হাওড়া জেলার দুটো রূপ রয়েছে। প্রথমটি শিল্পাঞ্চলের ব্যস্ততা আর দ্বিতীয়টি পল্লী বাংলার স্নিগ্ধতা। প্রথমটির মধ্যে কালো ধোঁয়া, দূষণ ও অপরিচ্ছন্নতা রয়েছে। সেখানে কোনও মায়া-মমতা নেই। অন্যদিকে গ্রামীণ হাওড়ার শ্যামলী রূপ মনকে শান্তি দেয়। ফুসফুসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় অফুরান অক্সিজেন। এই গ্রামীণ হাওড়াই তার নিজস্ব ঐতিহ্যকে আজও ধরে রেখেছে। আর সেই ঐতিহ্যের অন্যতম হল উদয়নারায়ণপুরের বাবুদের রথ। সবুজে ঘেরা এই জনপদে শতাব্দী প্রাচীন বাবুদের রথ হাওড়ার শিল্পসত্তাকে বহন করে নিয়ে চলেছে। সেই রথ অসাধারণ নান্দনিক চিত্রকলায় চলমান প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে।
সবুজ গাত্রবর্ণা চতুর্ভুজা দেবীর একহাতে খড়গ। অন্য হাতে বীণা। অপর একটি হাতে নরকরোটি। আরো একটি হাত অভয় মুদ্রার ভঙ্গিমায়। দেবী যে আসনে বসে রয়েছেন তার নিচে রয়েছে একটি পদ্ম। আর সেই পদ্মের ওপরেই ডান পা দিয়ে রয়েছেন দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী মাতঙ্গী। শতাব্দী প্রাচীন উদয়নারায়ণপুরের নবরত্ন বিশিষ্ট কাঠের রথের গায়ে এ ভাবেই বাংলার সনাতনী ঐতিহ্যকে প্রস্ফুটিত করা হয়েছে। চালচিত্র, পটচিত্রের পাশাপাশি রথচিত্রের নিজস্ব ঐতিহ্য বাংলায় রয়েছে। এই শৈল্পিক ঐতিহ্যের উৎকৃষ্টতম নান্দনিক দৃশ্যকলার দেখতে পাওয়া যায় উদয়নারায়ণপুরের রথে।

নবরত্ন শোভিত এ রথের গায়ে বিরাজ করে মা শীতলা থেকে মনসা। গ্রামীণ বাংলার জনপ্রিয় এই দুই দেবীর অভিব্যক্তির মধ্যে গ্রাম্য রমণীর লাজুক মিশ্রিত সরলতা প্রতিফলিত হয়েছে।


রথের আরেক দিকে মা কালী ও তার চারিদিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, সাধক বামাক্ষ্যাপা, সাধক রামপ্রসাদের সহাবস্থান। হলুদ ধুতি লাল পাঞ্জাবি এবং মাথায় পাগড়ী পরে রাজ বেশে বিরাজিত সবুজ গাত্রবর্ণের শ্রীরামচন্দ্র। পাশে সীতা ও অন্যান্য পারিশদবর্গ। পরমভক্তিতে রামের পায়ের কাছে বসে রয়েছেন হনুমান। রামচন্দ্রের অভিব্যক্তিতে নবযৌবনের বঙ্গ পুরুষের ভাব লক্ষ্য করা যায়। মাথায় মুকুট গলায় সাদা ফুলের মালা ও লাল শাড়ি পরিহিতা সীতার মধ্যে বঙ্গ গৃহবধুর অভিজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই রামের গোঁফ নেই। বাংলার একাধিক রাম মন্দিরে গোঁফওয়ালা রামের দেখা পাওয়া যায়। মুখের মধ্যে তেজময়তা থাকে। কিন্তু এ রামের মধ্যে শান্ত, সমাহিত ভাব।

বানর সেনাদের রামসেতু নির্মাণের দৃশ্য রয়েছে। রাম থাকবে অথচ কৃষ্ণ থাকবে না এমনটা শ্রীচৈতন্যের এই বাংলায় হতেই পারে না। ফলে নাটকীয় অভিব্যক্তি সম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণের লীলা মাহাত্ম্য দেখা এই রথের গায়ে পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণের বকাসুর বধ, এক আঙুলে গোবর্ধন পর্বতকে তুলে নেওয়া, সখীদের সঙ্গে খুনসুটি করা দৃশ্য আলোকিত করে রয়েছে রথের মধ্যে। কৃষ্ণ রাধার অমরপ্রেমের দৃশ্যাবলী রয়েছে এতে।

স্থূল গোঁফওয়ালা বঙ্গ পিতৃতন্ত্রের প্রতীক শিব বিরাজিত এ রথের গায়ে। কখনো ধ্যানস্থ আবার কখনো লড়াইয়ে উদ্যত শিবকে নাম না জানা শিল্পীরা তাদের তুলির ছোঁয়ায় শাশ্বত করে রেখেছে শতাব্দী প্রাচীন এই রথে।

ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে বড় করে আঁকা হয়েছে নরসিংহকে। কাখে কলসী কাচুলি পরিহিতা শকুন্তলার সরল তাকানো বাংলার গ্রাম্য যুবতীর কথা মনে করিয়ে দেয়। রথের মধ্যে ফুল লতাপাতার কাজ খুব সুন্দরভাবে ও যত্ন সহকারে অঙ্কিত হয়েছে।
সেই নাম না জানা শিল্পীরা অতীব যত্ন সহকারে ফুল ও পাতা এঁকেছেন রথের গায়ে। রথের প্রতিটি কোনায় যুদ্ধের দৃশ্য, শ্রীকৃষ্ণের বাল্য রূপের দৃশ্যাবলী কাঠ খোদাই করে অলংকৃত করা হয়েছে। যোদ্ধাদের মুখের ভাব আক্রমণাত্মক।

রথের চারিদিকে আলাদা করে কাঠের মূর্তি বসানো হয়েছে। এই মূর্তির মধ্যে কয়েকটিতে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ভাব রয়েছে। এছাড়াও দেবী ধূমাবতী, শৈলপুত্রী, কালীঘাটের মা কালী, মহিষমর্দিনী মা দুর্গা সকলেই বিরাজিত এ রথের গায়ে। সমুদ্রমন্থনের দৃশ্যাবলী নাম না জানা শিল্পীরা তুলির হাল্কা ছোঁয়ায় আলোকিত করে রেখেছেন।

উল্লেখ করা যেতে পারে এ রথের দায়িত্বে বর্তমানে রয়েছে রামকৃষ্ণ সারদা মাতৃ সংঘের হাতে। তাদের তরফ থেকে প্রতিবেদককে জানানো হয়েছে কোভিডের সময় শেষবার এই রথটিকে সংস্কার করা হয়। রথের গায়ে যে ছবিগুলো আঁকা ছিল তারই ওপর রঙ বোলানো হয়েছে। নতুন করে অন্য কোন চরিত্র বা দৃশ্যাবলী এই রথে সংযুক্ত করা হয়নি। এর রথ গোটাটাই কাঠের তৈরি। তারাপদ সাঁতরার পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পী সমাজ থেকে জানতে পারা যায় যে সূত্রধর শিল্পীরা রথের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য চিত্রকলার আশ্রয় নিতেন। সূত্রধরদের আঁকা রথ চিত্রের মধ্যে ফ্রেস্কো চিত্রাঙ্কনের ধারাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশেষ কৃজ্ঞতা স্বীকার : দেবজিত ভট্টাচার্য
শুভঙ্কর দাস । প্রাবন্ধিক
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৪ । ২৪ জুলাই ২০২৫