প্রখ্যাত চিত্রকলা শিল্পীরা চিত্রকলা চর্চা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বারে বারে বলেছেন যে রঙ তুলির সব আঁকিবুকি সার্থক হয় যখন তাতে প্রকৃত প্রাণ সঞ্চার হয়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে সুরের ঢেউ যেন শ্রোতাকে সেই মুহূর্তে তার ঘেরাটোপের বাইরে নিয়ে যায়, যা আসলে সেই সঙ্গীতের প্রাণ ছাড়া আর কিছু নয়। শিল্প হয়ে ওঠার যে অন্যতম শর্ত তাতে প্রাণ সঞ্চার, তাকে বিশ্বাস করে পৃথিবীর মহা সাহিত্যিকেরাও শব্দ-তাল-ছন্দ-জীবন দিয়ে এমন অভিজ্ঞতা প্রোথিত করেন যে তা চিরন্তন হয়ে যায়। শিল্পের এই প্রাণই শিল্পকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অমলিন করে রাখে। মনে রাখার মতো সিনেমার ক্ষেত্রেও সেই কথা খাটে। রাজা মিত্রের সিনেমা ঠিক এই কারণে ধীরে ধীরে আমাদের আবিষ্ট করে চলেছে। আগামী দিনে তা ক্রমবর্ধমান।

বাজারের থলে হাতে ধীরে ধীরে সাদা সাদা সিঁড়ি ভেঙে নব্বই বছর বয়স্ক অথচ ঋজু সাহিত্যিক রমাপদ উঠে আসছেন, পরনে তার সাদা পাঞ্জাবী আর ধুতি— একটা মধ্যবিত্ত জীবনের জলছবি এবং আরও অনেক কথা। আর একটা ছবি— নদীর জল থৈ থৈ। মাঝ দরিয়ায় একটা নৌকো বেয়ে চলেছে। সংসারের লোটাকম্বল সর্বস্ব গুচ্ছের ছোট ছোট পুঁটলি; তার মাঝে ওই পুঁটলির মতো বসে আছে সব হারানো মানুষেরা। আর বসে আছে একজন যে আগলে রেখেছে একটা ফটো ফ্রেম। বিদ্যাসাগরের ফটো। দেশ ভাগের সরণের এই ছবিতে শুধুমাত্র ঝিলকিয়ে উঠছে ওই ফটো আর ওই লোকটার চোখ। আর একটা ছবি—ফ্রেমের এক পাশে নতুন কেনা পেল্লাই মোটর বাইক উচ্চ কোটি সমাজের প্রতীক হয়ে আলো ঠিকরাচ্ছে। উল্টোদিকে ধানের গোলার সোনালি ধান যেন রূপসী বাংলার সমৃদ্ধি। এই দুই-এর মাঝখানে দুয়ার আলোকিত করে বসে আছেন অঞ্চল প্রধান। পাশে সহধর্মিণী আর এক ঘরের চৌকাঠে। ধানের শিসের দিকে একজন কর্মচারী আর মোটর বাইকের দিকে মাথা নত ভূমিহীন হাত জোড় করে একটা খাস জমি চাইছে। সমাজের চার স্তর একসাথে নিজস্বতায় ভাস্বর।
আরো অনেক উদাহরণ আছে। এই রকম সহজ, আটপৌরে ও সরল শট সমৃদ্ধ রাজা মিত্রের সিনেমায়। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের আপাত স্বাচ্ছন্দ্যকে নস্যাৎ করে অক্লান্ত চর্চার শস্য এই সহজতা। সে তথ্যচিত্র হোক কী সিনেমা। জীবনের গভীর সত্যগুলোকে প্রকাশ করতে ও তাতে যথাযথ প্রাণ সঞ্চার করতে তিনি ব্যবহার করেন পরিচিত অথচ আলাদাভাবে নজর না করা উপকরণে এবং সেগুলোকে সংযোজনের সাযুজ্যে।
প্রকৃত শিল্পীরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের সৃষ্টি কথা বলবে; তাঁরা ব্যাখ্যা করতে যাবেন না। অনেকটা এই রকম খেয়াল থেকে রাজা মিত্র কবিতা লিখতে শুরু করেন। একেবারে প্রবাহিত ভাবধারার উল্টোদিকে গিয়ে কখনও কবিতা শোনাবার বা প্রকাশ করবার পথে যাননি। খালি লিখে গেছেন নিভৃতে ঘুরিয়েছেন চর্চার চাকাটি। উনআশি বছরের জীবনে একমাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ এবং সেখানে উজ্জ্বল উচ্চারণ—‘আমার প্রথম ও সম্ভবত শেষ কবিতার বই’। শিল্প নিজেই কথা বলবে এই এক দুর্মর প্রতীতি। আর কবিতাগুলির দিকে চোখ রাখলেই তাঁর সিনেমার সেই সহজতার ভাবধারাটাও ধরা পড়ে। যেমন ‘থ্যাঁতলানো বটফল’ তার কবিতায় আসে ভুল ভালোবাসা যেমন পড়ে থাকে বোঝাতে। যেমন বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে কবিতায় মূর্ত করেন ‘আশ্চর্য চটির শব্দ’।
নৌকোর উপর ফটো ফ্রেম, থ্যাঁতলানো বটফল, আশ্চর্য চটির শব্দ, পর্দার কোণাকুণি মোটর বা ওই সিঁড়ি ভাঙা – এই সব অনন্য উপকরণ ও মৌলিক শিল্প ভাবনায় সেগুলোর সাযুজ্য সাথে দুর্মর প্রতীতি একত্রে যেন এক আন্তর্জাতিক শিল্প ভাষার প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন রাজা মিত্র। আজীবন আপোষহীন বৈশিষ্টে যেমন ব্যক্তিগত জীবন হয়েছে সাদামাঠা, অন্যদিকে ঠিক সেই বলিষ্ঠতার ভিত্তিতেই রূপালি পর্দাকে রঙিন ও প্রজ্জ্বল করেছেন রাজা মিত্র।
রাজা মিত্রের পোট্রেট : হিরণ মিত্র
শুভাশিস আচার্য জন্ম ১৯৭৩, শিল্প শহর দুর্গাপুরে। পেশায় সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট। প্রথম উপন্যাস : জলনাগর।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
আপনার সংক্ষিপ্ত অথচ ভাবনার গভীরতায় অতল লেখাটি পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। জীবনস্মৃতি আক্রাইভ ব্লগের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
আপনার ও ব্লগের জন্য শুভ কামনা জানাই।
পাশে থাকবেন। অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
অসাধারণ…আবার ও বলছি তুই আমাদের গর্ব!