Jibansmriti Archive

বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজো

বিগত কয়েক বছর হল কি যে এক ঝামেলা শুরু হয়েছে ,মহালয়া শুভ না অশুভ। আসলে আমাদের ছোটবেলায় এত শুভেচ্ছার ঢল ছিল না, তাই শুভ নাকি অশুভ সেটা কখনো মনেও আসেনি, বা বাড়ির বড়দেরও সে নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেও দেখিনি। শুধু এটুকু মনে আছে,সকালে বাবা বা জ্যেঠু তর্পণ করতে যেত। আর ওইদিনটা আমরা নিরামিষ খেতাম।এছাড়া যেহেতু বাবারা পূর্ববঙ্গের লোক,তাই পুজোতে সবকটাদিনই আমাদের আমিষ খাওয়াই হত। শিশুমন,পিতৃপক্ষ, দেবীপক্ষ, কিছুই বুঝতাম না। শুধু আনন্দে ভরে উঠত মনটা, পুজো আসছে।

তখন মহালয়ার আগেরদিন শেষ স্কুল হয়ে পুজোর ছুটি শুরু হয়ে যেত। পরে অবশ্য ছুটিটা হত পঞ্চমীতে। তা বলে কি লেখাপড়ার ছুটি ছিল? মোটেই না। যেহেতু ষষ্ঠী থেকে দশমী নো পড়াশুনো, তাই পঞ্চমী অব্দি দুবেলা পড়তে বসতেই হত। আমাদের পাড়ার পুজো একদম বাড়ির পাশেই হত।  তাই মন তো সেদিকেই পড়ে থাকত। দিনে কতবার যে প্যান্ডেলে ঢুঁ মারতাম তার ইয়ত্তা নেই।বাঁশ পরা থেকে আরম্ভ করে একটু একটু করে প্যান্ডেল তৈরি হওয়া,  ঠাকুর আসা, পুজোর আয়োজন,জাঁকজমক, ঝলমলে চারিদিক, কত হৈচৈ, কত আনন্দ। কদিনের এই আনন্দ। আবার একরাশ মনখারাপ, একটু একটু করে জীবনে ফিরে আসা।বড় হয়ে বুঝেছি, এ যেন আমাদের জীবন – শূন্য থেকে পূর্ণ হয়ে আবার শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। খুব ক্লিশে শোনালেও তখন এই পুজো এই উৎসবকে ছুঁতে পারতাম, আজ আর পারিনা। সেই পাড়া তো এখনো আছে। আমি না থাকলেও, পুরনো অধিবাসী কেউ কেউ তো আছে। কিন্তু সেই পুরো পাড়া একটা পরিবার হয়ে ওঠা, সেটা কি আছে? নেই বোধহয়। এটা তো সময়ের দাবি, মেনে নিতেই হবে, তবু মনখারাপ তো হয়েই।

আমাদের ছোটবেলায় সবকিছু ভালো ছিল আর এখন সবকিছুই খারাপ, এমনটা যাঁরা ভাবেন আমি ঠিক সে দলে হয়তো পড়িনা ঠিকই কিন্তু যে কোনো উৎসবের ক্ষেত্রেই যে বদলটা ঘটেছে, সেটা বড়ই প্রকট। তার আঁচ যে দুর্গাপুজোতেও লাগবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। আগেও উৎসবকে ঘিরে ব্যবসা,তার লাভ লোকসানের একটা ব্যাপার  ছিল, এখনও আছে,থাকবেও। কিন্তু এখন আর উৎসবে সেই স্বতঃস্ফূর্ততা খুঁজে পাওয়া যায় না।আট থেকে আশি – সবাই মিলে এখন আর কাজে হাত লাগায় না।তার কাছে পৌঁছনো যায় না, কেবল দূর থেকে দেখা যায়। পুজো এখন হয়ে গেছে একটা Corporate Event। কিন্তু একটা ভালো দিক উঠে এসেছে। অসাধারণ কিছু শিল্পীদের অসামান্য কিছু কাজ ও ভাবনা দেখার সুযোগ পাচ্ছি আমরা।

যেহেতু আমার বাড়ির একদম পাশেই পুজো হত, তাই ওই কটাদিন আমাদের বাড়ি হয়ে উঠত হট্টমেলার দেশ। ভোরবেলা বাবা উঠে দরজা খুলে দিত, বন্ধ হত রাত একটা / দেড়টায়। তাতেও কিন্তু নিস্তার নেই। তখন দেওয়া নেওয়া চলত জানলা দিয়ে। জল, বালিশ, চাদর, কখনো বা ” ও বৌদি খিদে পেয়েছে, কি আছে দাও তো ‘। হঠাৎ কখনো দেখতাম ক্লাবের একদল কাকু, দাদারা হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে সোজা বাবার ঘরে গিয়ে হাজির হত।কিসব গম্ভীর আলোচনা করে চলে যেত। আর আমার দায়িত্ব  ছিল ভালো গান সাপ্লাই দেওয়া।

পুজোর কটাদিন কি বার বা কি তারিখ কিছুই মনে থাকত না। ঘুম থেকে উঠেই কোনোমতে ব্রাশ করেই ছুট প্যান্ডেলে। কোনো বিশেষ কাজে নয়, একদমই এমনি। চারিদিকটা একবার দেখে ফিরে এলাম। কখনো বা সকালে আমাদের ছোটদের ডাক পরত বেলপাতা, তুলসীপাতা, দুব্বো বেছে দেওয়ার জন্য। বাড়ি ফিরেই মাকে বলতাম ” শিগগিরই খেতে দাও, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে “।মা বলত ” কি এমন রাজকার্য আছে সেখানে শুনি “? মা কি আর বুঝবে কি রাজকার্য? টুকাই, বুচাই, শঙ্কু,পম্পা, পাপ্পু, সবাই আমার আগে চলে আসবে, কত গল্প, কত প্ল্যান – আমি মিস করব না?বন্দুক দিয়ে ক্যাপ ফাটানো, পাখা নিয়ে দে ছুট, কার পাখা কত জোরে ঘোরে – ফিসফিস করে চুপিচুপি কত কথা – মা কি এসব বুঝবে? তার ওপর ব্যাগে দশ টাকা! হুম্ম বাবাহ আমি তখন বলে কত্ত বড়লোক, বন্ধুদের খাওয়াতে হবে না? এছাড়াও নিজে এটা সেটা কিনে খাওয়ার লাইসেন্স ও তো শুধু ওই কটাদিনই পেতাম। তাই একটা মুহূর্তও কি নষ্ট হতে দেওয়া যায়?

ঠাম্মা আর পিসিমণি এত চকচকে টাকা কোথায় পেত কে জানে? ৫ টাকা করে সব ভাইবোনের জন্যে বরাদ্দ থাকত।পুজোর কদিন গলির মোড় অব্দি একা যাওয়ার পারমিশন থাকত কারণ ওই সময়ে গলিতে কোনো গাড়ি ঢুকত না। পাড়ার আনন্দ ছেড়ে অন্য কোথাও ঠাকুর দেখতে যেতে ইচ্ছেই করত না! বিকেল হলে সব গোল হয়ে বাড়ির সামনে চেয়ার পেতে আড্ডা শুরু হত। একদিকে বড়রা একদিকে ছোটরা। ভীড় একটু বেশি হলে সামলানোর জন্য ডাক পরত। উফফফ, সে অনুভূতি বোঝাতে পারব না। নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হত তখন।

আমাদের ক্লাব নবমিলন, পাশের ক্লাব সন্ধানী। দুই ক্লাবে চরম রেষারেষি। ওই ক্লাবের রিঙ্কুদা হয়তো আমাদের ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতায় নাম দিল, ব্যাস – আবার শুরু রেষারেষি। কিন্তু তৃতীয় কেউ এসে নাক গলালে বা ঝামেলা করলে, তখন এই দুই ক্লাবের একতা দেখবার মত। ছোটবেলায় আমি গান গাইতে জানি বলে খুব রাগ হত। ভীড় হাল্কা হলেই, সবাই মিলে চেপে ধরত গান শোনাতে। আমার বলে তখন খেলতে যাওয়ায় মন, বন্ধুরা রেগে যাচ্ছে,ওদিকে বড়দের কথারও অমান্য করতে পারছি না। আচ্ছা বড়রা এগুলো বুঝত না কেন? এখন আমরা যখন সেই বড়র দলে, আমরাও কি বুঝি?সেই একই কাজ করিনা?

আমার বাবা ঠিক যতটা ভালো কবিতা বা গল্প বা ভ্রমণ কাহিনী লিখতে পারত, ততটাই ভালো সেলাই করতে পারত( না শিখে)। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে বা বদল ঘটেছে। তার একটা হল সেলাই মেশিন। আমাদেরও  ছিল একটা মেরিটের সেলাই মেশিন। হাত ঘুরিয়ে চলত সে। পুজোর আগে কি বিরক্ত করতাম বাবাকে। জামার এটা ঢিলে, প্যান্টের ওটা টাইট, বা লম্বাটা একটু ছোট করে দেবে? এসব চলতেই থাকত।সে দলে শুধু আমি মোটেও ছিলাম না,বড়রাও থাকত সে দলে।অফিস থেকে ফিরেই বসে পরত বাবা মেশিন নিয়ে আর বলত “ওরে, আমি কি পুরো পুজো এই করব? পূজাবার্ষিকীগুলো কখন পড়ব? ( বাবার মত বইয়ের নেশা আমি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি)

এখন কটা মানুষের বাড়িতে আর সেলাইমেশিন থাকে? আর বানিয়েই বা ক’জন পরে?দিন বদলেছে, জামাকাপড়ের ধরন যেমন বদলেছে তেমন যাঁরা বানাতেন, তাদের চাহিদাও অনেকটাই কমে গেছে। আমরাও ঘরে বসেই অনায়াসে কত কিছু কিনে ফেলতে পারছি। এ কি কম সুবিধে?কিন্তু কত মানুষ যে তাদের জীবিকা হারাচ্ছে?এরই নাম জীবন, ভালো মন্দর মিশেল।

পূজাবার্ষিকী,বাঙালি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেভাবে আর পড়ি এখন আমরা?এই প্রজন্মের অনেকে বোধহয় জানেই না, পূজাবার্ষিকী কি।আসলে এই মোবাইলের যুগে পড়ার ধৈর্যটা আমাদেরও তো কমে গেছে,সেখানে ছোটদের কি করে দোষ দিই? পূজাবার্ষিকীর মানও কি একরকম আছে? না বোধহয়। কিছু ভালো কিন্তু হচ্ছে।সেভাবে পৌঁছাতে হয়তো পারছে না।

ছেলেবেলায় আমাদের বাড়ির এক অদ্ভুত নিয়ম ছিল। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি। দিদাও পুজোর আগে কলকাতায় চলে আসত। রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। যে সবার আগে খাওয়া শেষ করবে সে ছুটে গিয়ে যে বইটায় আগে হাত দেবে, সে আগে সেই বইটা শেষ করার সুযোগ পাবে। এতে আমরা ছোটরা খুব রেগে যেতাম কারণ আমাদের বইয়ে সবাই ভাগ বসায়, অথচ বড়দের বইয়ে আমাদের নো এন্ট্রি। কী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ফেলুদা, ঋজুদা, কাকাবাবু সন্তু, অর্জুন, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, এমন কত ভালো ভালো লেখার জন্য। আসলে আমাদের ছেলেবেলার একটা বিরাট অংশ জুড়ে ছিল পূজাবার্ষিকী। এখন সেভাবে আর বই পড়া হয় কই? কে জানে এটা ভালো না খারাপ?

আর যেটা না হলে  আমার পুজো অধরাই থেকে যেত, সেটা হল গান, পুজোর গান। বেশ ছোট তখন, তাও মনে আছে, বাবা একটা বুকলেট নিয়ে আসত শারদ অর্ঘ্যের।সেখান থেকে মা আর আমি  বাছতাম কি কি রেকর্ড কেনা হবে। অফিস ফেরত যেদিন বাবা ওগুলো নিয়ে ঢুকত, সে এক অদ্ভুত উন্মাদনা, ধুকপুকানি। একে একে ঘুরছে তারা আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, কখনো ‘ কি লিখি তোমায় ‘ কিংবা ‘আজ তবে এইটুকু থাক’,কখনো বা ‘ এক তাজমহল গড়ো ‘,’ তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়,’ সারাদিন তোমায় ভেবে’,’ চল রীণা’, ‘আমি খাতার পাতায়,’,’ লজ্জা মরি মরি একি লজ্জা’,’’ওই মৌসুমি বন’,’’শেষ দেখা সেই রাতে’,’’যেতে দাও আমায় ডেকোনা’,’’ পায়ের চিহ্ন নিয়ে’,-এর মত বিখ্যাত গান আজ যারা কালজয়ী।  কখনো বা রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ ভালবেসে যদি সুখ নাহি ‘। একদম অন্যরকম এক কন্ঠস্বরে শুনলাম ‘ আমি এক যাযাবর ‘।রেকর্ড থেকে যখন সেইসব কন্ঠস্বরগুলো বেরিয়ে আসত, সে যে এক কি মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করত,তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। রেকর্ড আর রেকর্ড প্লেয়ার, বাবা ও ভাইয়ের দৌলতে আজ ও অটুট। আজও আমার পুজোর অনেকখানি সময় কাটে তাদের নিয়ে।

বেশ খানিকটা বড় হয়ে শুনলাম ‘ প্রথমত আমি তোমাকে চাই ‘,’ প্রিয়তমা’, এমন আরো বেশ কিছু গান। মনের ভেতরটা পুরো নাড়িয়ে দিয়ে গেল সেই গান। এমন সহজ সাবলীল, রোজকার কথা বলার ভাষায়, জীবনের নিত্যদিনের ওঠাপড়া উঠে এল সেই গানে। ছোট্ট একটা Two in One এ পুরো পুজো বুঁদ হয়ে শুনলাম সেই গান।

 রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি,কোনোকিছুই আর নেই এখন। এখন Singles এর যুগ। পুজোর গান হিসেবে তেমন কিছু আর মনে দাগ কাটেনা। সবকিছুই হাতের মুঠোয়।অনায়াসে গান রেকর্ডিং হয়ে যায়।কিন্তু শুনবে কে? শ্রোতার চেয়ে গায়ক গায়িকার সংখ্যা তো বেশি। তবু সঙ্গীতের একজন ছাত্রী হিসেবে এক বুক আশা নিয়ে বসে আছি। বাংলা মৌলিক গানের সুদিন আবার ফিরবে। আবার গানেরা  কালজয়ী হয়ে উঠবে। পুজোর গানের ডালি নিয়ে হাজির হবে আমাদের পরের প্রজন্মের শিল্পীরা।

পুজো আছে পুজোতেই। উৎসাহ আছে খুব কিন্তু আবেগ কতটা আছে বোঝা ভার। তার চেয়ে অনেক বেশি আছে প্রতিযোগিতা। আসলে সময়ের বদলকে মেনে নিতেই হয়, মানিয়েও নিতে হয়। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাই আমরা সবাই। সেই প্রবাহে ভাসতে ভাসতে যেমন কুড়িয়ে পাই নুড়ি পাথর,তেমন মণিমুক্তোও কুড়িয়ে পাই কখনো সখনো।বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদনার পারদ হয়তো কমে, কিন্তু  পুজো আসছে ভেবে মনটা কি আন্দোলিত হয় না কি? হয়, কিন্তু সময় ও বয়স উচ্ছাস কমিয়ে আনে। ভিড়ের মধ্যেও একলা হতে মন চায়। কাছের মানুষদের কাছে পেতে মন চায়। ইচ্ছে করে, ছুটির দিনগুলো দিব্য আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দি।বই পড়ি, গান শুনি, ক্লান্ত চোখে ঘুমিয়ে পড়ি। ক্লান্তিরও একটা ভালো থাকা আছে,সেই ক্লান্তি সুখেই ভালো থাকি পুজোর দিনগুলো।

কেন জানিনা, খুব মনে হয় এত ভিড়ে, এত আতিশয্যে, মা দুর্গাও বোধহয় খুব ক্লান্ত। তাঁকেও একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশটুকু দিতে পারিনা আমরা?

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

যুগ্ম সহযোগী সম্পাদক : অঙ্কুশ দাস 

প্রথম বর্ষ । শারদ প্রকাশ । ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *