাতন্ত্র্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিবাহিত কুসুম যেভাবে খোলামেলা শশীকে ভালোবাসা এবং যৌন আকর্ষণের কথা জানায় বা বিবাহের বাইরে সেনদিদির গর্ভবতী হওয়ার সাহস — দুইই পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতিস্পর্ধে দাঁড়ায়।

ছবি তৈরি হতে হতে ক্রমাগত চিত্রনাট্য বদলেছে, সম্পাদনার সময়েও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। তারপর ছবিটি এনএফডিসির একটি ‘ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস’ ল্যাবে নির্বাচিত হয়। সেই ল্যাবে যোগদানের পর আবার কিছু কাটাছেঁড়া হয়। এই করে ছবিটি শেষ করতে প্রায় তিন বছর লেগে গেল। তারপরে রটারড্যাম চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়ে ছবিটি আন্তর্জাতিক মুক্তি পায় এবং বহুল প্রশংসিত হয়। এবারে দেশে মুক্তি, মানুষের নিদানের অপেক্ষায় আছি।

পরিচালকের কথা – ভিডিও লিংক : https://youtu.be/SckSe_LW0d4
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫