Jibansmriti Archive

সে বহুযুগ আগের কথা। সিন্ধুবিধৌত বেদভূমিতেই দেবভাষা উদাত্ত সুরে গীত হয়েছিল। অনুপম সারস্বত সূক্তগুলিই তার প্রমাণ। মেধাসঞ্জাত সেই মন্ত্রশক্তিই ভারতভূমিকে দিয়েছিল এক নতুন পথের সন্ধান। হিরণ্ময় দ্যুতির আভায় সেই ঋষিদের মননেই জন্ম হ’ল উপনিষদের। কে আমি, কেন আমি, কার জন্য আমি – এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়েছিল সেই উপনিষদের বাণীধ্বনি। জগতের মধ্যে নিজেকে এবং নিজের মধ্যে জগৎকে অনুভবই হ’ল ‘আনন্দ’। তাই সেই পরব্রহ্মের আহ্বানেই আমাদের চেয়ে থাকা। তার সাক্ষী মহাকাশের প্রতিটি নক্ষত্র।

বঙ্গাব্দ ১২৬৮, বৈশাখ মাস, তারিখ ২৫। কলিকাতা মহানগরীর জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়িতে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসা-ই বটে; যে আসায় মিশে আছে আশা ও আশ্রয়। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতোপূর্বেই ব্রাহ্মমতে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সুতরাং ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতিতে ছিল নিরাকার ব্রহ্মের চর্যা। বেদান্ত বা ব্রহ্মসূত্র বা উপনিষদ, যাই বলিনা কেন; তা সংস্কৃতেই উক্ত ছিল। সংস্কৃত ছিল সেকালে রাজমর্যাদাসম্পন্ন এক সুশীল ভাষা। তাই ভারতীয় শাস্ত্রগ্রন্থের আদিপর্বের প্রায় সবই ওই ভাষাতেই লেখা। তাই পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথের জীবনে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যচর্চার জন্য বিশেষ সুবিধা হয়েছিল। জীবনস্মৃতি-র ‘পিতৃদেব’ অধ্যায় থেকে জানা যায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে প্রকাশিত কোমল কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য ছিল।

একদিন গঙ্গায় নৌকাবিহারের সময় তিনি তা পড়েছিলেন। যদিও সে সময়ে তার সুরভাষা সংস্কৃতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়নি। তিনি নিজেই সেকথা স্বীকার করেছেন এভাবে – “আমি তখন সংস্কৃত কিছুই জানিতাম না। বাংলা ভালো জানিতাম বলিয়া অনেকগুলি শব্দের অর্থ বুঝিতে পারিতাম। সেই গীতগোবিন্দখানা যে কতবার পড়িয়াছি তাহা বলিতে পারি না।“  শিশু বয়স থেকেই কবির মনে ছিল ললিতলাবণ্য কাব্যকলার প্রতি অনুরাগ। সেই ছন্দঝংকার ও ভাষার মাধুর্যই তাঁকে আপন ক’রে ছিল। তাঁর সংস্কৃত সাহিত্যের পাঠ শুরু হয় পণ্ডিত জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি তাঁকে মহাকবি কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্যের ভাবানুবাদ শোনাতেন। রবীন্দ্রনাথ এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি প্রায় সমগ্র কাব্যটিরই বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। এরপরে আসেন রামসর্বস্ব পণ্ডিতমশাই। তাঁর দায়িত্ব ছিল প্রথাগত “সংস্কৃত অধ্যাপনার ভার”। তিনি পড়িয়েছিলেন কালিদাসেরই সেই কালজয়ী ‘অভিজ্ঞানশাকুন্তল’ নাটক বা সংক্ষেপে ‘শকুন্তলা’। তবে এই ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যেরই দুটি শ্লোকের কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখনীতেই ব্যক্ত করেছেন। প্রথমটি ‘উমোৎপত্তি’ নামের প্রথম সর্গের ১৫নং শ্লোকটি “মন্দাকিনীনির্ঝরশীকরানাং….”।

এই শ্লোকে বলা ছিল যে হিমশীতল বায়ু কিরাতদের মাথায় থাকা ময়ূরপচ্ছকে ভেদ ক’রে অজেয় গতিতে এগিয়ে চলে। অথচ বালক রবীন্দ্রনাথের এই অর্থ অভিপ্রেত ছিলনা। তুলনায় স্বর্গীয় দেবদারু বাতাসের দোলায় তালে তালে সঙ্গত করার বিষয়টি তাঁর বড়ই পছন্দ হয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন “কেবল ‘মন্দাকিনীনির্ঝরশীকর’ এবং ‘কম্পিতদেবদারু’ এই দুটি কথাই আমার মন ভুলাইয়াছিল”। এর থেকেই সহজে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের শব্দসৃষ্টির দিকেই মনোযোগ ছিল বেশি।

‘মন্দাকিনীনির্ঝরশীকর’ শব্দে ন, র ব্যঞ্জনবর্ণের অনুপ্রাস ঘটেছে। তাই শব্দের সঙ্গে খেলা করার বাসনা বোধহয় তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনে গেঁথে গেছিল। তারই প্রভাব পাওয়া যায় “বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে” গানটির মধ্যে দিয়েই। এখানেও ‘বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে’ তেও সেই শব্দের যাদু আমাদের মোহিত ক’রে দেয়। আরও একটি পরিচিত শ্লোকের কথাও তিনি বলেছেন ‘কবিতা-রচনারম্ভ’ অধ্যায়ে। সেখানে জানা যায় একবার তিনি নবগোপাল মিত্রকে তাঁর একটি স্বরচিত কবিতা শুনিয়েছিলেন যেখানে ‘দ্বিরেফ’  ব’লে একটি শব্দ ছিল। যদিও ‘জীবনস্মৃতি’ তিনি যে বয়সে লিখেছেন, তখন পুরোনো স্মৃতিকথার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিলিপি তৈরি করা সম্ভব ছিলনা। তবুও একথা মেনে নিতে কোনও দোষ নেই যে ছেলেবেলায় তিনি ‘কুমারসম্ভব’-এর তৃতীয় সর্গের “মধু দ্বিরেফ কুসুমৈকপাত্রে….” শ্লোকটি থেকেই এই শব্দটি সংগ্রহ করেছিলেন। শুধু পাঠই নয়; এ ছিল আত্মস্থ।

কালিদাসের নাটক, মহাকাব্য তাঁকে অনুবোধিত ক’রে তুলেছিল। যখন তিনি যুবক, তখন ওই কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর থেকেও ওই মহাকাব্যের প্রথম সর্গের প্রথম শ্লোকটির আবৃত্তি শুনেছিলেন। শ্লোকটি ছিল “অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালযো নাম নগাধিরাজঃ। পূর্বাপরৌ তোযনিধী বগাহ্য স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ডঃ।।“  তিনি বুঝেছিলেন “হিমালয়ের উদার মহিমাকে এই আ-স্বরের দ্বারা বিস্তারিত করিয়া দেখাইবার জন্যই ‘দেবতাত্মা’ হইতে আরম্ভ করিয়া ‘নগাধিরাজ’ পর্যন্ত কবি এতগুলি আ-কারের সমাবেশ করিয়াছেন।“  বয়সের সঙ্গেই আসে অভিজ্ঞতা ও অভিচিন্তা। এই ‘সাহিত্যের সঙ্গী’ অধ্যায়েই তিনি ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্যেরও প্রথম সর্গের তৃতীয় শ্লোকটির কথা উল্লেখ করেছেন যা তাঁকে নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী স্মরণ করিয়ে দিতেন।

কবি কালিদাস কাব্যরচনার শুরুতেই বিনয়ীভাবে বলেছিলেন যে তাঁর ম’ত একজন সামান্য কবি রঘুরাজকুলগাথা রচনার জন্যই যশঃপ্রার্থী হয়েছেন যা হাস্যরসের নামান্তর। তাই কালিদাসের রচনাবলির সঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের একপ্রকার সখ্য হয়েছিল একথা বলাই যায়। একদিকে পারিবারিক ঐতিহ্যে ছিল বেদান্তবিদ্যার আবহ, অন্যদিকে নিরন্তর চলেছিল সংস্কৃত কাব্যের অনুশীলন। মহত্বের সঙ্গে সৌন্দর্যের পথ-চলা, প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের ওঠাপড়া। এই ছিল বিশ্বকবির চেতনায় সংস্কৃত শাস্ত্র ও কাব্যের উদয়কাল।

 ক্রমশঃ                                                               

সমীপেষু দাস প্রাবন্ধিক এবং সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবাসী ইভিনিং কলেজ

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

4 Responses

  1. সংস্কৃত চর্চা ও রবীন্দ্রনাথ
    অসাধারণ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *