Jibansmriti Archive

কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ১

শিল্পী হিরণ মিত্রের হাতে তুলি, সামনে সাদা কাগজ আর কল্পনায় বিস্তৃত সাদা চাদরের ওপরে এক বাদামি নারী। সে নারীর দেহে নানান গতিময় রেখা অনুভব করেন শিল্পী আর মসীরেখায় আবদ্ধ হয় সেই গতি। ‘শরীর রেখা’ কথাচিত্রের শুরুতেই এক সাদা শূন্য দৃশ্যপট, যেন রেখার জন্যই অপেক্ষমান কিংবা তা যেন শিল্পী বর্ণিত সাদা চাদরেরই চিত্ররূপ। সেই সাদা শূন্যতায় ধীরে ধীরে অস্তিত্বের সঞ্চার হয়, রেখার আধারে নির্মিত হয় নারী অবয়ব। শূন্যতার মধ্যে প্রকাশ পায় পূর্ণতার ইঙ্গিত – চলমান রেখাগুলি ক্রমশঃ গড়ে তোলে নারীদেহের সুডৌল গঠন। বিভিন্ন দেহ-ভঙ্গিমায় তৈরি হয় বিভিন্ন রেখার চলন। কখনও পিঠ থেকে রেখা নেমে আসে শিরদাঁড়া বেয়ে, কখনওবা নিতম্ব থেকে জানুর দিকে প্রবাহিত হয় রেখা। ক্রমশঃ এই রেখার বিন্যাসে ‘সম্মোহিত’ হন শিল্পী। 

       কাগজের সঙ্গে তুলি-কালির এক অদ্ভুত সম্পর্ক রচিত হয়ে একের পর এক আকারের এই হয়ে ওঠাকে অর্থাৎ শূন্য পটের ওপর অস্তিত্ব নির্মাণের সৃষ্টিক্ষণ গুলিকে নিপুণভাবে লেন্সে আটকে রাখেন পরিচালক অরিন্দম সাহা সরদার। শিল্পীর কথা আর চিত্ররচনা একসঙ্গে মিলে গিয়ে তৈরী হয়েছে অরিন্দমের কথাচিত্র ‘শরীর রেখা’। এই চল-চিত্রে এক শিল্পীকে নিরীক্ষণ করেছেন আরেক শিল্পী। এক শিল্পী তার চেতনের গহন অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা রেখার চলনকে অনুসরণ করেছেন, রেখার সঙ্গে রেখার মিলনে জন্ম নিয়েছে অজস্র চিত্রসন্তান। আর অপর শিল্পী সেই অনুসরণকে তার লেন্সে প্রতিফলিত করে তৈরী করেছেন চেতনার অন্তরে অনুসন্ধানের এক কাব্যিক রূপ। চিত্ররূপের সঙ্গে বাস্তব অবয়বের মন্তাজ মিলিয়ে দিয়েছে মনশ্চক্ষু এবং বাস্তব প্রত্যক্ষের উভয় রূপ।

        রেখা এগিয়ে চলে তার সারল্য নিয়ে, সৃষ্টি হয় নারী অবয়বের নানা বিভঙ্গ। অজস্র বিন্দু মিলে যেমন একেকটি রেখার জন্ম হয় তেমনই চিত্রকরের সামনে ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলি ছবি থেকে উঠে আসে কল্পনার এক সম্মিলিত রূপ। খন্ড খন্ড আকারের মধ্যে তৈরী হওয়া পূর্ণ রূপের আভাস দর্শককে আবিষ্ট করে। ‘শরীর-রেখা’ কথাচিত্রের যে দৃশ্যতে ক্যামেরা শিল্পীর মাথার পেছন দিক থেকে ধীরে ধীরে কিছুটা ওপরে উঠে ক্যাপচার করে অনেকগুলি রেখচিত্রকে, সেখানে দর্শকের সামনে স্রষ্টার অস্তিত্ব মিলে যায় তার সৃষ্টির সঙ্গে। পরিচালক একই ফ্রেমে যেন ভাবনার উৎস এবং তার প্রকাশকে উপস্থাপিত করেন। শিল্পীর বয়ানেও উঠে আসে সেই কথা – “শরীর রেখা এক চিত্রভুবন তৈরী করে আর আমিও সেই ভুবনের বাসিন্দা হয়ে উঠলাম।”

        চিত্রী মগ্ন থাকেন রেখার যাদুতে আর চল-চিত্রে দেখা যায় এক অন্য আলোর যাদু। সেই আলোর খেলায় তুলির টানের সঙ্গে সরে সরে যায় শিল্পীর শরীরের ছায়া। নারী শরীরের ধার ঘেঁষে তৈরী হওয়া কনট্যুর যেমন বিভিন্ন আকারের জন্ম দিচ্ছে তেমনই এই আলো শিল্পীর নিজের ছায়াকেও মিলিয়ে দিয়েছে তার সৃষ্ট রেখাগুলির সঙ্গে। এ যেন চিত্রকরেরই এক সত্ত্বা যা ক্রমাগত রেখার ঘূর্ণনে নারী দেহের বিভিন্ন আকারকে আবিষ্কার করে চলেছে, যেখানে জুড়ে আছে ‘কোনো এক বোধ’।

        ‘রেখা নগ্ন’- যা চিত্রিত করেছে নগ্ন দেহরূপ। ‘The Nude’ বইতে Kenneth Clark লিখলেন – “To be naked is simply to be without clothes, whereas the nude is a form of art.” আবার John Berger এর মতে- “To be naked is to be oneself…To be naked is to be without disguise.” অর্থাৎ নগ্নতার মধ্যে নেই কোনো ছদ্মবেশ। নগ্নতার মধ্যেই ব্যক্তির পূর্ণ অস্তিত্ব। এ নগ্নতার যৌন আবেদনও তার অস্তিত্বের মতোই সৎ। প্রকৃতির বিস্তারে যেমন আরোপিত বলে কিছু হয় না তেমনই এই যৌনতার আকর্ষণ প্রাকৃতিকভাবে সত্য। এ যৌনতার কোনো লজ্জা নেই|  লজ্জা একটি সামাজিক ধারণা, যা আরোপিত। এই আরোপিত ধারণার উর্দ্ধে মনের আনাচে কাজ করে অন্য ‘কোনো এক বোধ’- 

‘শুধু মোর দেহের তালাশে 

শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে

এ-মাটির ‘পরে

আসিব কি নেমে !’

কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ২

    ১৯৩৪ এ পরাবাস্তববাদী শিল্পী Rene Magritte ‘Violence’ শীর্ষক যে ছবিটি আঁকেন তার মধ্যে দেখা যায় দুটি স্তন যেন বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয়। এ ছবিও নগ্নতার মধ্য দিয়েই, নিগৃহীত যৌনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। দর্শকের চেতনার জগতকে আলোড়িত করে। আবার তারই ‘Act Of Violence’  শীর্ষক ছবিতে উন্মুক্ত জানালার একপাশে থাকে নারীদেহের নগ্ন টরসো আর আরেকদিকে থাকে এক ফালি সুনীল আকাশ। এখানেও প্রকৃতির সারল্য, নির্মলতার পাশেই অবস্থান করে নারীদেহ। শুধু দেহ-বোধ নয়, এই দেহকল্প ভূমে ভালোবাসারও সৃজন হয়। ‘শরীর-রেখা’য় শিল্পী হিরণ মিত্রের চিত্রকল্পে রয়েছে যৌনতা নয়, আছে সেই প্রেমের স্পর্শ। রেখার সঙ্গে রেখার প্রেম। যে প্রেম দেহের সীমা ছাড়িয়ে প্রকৃতির বিস্তারে মিলে যায়। রেখার চলন আর কথার বুনোটে শিল্পী উন্মোচিত করেন নারীর দেহসৌষ্ঠবে প্রকৃতির দ্যোতনা যা একাধারে Ecofeminism এর নির্যাসকে প্রতিফলিত করে। নারীদেহ থেকে উৎসারিত রেখা যেন স্পর্শ করে প্রকৃতির বিভিন্ন ভূমিরূপকে। আর শিল্পী হিরণ মিত্রের এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় অরিন্দম সাহা সরদারের কথাচিত্র। এখানে আলোছায়ার সমাপতন এবং অঙ্কিত  চিত্ররূপের সঙ্গে বাস্তব আলোকচিত্রের মন্তাজ, শিল্পী-মনের অবচেতনে কল্পনার প্রতিফলনকে এক লিরিক্যাল ভঙ্গিমায় আবদ্ধ করেছে। শিল্পী হিরণ মিত্রের তুলি-কালির কাব্যময়তা ধীরে ধীরে পর্দায় শেষ হয় যোগ রাগের শান্ত, সমাহিত সুরমূর্ছনায়। যোগ রাগের সঙ্গীত শ্রোতার বাস্তব অস্তিত্বের সঙ্গে যেন আত্মার সংযোগ ঘটায়, আর এই কথাচিত্রেও উপস্থাপিত হয় রেখার সঙ্গে রেখার যোগে কিভাবে নির্মিত হয়েছে বাস্তবের সঙ্গে শিল্পীমনের কাব্যময় সংযোগ।

কথাচিত্রের লিংক : https://youtu.be/BwKcj2EpEcA

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা

হিরণ মিত্রের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রকাশ – ৪ । ১১ জুলাই ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *