Jibansmriti Archive

পর্ব : দুই

আধুনিক বাংলা নাট্যচর্চার অনুপ্রেরণায় সংস্কৃত 

সমাজের সমসাময়িক বিষয়ের অভিপ্রেত উন্নয়ন ও ঊর্ধ্বায়নের কথাই সাহিত্য ব’লে থাকে। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ছিল রাঢ়বাংলার চারণকবিদের মনোবাসনার গীত আখ্যান। তাই সেখানে পৌরাণিক অনুষঙ্গকে উপেক্ষা করা যায়নি। তারই সঙ্গে রামায়ণ, মহাভারতের গানও বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে বাংলায় আধুনিক যুগের সূচনা হয় ১৯শ শতকে। বিশেষতঃ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, শ্রীরামপুর মিশন ও একাধিক ছাপাখানাকে কেন্দ্র ক’রেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়ন ঘটতে থাকে। এতদিন পর্যন্ত যা লোককথায় ছিল, তা সেই সীমা পেরিয়ে এবার লিখিত আকারে প্রকাশিত হতে লাগল। তাই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পীঠস্থান যে ডিহি কলিকাতা ও সুতানুটি অঞ্চল ছিল, তা দ্বিতীয়বার মনে করানো নিষ্প্রয়োজন।

এই সময়ের দুটি নতুন ফসল হ’ল গদ্যসাহিত্য ও নাট্যসাহিত্য যা মধ্যযুগের জল-মাটি-হাওয়ায় গড়ে ওঠেনি। তবে এই নাটকেও সংস্কৃতের মায়া কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। রামনারায়ণ তর্করত্ন যাঁকে মৌলিক বাংলা নাটকের জন্মদাতা বলেই মানা হয়, তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) নাটকে পুরোদস্তুর সংস্কৃত নাটকের নিয়মনীতি অনুসরণ করা হ’ল। সংস্কৃত নাটকের ভূমিকায় সঞ্চালনার অংশটিও সংযুক্ত হয়ে থাকত। তার নাম ছিল ‘প্রস্তাবনা’। সূত্রধার ও নটীর কথোপকথনে উঠে আসত নাটক-নাট্যকারের পরিচয়, অভিনয়ের সময় ইত্যাদি। সেখানে কখনও নটী গানও গাইত। ওই নাটকেও সেই কৌশল ব্রাত্য হয়নি। “চূত মুকুল কুল, সঞ্চল দলি কুল,/গুণ রঞ্জন গানে//” গানটি গেয়েছে নটী। এ নাটক দেখলে মনে হয় যেন কোনও সংস্কৃত নাটকেরই  বঙ্গানুবাদ। এমনকি জোড়াসাঁকোর ৫নং বাড়িতে যখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জোড়াসাঁকো নাট্যশালা তৈরি হ’ল,তখন সেখানেও রামনারায়ণ তর্করত্নেরই ‘নবনাটক’ অভিনীত হয় ১৮৬৭ সালে যেখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল নটীর।

শুধু নারীচরিত্রে অভিনয়ই নয়; “মলয় নিলয় পরিহারপুরঃসর” গানও গেয়েছিলেন সুমিষ্ট কণ্ঠে। বাংলা নাটকে সংস্কৃত কাব্যের আদলে ললিত ছন্দে গানের ব্যবহারই যেন নাটক ও গানকে এক সুতোয় বাঁধার এক প্রস্তুতি পর্ব চলছিল। সেই সময় সাহিত্যের সামগ্রীতেও কিঞ্চিৎ বদল দেখা দিতে লাগল। মধ্যযুগে মনসা, ধর্ম, চণ্ডী, শীতলা, ষষ্ঠীর ম’ত দেবীকে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরাণ থেকে ডেকে আনা হচ্ছিল। ১৯শ শতকে সাহিত্যের উৎস সেই সংস্কৃত ভাষা হলেও কাব্যবাদী চিন্তাধারাকেই গুরুত্ব দেওয়া হ’তে লাগল যার অন্যতম প্রধান হয়ে উঠল আদিকবির আদিকাব্য ‘রামায়ণ’। কবি কৃত্তিবাস ওঝা রাম ও রামায়ণকে ঘরোয়া করে তুলেছিলেন বটে; তবে এই নতুন যুগ তাকে ‘কবি’র কাছে পৌঁছে দিলেন। কবির মন থাকে ভাবে, ভাষায়, সৌন্দর্যে ও চমৎকারিত্বে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ অবলম্বনে লিখলেন ‘সীতার বনবাস’। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রামায়ণের যুদ্ধ কাণ্ডের শাখাপ্রশাখায় মেলে ধরলেন ‘মেঘনাদবধকাব্য’।

রামনারায়ণ তর্করত্ন

অন্যদিকে সেই সময় বঙ্গরঙ্গমঞ্চে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তিনি সেই কাব্যের নাট্যরূপও দিলেন। এমনকি তিনি ‘অকালবোধন’ (১৮৭৭) ও ‘দোললীলা’ (১৮৭৮) নামের এমন দুটি নাট্যরচনা করলেন যার পরিচয় ছিল ‘নাট্যরাসক’। তৎকালীন বাংলা নাট্যসংস্কৃতিতে এই শব্দবন্ধ সম্পূর্ণ অজানা ছিল। নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-ই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়াখ্যান নিয়ে ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ (১৮৭৪) নামের একটি গীতিধর্মী নাট্যভাবনা প্রকাশ্যে আনেন ও তার নাম দেন ‘নাট্যরাসক’। তবে আখ্যাপত্রে ‘OPERA’ কথাটিও ছিল। অর্থাৎ তিনি ইতালি বা ইউরোপীয় অপেরার মধ্যে সংস্কৃত নাট্যরাসকের গুণাগুণ খুঁজে পেয়েছিলেন। রাজকৃষ্ণ রায় তাঁর ‘পতিব্রতা’ নাটকের ভূমিকায় বলেছেন “নাটকের ন্যায় নাট্যগীতি বা নাট্যরাসকের সংখ্যাবৃদ্ধি ও অভিনয় আবশ্যকীয়।…নাট্যগীতিতে সঙ্গীতের প্রাচুর্য্য আদ্যোপান্ত…নাট্যরাসক বা নাট্যগীতির প্রকৃত অর্থ আদ্যন্ত-স্বরনিবদ্ধ-সঙ্গীতময়-অভিনেয়-গ্রন্থ।”

গ্রন্থের নামপত্র

আসলে ‘নাট্যরাসক’ শব্দটি ছিল সংস্কৃত ও এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ভোজদেবের ‘শৃঙ্গারপ্রকাশ’-এ যার আনুমানিক সময়কাল খ্রিঃ ১১শ শতক। সেসময় এই নাট্যরাসক ছিল বসন্ত বা অন্যান্য রাগে আধারিত গানের সঙ্গে নৃত্যায়ন যেখানে রাজ-রাজড়াদের স্তুতিই ছিল একমাত্র কারণ। পরে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে এর চেহারায় সামান্য কাহিনি জুড়ে যায় যা নারী-পুরুষের উপভোগ্য প্রেমের মায়াজাল। ১৯শ শতকে এই নাট্যগীতি সংস্কৃত ভাষা ছাড়লেও সেই ভাবাবেগকে ভুলতে পারেনি। গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা নাট্যরাসকেও সেই কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও রাধাকৃষ্ণের অনুষঙ্গ উঠে এল। ‘অকালবোধন’ অতি সংক্ষিপ্ত নাট্যরাসক হলেও সেখানে দুটি দৃশ্যে ভৈরবী, শ্রী, কালেংড়া, খাম্বাজ, টৌড়ি, বাহার ইত্যাদি রাগে মোট আটটি গান রয়েছে। এমনকি নাচের জন্যই অপ্সরাদের চরিত্রও তিনি রাখলেন। তাই ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ হোক বা নটেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মাল্যপ্রদান’ (নাট্যরাসক) হোক; সর্বত্রই গানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে যা প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যপদ্ধতিরই অংশবিশেষ।

এই সূত্রেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও এর প্রভাব পড়ে। তখন ১৮৭৯ সাল। স্বর্ণকুমারী দেবী গানের ডালি সাজিয়ে গাঁথলেন ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্য।

স্বর্ণকুমারী দেবী

ত্রিকোণ প্রেমই তার বিষয়। এই রেশ ধরেই ঠিক পরের বছর এ দায়িত্ব কাঁধে নিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখলেন ‘মানময়ী’ (১৮৮০)। পরস্ত্রী উর্বশীর প্রতি ইন্দ্রের আকর্ষণ থেকেই শচীর মান ও শেষে মানভঞ্জন তার সারকথা। ঠাকুরবাড়িতে এই ধরণের নাট্যে বারেবারেই বৈদিক ও পৌরাণিক দেবতারা উঠে এসেছেন বটে; তবে ব্রাহ্মধর্মের বাতাবরণ থাকায় কোনও ভক্তিরস সেখানে বিগলিত হয়ে চিত্তশুদ্ধি করেনি দর্শকদের। বরং সেই ধরণের চরিত্রকেই নাট্যকাহিনিতে রাখা হয়েছে যাদের সঙ্গে পুরাণের সময় থেকেই  সংগীতকলার সম্পর্ক ছিল। 

গ্রন্থের নামপত্র

‘বসন্ত উৎসব’-এর অভিনয়ের সময় তখন রবীন্দ্রনাথ বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গেলেও ‘মানময়ী’র অভিনয়ে তিনি পুনরায় জোড়াসাঁকোতেই ফিরে এসেছেন। তাই শেষ দৃশ্যের জন্য তিনি বাঁধলেন “আয় তবে সহচরী” গানটি। সুতরাং ১৮৭০ এর দশকের নাট্যসমাজে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই ধারাকেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র পাশ্চাত্য অপেরা নয়; ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যকলাকে সমসাময়িক প্রেক্ষিতে নতুন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে আধুনিক বাংলা চলিত কথ্য ভাষায়। একদিকে বাল্মীকীয় কাব্য, অন্যদিকে নাট্যরাসকের ধারা রবীন্দ্রনাথ তথা জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়িকে বড়ই অনুপ্রাণিত করেছিল একথা বললে ভুল হবেনা। এছাড়াও বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিত্ব, সঙ্গে বিলেত ভ্রমণের ম’ত অভিজ্ঞতার সাক্ষীতেই রবীন্দ্রনাট্যের প্রারম্ভিক পর্যায়ে সংস্কৃত সাহিত্যের চরিতাশ্রয়ী এমনই এক গীতিনাট্যের উদয় হয় যার নাম ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১)। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – 

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা

নাট্যতত্ত্ব ও নাট্যমঞ্চ – ড. অজিতকুমার ঘোষ বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস – দর্শন চৌধুরী

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *