শাপমোচন (১৯৫৫) এবং ইন্দ্রাণী (১৯৫৮) – এই দুটি বাংলা চলচ্চিত্রে হিন্দি ভাষার গান ব্যবহারের দৃষ্টান্ত বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। উভয় ক্ষেত্রেই গানগুলির ভাষা হিন্দি হলেও তাদের সংগীতের কাঠামো, শৈল্পিক অভিব্যক্তি এবং চলচ্চিত্রীয় প্রয়োগ এতটাই ভিন্ন যে, শুধুমাত্র কালক্রমে আগে আসার কারণে শাপমোচনের গানটিকে “ফিল্মি গান” হিসাবে গণ্য করা যায় না। বরং এটি একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, এক বিশেষ ঐতিহ্যবাহী সংগীতপ্রবাহের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলচ্চিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে ইন্দ্রাণীর গানটি স্পষ্টতই জনপ্রিয় চলচ্চিত্রসংগীতের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যা কাহিনীর অগ্রগতি এবং চরিত্রের আবেগপ্রকাশের কেন্দ্রীয় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
শাপমোচনের “কালিয়া সঙ্গ্ করত রঙ রালিয়া” আসলে রাগ বসন্ত বা বসন্ত–বাহার ধারার একটি ছোটা-খেয়াল, যা পণ্ডিত ডি.ভি. পালুস্কারের কণ্ঠে রূপ পেয়েছে। এই গানটি কেবলমাত্র একটি গীতরূপ নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় পরিবেশনার উদাহরণ, যা চলচ্চিত্রে diegetic অর্থাৎ চরিত্রের পরিবেশনার অংশ হিসেবে উপস্থিত। গানটির তালচক্র প্রধানত ত্রিতাল (১৬ মাত্রার), যেখানে সম এবং খালি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয় এবং প্রতিটি আবরতনের মধ্যে গায়কের অলংকারিক নিপুণতা ফুটে ওঠে। খেয়ালের স্বভাব অনুযায়ী এখানে স্থায়ী ও অন্তরা—দুটি অংশের উপস্থিতি রয়েছে, যার ভেতরে পালুস্কারের স্বতঃস্ফূর্ত আলাপ, বোল – আলাপ এবং তান পরিবেশন গানের গঠনকে রূপ দেয়। কণ্ঠস্বরের ভরাট উচ্চারণ, মাইক্রোটোনাল গমক ও মীড়, এবং খেয়ালের স্বরবিন্যাস এই গানকে একেবারে কনসার্ট-জাত অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করে।
এর বিপরীতে, ইন্দ্রাণীর “সব কুচ লুটাকর” মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে গাওয়া একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্মি কম্পোজিশন। এটি রাগনির্ভর নয় বরং পপুলার টিউনের ধাঁচে গঠিত, যেখানে সুরকারের উদ্দেশ্য ছিল গানের প্রতিটি অংশকে সহজে মনে রাখার মতো এবং আবেগঘন করা। গানটির তাল কাঠামো এখানে আরাধ্য ত্রিতাল নয়; বরং আধুনিক ফিল্মি গানে প্রচলিত দাদরা (৬ মাত্রা) এবং কাহারবা (৮ মাত্রা)-জাত রিদমিক প্যাটার্ন ব্যবহার হয়েছে, যা শ্রোতার কানে সঙ্গে সঙ্গেই পরিচিত লাগে। অর্কেস্ট্রেশনে ব্যবহার করা হয়েছে পশ্চিমী তারবাদ্য, বাঁশি, ট্রাম্পেট এবং স্ট্রিং সেকশন, যা গানের আবহকে নাটকীয় ও জনপ্রিয় ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে। এখানে স্থায়ী-অন্তরা বিভাজন নেই; বরং মুখড়া ও অন্তরার পুনরাবৃত্তি, রিফ্রেন এবং হুক-লাইন পুরো গানকে দর্শকের মনে গেঁথে দেয়। রফির গলায় একাধারে কোমলতা ও তীব্র আবেগময়তা, যা মাইক্রোফোনিক প্রসেসিং ও স্টুডিও রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে আরও উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এর ফলে এই গানটি সরাসরি চলচ্চিত্রের দৃশ্যের সঙ্গে মিলে গিয়ে কাহিনীর আবেগঘন মুহূর্তকে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করে।
দুটি গানের পার্থক্য কেবল রচনার কাঠামোতেই নয়, তাদের চলচ্চিত্রীয় ফাংশনেও স্পষ্ট। শাপমোচনে পালুস্কারের গানটি সিনেমার ভেতরে চরিত্রদের বাস্তব পরিবেশনার অংশ—অর্থাৎ এটি ন্যারেটিভে একধরনের সাংস্কৃতিক প্রদর্শন। ফলে এখানে গানটি diegetic, যার মাধ্যমে চলচ্চিত্র বাস্তবতার মধ্যে শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রামাণিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ইন্দ্রাণীর রফি-গানটি পুরোপুরি প্লেব্যাক প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত এবং চরিত্রের অভ্যন্তরীণ আবেগ প্রকাশে কাজ করে। এটি ন্যারেটিভের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত, কিন্তু non-diegetic আবহের সাথেও মিশে দর্শককে নাটকীয় অভিজ্ঞতায় টেনে আনে। অর্থাৎ রফির গানটিকে একাধারে সিনেমার diegetic আবহের মধ্যেও যেমন ফেলা যায়, গানটির নিজস্ব ব্যক্তি আবেগ তাকে প্লটের বাইরে একটি স্বতন্ত্র রূপ দিয়েছে।
এই ভিন্নতা থেকে একটি মূল উপসংহার টানা যায়: “কালিয়া সঙ্গ্ করত রঙ রালিয়া” কখনোই একটি সাধারণ ফিল্মি গান নয়। যদিও এটি বাংলা চলচ্চিত্রে হিন্দি ভাষায় ব্যবহৃত একটি গান এবং শাপমোচন ১৯৫৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল বলে একে ফিল্মি গান বলার প্রলোভন তৈরি হতে পারে, কিন্তু এর সাংগীতীক ভিত্তি, তালচক্র, পরিবেশনার ধাঁচ এবং চলচ্চিত্রীয় প্রয়োগ একে প্রকৃতপক্ষে একটি শাস্ত্রীয় বন্দিশ/খেয়াল হিসেবে স্থাপন করে। অন্যদিকে, “সব কুচ লুটাকর” তার সাংগীতীক সহজবোধ্যতা, তাল-ছন্দের জনপ্রিয়তা, অর্কেস্ট্রাল রূপায়ণ এবং প্লেব্যাক প্রযুক্তির মাধ্যমে একেবারে প্রচলিত ফিল্মি গানের পরিচয় পায়। সুতরাং, এই দুই গানের তুলনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ফিল্মি গান কেবল ভাষা বা চলচ্চিত্রে ব্যবহারের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয় না; বরং এর সাংগীতীক গঠন, তালপ্রকৃতি, অর্কেস্ট্রেশন এবং চলচ্চিত্রীয় কার্যকারিতাই নির্ধারণ করে যে গানটি কোন ধারায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
এই বিশ্লেষণ আমাদের সামনে আরও একটি বৃহত্তর দিক উন্মোচন করে। বাংলার চলচ্চিত্রে হিন্দি ভাষার গান কখনো কখনো শাস্ত্রীয় সংগীতের সাংস্কৃতিক অথরিটি হিসেবে হাজির হয়েছে, আবার কখনো ফিল্মি জনপ্রিয় ধারার প্রকাশ হিসেবে। শাপমোচনের গানটি ঐতিহ্যগত রাগসংগীতের ধারাবাহিকতাকে চলচ্চিত্রের অন্তর্গত করে তোলে, আর ইন্দ্রাণীর গানটি আধুনিক ফিল্মি সঙ্গীতের সর্বজনীনতা এবং আবেগঘন শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে। সেই হিসাবে বিশ্লেষণ করতে হলে, ইন্দ্রাণী ফিল্মে ব্যাবহৃত গানটিকে প্রথম বাংলা সিনেমায় হিন্দি গানের ব্যবহার হিসাবে দেখা যায়। শাপমোচন সিনেমায় গানটি হিন্দি ভাষার হলেও, এটি ফিল্মি গান হিসাবে বিশ্লেষণ করা যায় না, তার শাস্ত্রীয় সাংগীতীক বৈশিষ্ট্যের জন্য। এই ভিন্নতা আসলে আমাদের দেখায় কিভাবে একই ভাষার গান হলেও তার সাংগীতীক ও চলচ্চিত্রীয় প্রয়োগ তাকে ভিন্ন সাংস্কৃতিক শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । বিশেষ প্রকাশ । ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫