Jibansmriti Archive

রবিঠাকুরের সঙ্গে মাঝেসাঝে দেখা হয়ে যায়—

বাজার-ফিরতি বাঁকে, বোঝাই বাসের পাদানিতে,

আড্ডার রগড়ে, রকে, মোদিত বাংলার ঠেকে, ভিড়ের সড়কে,

কিংবা কানা কোনো গলি-পেটে।

#

এই তো সেদিন, গেলো মাসে তেসরায়—

তখনও নামেনি বৃষ্টি,

চলেছে আকাশ জুড়ে, আষাঢ়ে দিগন্তে শুধু পুঞ্জমেঘে ঘন কোলাকুলি,

কাঁঠালের ভূতি, আঁঠি, মাছের কানকা, খোসা, রাশ রাশ আরও যত যা রাবিশ

তখনও ভাসেনি বানে, একগলা ঘোলাজল নিয়ে

দাঁড়ায়নি এসে গঙ্গা, দিব্যবারি পুণ্যতোয়া, আমাদের গলির অন্দরে,

উদয় হলেন কবি, হবি তো হ, মনিহারি দোকানের পাশে, ডান ফুটে

পাড়ার যে দাওয়াখানা, ঠিক তার মধ্যিখানে। এমন মওকা—

বায়োকেমিকের বাই ভালোই গহীন জানি রবিনবাবুর—

কর নেড়ে নেড়ে নেড়ে, দেখাই-চেনাই ওঁকে রকমারি ওষুদ-বিসুদ,

রুপোলি ফয়েলে মোড়া ট্যাবলেট-ক্যাপসুল, চ্যাপ্টা, গোল, সরু, অবলং,

হলদে-সবুজ-লাল সিরাপের কাঁড়ি-কাঁড়ি কলস-বোয়াম,

বলি, ‘কত বুঝসুঝ আপনার, কহেন তো জীবনদেবতা,

কোথা সে আরোগ্যপথ্য বিশল্যকরণী, মস্ত এ গন্ধমাদনে?

বায়ুর ব্যারাম আছে, পিত্ত-কফে হেরাফেরি, যকৃতে যাতনা সে-ও আছে,

এদানি তো শুনি রোজ, অন্ধকার নিরালায়, মাঝিমাল্লা বৈঠা বায় বুকের খাঁচায়,

কানে ভিজে ভাটিয়ালি, রক্তে বিলম্বিত লয়, কাটে কি কাটে না বিভাবরী,

জাগরণে যায় নিশি, হাড়ে হিমভয়। সত্যি, তিন সত্যি ঠাকুরমশায়,  

অসীম পাথার হল অসুখ আমার—’

কী ব্যাভার! না কপালে মুশ্‌কিল আসানে ফুঁক, না স্তোক-সান্ত্বনা, আলখাল্লা, 

ফুড়ুৎ জানান বিনা। চড়ে তাপ, রক্তচাপ, অশান্তিনিকেতী ন্যাকড়ায়।

#

রাগ হয়, আবার মায়াও হয়—মস্তিষ্কের দোষব্যামো আছে আহা, ভদ্দরলোকের।

নতুবা, পরশু কেন, চোলাইচাখিয়েদের ঘোঁটে, খালাসিটোলায়, 

আমার পাশটি ঘেঁষে মাতলেন গুরুদেব খোশগপ্পে। খুললেম যেই

সোডার বোতল-ক্যাপ, ধরলেন ধুন—

এই ফাঁকে বলে রাখি, কেন জানি, শুনলেই, মাখন-মিহিন গলা ওঁর

তিরতির কাঁপে ঠোঁট, হাসবাষ্প অনিবার ভস্‌ভসায় এ অধমের

পাকাশয়ে। চেপেচুপে, পাতি কান। বল্লেন যা তিনি, সার তার:

বাতাসের ভাঁজে-খাঁজে স্বপন বপন করা অনেকদিনের কেলি তাঁর—

(উফ! ঠ্যাংয়ে তোলা দু-ঠ্যাং, ঊর্ধ্বশাখ অধঃমূল, উৎপটাং পোষেন যে কত  

হবি-শখ, বাবুলোগ!) কিন্তু,

ফি-পৌষেই সব্বনাশ, গোলায় ফসল নেই, স্বপ্নখেত মোঘপুষ্পা যে-কে-সেই,

শ্রীনিকেতনের জমিখানও বাঁজা, অনাদায়ী, ফললো না সোনা তায় টাকার বিহনে—

(কেন? শিলাইদহের পদ্মালগ্না জায়দাদ, নিসর্গসুন্দর জোত বুঝি গেছে লাটে,

ঝোলে কি সেখানে আজ, জ্বলে, লালবাতি?) উস্কোখুস্কো,

হাওয়ায় উড়ছে লম্বা সোনালি চিকন কেশ নির্ভাষ কবির; জাগে শঙ্কা,

টেবিলে ঠকাস ক’রে আসব-গেলাস থুয়ে, ছিটকে বেরিয়ে পড়ি তাড়িখানা ছেড়ে;

থাক মাথে রসভাণ্ড আধখালি—রবীন্দ্র ঠাকুর তাঁর ফকিরি জোব্বার জেব থেকে বের ক’রে

নাড়ান নাচান যদি নিঃস্বভারতীর ফাঁকা সেই ফুটোকৌটো,

নির্নিমেষ, ফোঁড়েন আমায় তাঁর করুণ দীঘল নয়নের জ্যোতিপাতে,

নিদেন কি টঙ্কা কয় বেকার-বেকার গচ্চা যেত না আমার? 

নয়-ছয়, সস্তা কটা আমোদ-বিলাস জন্য গেরস্তের কষ্টের সঞ্চয়?

#

আবার সেদিন পার্কে, ঢাকুরিয়া সরোবরে, বসেছিনু আমরা দুজনে

এক বেঞ্চে; উদারা-মুদারা-তারা, রাখি বেঁধে ত্রিসপ্তকে, ভাঁজছেন সুর 

জোড়াসাঁকো-কবিয়াল—মনের প্রলাপে মাখো জারানো-পেঁচানো কূট তাঁর কোনো গান।

লেখে শাস্ত্রে, উদোমোদো লোকেদের ভুলেও দেখিও নাকো সাঁকো,

তবু কী যে এল মনে, ওঁর গুনগুনানির গুণটানে ছলকে উঠলে

প্রাণে, সঞ্চারিত হল পুলকবেদনা সেই। না ধানাই, না পানাই, শুধোলেম

সোজাসুজি: ‘কন্‌ কত্তা, গাড়লেন তো আস্থায়ী হাজার-হাজার, সে কে, কোন্‌ খ্যাপা

স্থায়ী চির, নাড়াবাঁধা, নাড়ী-শিরা-ধমনীতে আমাদের; অবিরাম তার

লুকোচুরি খেলডাক, অথচ দেয় না ধরা—হতাশ হুতাশে কেন ঘুরি, 

মিছেমিছি ছুটে মরি, মরু-গিরি-সমতল, এ-পাড়ায় সে-পাড়ায়, হৃদ-ঝিল, রবীন্দ্রকানন?’

ক্রোধে চাগে শূলব্যথা। ভল্লফোড়ে ঝট্‌ ম্লান আমার কামনানন। রবি মেঘাতুর। বাঁচলেম!

থামলে তো আপাতত আঁতআগে ঠাকুরের সেবাইতি, প্যানপ্যানে প্রেমাহুতি, সমাহিত সাম।

#

তাও কি নিস্তার আছে। বুঝ্‌ভুম্বুল, বাড়াবেন ঠাকুর দক্ষিণকর বেছে বেছে আমারই বিদিকে—

শাওন পহরে ধরো, গেল ভেস্তে আকস্মিক, উদ্বেল পাগলপারা কোনো সাঁঝবেলা; ঝরোঝরো

বারিধারা—বীজবারণের বিঘ্নে টরেটম্‌, চড়লেম ফ্যা ফ্যা, শহরের মোড়ে-মোড়ে, কাকভেজা। আর,

তাক বুঝে কবিবর, আমার ক্ষোভের ক্ষতে, স্তোভের গরল ঢেলে, করলেন শুরু গুলতানি,    

জনমের মতো দীন, এই নিকড়িয়া নিয়ে, দরদের ছুতোছলে, সুরাড়ালে ফিচেল ফক্কুরি।

খুরে খুরে দণ্ডবৎ—অলীকের নটরাজ, কবীন্দ্র রবীন্দ্র কাছে যাবৎ-যা নাটক সকলই।      

#

জিরোবো যে দণ্ড দুই, ফুরসৎ কই তার—অভাবীর গার্হমেধে উবগারে আসেন না, তবু,

যখন-তখন দেখি, দুর্দম বাইক কিংবা ধীরগতিপ্রিয় ট্রাম থেকে, ফুটপাথে

সমাসীন দীর্ঘশ্রশ্মু; কখনও-বা ধুলো মেখে ছোটো কোনো মেয়ে সঙে নুড়ি-নুড়ি খেলা,

কোথাও-বা ছেলেদের ঘুড়ি-চাওয়া পথ ধরে, সূর্যমুখী পুষ্প যেন, আকাশ-বিহারী! ঢং, ঢং, 

বিলকুল ঢং সব। এ-নগরে, ভূতি-আঁঠি-কানকার আস্তাকুঁড়ে, রশ্মিতেজী আলোর নাচনে,

নষ্টমতি আলেয়ায় সর্ষে ফুল ব্যতিরেক কী আর নজরে পড়ে—সজনে ফুলের হাতছানি?

#

কোথাও কিসুই নেই, উড়ুপথ মেঘখালি; হঠাৎ অশনিপাতে ঘূর্ণি, চক্রবাতে

এলোঝেলো চরাচর—অমনই তুফানি উনি। হারিকেন-নেত্রোপম, কম 

খিটকেল, উলঝন, ঘোঁটেন-পাকান রোজ আমার ও ভন্ডুলমাস্টার।

কত আর সেতু বাঁধি, মেরামতে নামি ফের, ভাঙা সেতু আমাদের দুজনা-ভেতর?

#

সময়াসময় নেই, অবরেসবরে যদি, তরশু-পরশু-আজ, রবি ঠাকুরের সঙ্গে মোলাকাত হয় যথা তথা

যখনে-তখন। ধরো, রংবাজ তাসুড়েদের গ্যাঞ্জামে, বিভোল-খিস্তি, দগ্ধভাল আমি,

    তবিলে ফতুর হচ্ছি যেমনটা হই রোজ। দাঁড়ালেন, আমার সামনে

দেবতা; দিলেন ঠার, চাললেম ইস্কাবনে বিবি,

         ব্যস্‌! বোগাস হাতেও, বাজি 

      মাৎ।

                                      মানি,

                           দাহে পোড়া পঁচিশে বৈশাখ  

                 পায় না মোহনামুখ বাইশে শ্রাবণে দান্ত নীল

        পারাবারে। মানবিক ভ্রূণরাজি এদানি যা তেজস্কর হামাল জঠরে।

    দিগদারি আমাদের রকমারি। বাজার যা তেজী। তবু, ঘরে হোক, ময়দানে অথবা শ্মশানে,

আছেন আমার পাছে চারণে চতুর কবি। বিদায়ের আগমনী, লয়ে পারমাণবিক, বাজে তাঁর পদের সঞ্চারে।

#

গড় করি ঠাকুরের। রবি বদ্দির যা ছিরি চিৎ-চিকিৎসার।

জপি ইষ্টনাম জোর, আওড়াই ঘনঘন, ‘হিতাহিতবোধী মন, ক্রতো হে আমার, কৃতং স্মর,

কৃতং স্মর, কৃতং স্মর’। সুরেলা মোড়কে কেবলই যে 

কল্যাণমঙ্গলভাণে, শোনান আমাকে উনি, সকাল-বৈকাল, হামেহাল

                                     স্তব—

সুট ক’রে অকস্মাৎ,

    শবে শব, সমবেত

                     প্রস্থান-ওঙ্কার।

সাক্ষীচিত্রের লিংক : https://youtu.be/KlgcC3MLpF4

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৫ । ১০ অগস্ট ২০২৫

One Response

  1. রবিকরে পোড়াতন চিরকাল লোকে
    তবু মজে পিঁপড়েরা চিটেগুড় মুখে
    কিভাবে সারবে এই কাব্যি-অসুখ
    ভেবে ভেবে জেরবার তামাম মুলুক
    অবশেষে রবিবাবু দাওয়াই দোকানে
    মাখন-মিহিন গলা প’শে এসে কানে
    সেইসব গপ্‌সপ্‌ ফক্কুরি-সার
    মারাঠার কোষে কথ্য ভাষার কাতার
    হাওয়াবাজ স্বপনের সার সার ছবি
    শ্রাবণের বোশেখের এলোমেলো রবি
    তোড়ফোঁড়, ভেঙ্গে যায় সকল সিদ্ধাই
    ছত্রপতিরে এবে গড় করি তাই ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *