নৌকার মাল্লার কোল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঝপাস করে পড়ে গেলেন এক কোমর কাদায়। মাল্লাটিও পড়ল তাঁর ঘাড়ে।
রাত এগারোটায় গঙ্গার ঘাটে সে এক রোমহর্ষক দৃশ্য। হাওড়ায়।
শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ সদলবলে আসছেন কলকাতায়। সেখানে দু–তিন দিন থেকে যাবেন শিলঙে।
এটা ১৯১৯–এর অক্টোবরের ঘটনা। তখনও আজকের রবীন্দ্র সেতু তৈরি হয়নি। কলকাতা আর হাওড়ার মধ্যে যোগাযোগের জন্য ছিল পন্টুন ব্রিজ। বাংলায় যাকে বলে নৌকা সেতু। কিন্তু বড় বড় জাহাজগুলো যখন উত্তরদিকে যেত, সেতুর মাঝের কয়েকখানা নৌকা সরিয়ে নেওয়া হত। সেসময় সেতুর উপর চলাচল বন্ধ, লোকে সরকারি স্টিমার বা ভাড়া নৌকায় গঙ্গা পারাপার করত। রবীন্দ্রনাথ ভাড়া নৌকায় গঙ্গা পার হবার জন্য ঘাটে এলেন। তারপরের ঘটনা রানুকে লিখছেন তিনি : ‘মালপত্র ঘাড়ে নিয়ে ঘাটে গেলাম। সবে জোয়ার এসেচে— ডিঙ্গি নৌকা ঘাট থেকে একটু তফাতে। একটা মাল্লা এসে আমাকে আড়কোলা করে তুলে নিয়ে চলল। নৌকার কাছাকাছি এসে আমাকে সুদ্ধ ঝপাস করে পড়ে গেল। আমার সেই ঝোলা কাপড় নিয়ে সেই খানে জলে কাদায় লুটোপুটি ব্যাপার। গঙ্গা মৃত্তিকায় লিপ্ত এবং গঙ্গাজলে অভিষিক্ত হয়ে নিশীথ রাত্রে বাড়ি এসে পৌঁচানো গেল।’
এর চার দিন পর ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। লক্ষ্মীপুজোর বিকেলে কলকাতা থেকে শিলঙ পাহাড়ের পথে রওনা দিলেন। সঙ্গে আছেন রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ, কমলাদেবী আর কবির ব্যক্তিগত ভৃত্য সাধুচরণ।
সান্তাহার স্টেশনে পৌঁছে তাঁরা চড়ে বসলেন আসাম মেলে। কবি লিখছেন : ‘সান্তাহার স্টেশনে আসাম মেলে চড়লুম, এমনি কষে ঝাঁকানি দিতে লাগল যে, দেহের রস–রক্ত যদি হত দই, তাহলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রাণটা তার থেকে মাখন হয়ে ছেড়ে বেরিয়ে আসত।’
ব্রহ্মপুত্র নদের এপারের স্টেশন আমিনগাঁও। সেখানেই তাঁদের নামতে হল। তখনও ব্রহ্মপুত্রের উপরে ব্রিজ তৈরি হয়নি। নদী পার হবার জন্য আবার তাঁরা সদলবলে নৌকায় উঠলেন।
এদিকে হয়েছে আরেক কাণ্ড!
রথীন্দ্রনাথ তাঁদের পুরানো মিনার্ভা গাড়িটি বিক্রি করে কিছুদিন আগেই কিনেছিলেন একটি নতুন গাড়ি। তারা যেদিন ট্রেনে গৌহাটি রওনা দিলেন, তার দুই দিন আগে বনমালী পারুই আর অন্য একজন ভৃত্য সেই গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন গৌহাটির উদ্দেশে। কবির ইচ্ছে সেই গাড়িতে করে শিলঙ পাহাড়ে চড়বেন। কিন্তু গৌহাটিতে পৌঁছে তাঁদের অপেক্ষা করে থাকতে হল, কারণ, ‘ওপারে গিয়েই মোটর গাড়িতে চড়ব বলে খেয়ে দেয়ে সেজে গুজে গুছিয়ে–গাছিয়ে বসে আছি— গিয়ে শুনি, ব্রহ্মপুত্রে বন্যা এসেচে বলে এখনো ঘাটে মোটর নামাতে পারেনি।’
তখন শিলঙ যাবার পাহাড়ী পথ ছিল সংকীর্ণ। নির্দিষ্ট সময়ে গৌহাটি থেকে শিলঙে মোটর গাড়ি নিয়ে যাত্রা করতে হত, উল্টো দিকেও সময় ঠিক করা ছিল।দুপুর দুটোর পর গৌহাটি থেকে মোটর ছাড়তে দেবে না। অথচ তাঁদের গাড়ি এসে পৌঁছাল আড়াইটায়।
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছিল। স্নানাহার করতে হবে। বিশেষ করে স্নান। তীরের কাছে একটা শূন্য জাহাজ বাঁধা ছিল। সেটাতে উঠে মুটের সাহায্যে কয়েক বালতি ব্রহ্মপুত্রের জল তুলিয়ে আনা হল। সেই স্নানের কৌতুকময় বর্ণনা কবির কলমে: ‘ভূগোলে পড়া গেচে পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল, কিন্তু বন্যার ব্রহ্মপুত্রের ঘোলা স্রোতে সেদিন তিনভাগ স্থল এক ভাগ জল। তাতে দেহ স্নিগ্ধ হল বটে কিন্তু নির্মল হল বলতে পারিনে। বোলপুর থেকে রাত্রি এগারটার সময় হাওড়ার তীরে কাদার মধ্যে পড়ে যেমন গঙ্গাস্নান হয়েছিল, সেদিন ব্রহ্মপুত্রের জলে স্নানটাও তেমনি পঙ্কিল।’
স্নান তো হল। এবারে তো রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সন্ধানে সবাই মোটর গাড়িতে চড়ে বসলেন। লক্ষ্য গৌহাটি শহর। কিছু দূর গিয়ে সেই নতুন গাড়ি নড়েও না, চড়েও না। বিকল্প ব্যবস্থা করে শহরে পৌঁছালেন। একটা ডাকবাংলোয় গিয়ে দেখেন সেখানে লোকের ভিড়। একটা মাত্র ঘর খালি। তাতেই থাকতে হবে এই পাঁচজনকে। তাই থাকলেন। রাতটা একরকম কেটে গেল।
পরের দিন সকাল পৌনে আটটার সময় অতি কষ্টে জোগাড় করা একটা ভাড়ার গাড়িতে তাঁরা শিলঙে রওনা দিলেন। কবি জানাচ্ছেন: ‘রথী গিয়ে নানা লোকের কাছে কাকুতি মিনতি করে সেটা ঠিক করে এসেচেন। ভাড়া লাগবে একশো পঁচিশ টাকা যা আমাদের হাতি কেনার চেয়ে বেশী।’
যাবার সময় চোখে পড়ল রাস্তার পাশে তাদের মোটরগাড়িটি খারাপ হয়ে পড়ে আছে। সেই গাড়িতেই রয়ে গেছে গরম পোষাকসহ দরকারি জিনিসপত্র। রাণুকে লিখছেন কবি: ‘জিনিস রইল পড়ে। আমরা এগিয়ে চললুম। বিদেশে, বিশেষত শীতের দেশে, জিনিসে–মানুষে বিচ্ছেদ সুখকর নয়। যা হোক, শিলঙ পাহাড়ে এসে দেখি, পাহাড়টা ঠিক আছে, আমাদের গ্রহ বৈগুণ্যে বাঁকেনি চোরেনি, নড়ে যায়নি, দেখে আশ্চর্য বোধ হল, এখনও পাহাড়টা ঠিক আছে।’
এই প্রথম ‘শেষের কবিতা’র শিলঙ পাহাড়ে পা রাখলেন কবি। এরপরেও আরও দুবার এসেছেন। দ্বিতীয় বারে লিখেছেন ‘রক্তকরবী’, শিলঙ পাহাড়ে বসেই।
তিন–তিনবার যে শৈলশহরে পা রেখেছেন, থেকেছেন তিনি, সেখানে তাঁর জন্য কোনও সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেনি কেউ। ব্যক্তিগতভাবে কবি সন্দর্শন করেছেন অনেকেই, কিন্তু মঞ্চের আলোয় ফুলের অর্ঘ্যে নোবেল জয়ী কবিকে বরণ করে নেওয়ার কথা ভাবেইনি শিলং পাহাড়!
ঋণ: রবীন্দ্রনাথ এবং শৈলাবাস শিলঙ/ মালবিকা বিশারদ
শুভাশিস চক্রবর্তী শিক্ষক, প্রাবন্ধিক এবং অহর্নিশ পত্রিকার সম্পাদক
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ, নয়। লেখা চাই। আরও ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা চাই।