Jibansmriti Archive

হিরণ মিত্রের রেখাচিত্র । কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ১

একজন নারীর দেহ কি শুধুই জৈবিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমষ্টি? শুধুই মাংসপিণ্ডে গঠিত কাঁধ, স্তন, কোমর, ঊরু, নিতম্ব, পা ; এই দেহাংশগুলিই কি একজন নারীকে সংজ্ঞায়িত করে? নাকি এই শরীর, তার রেখা ও ভাঁজ, জৈব কাঠামোর সীমা অতিক্রম করে তার অস্তিত্বের এক বোধ এনে দেয়? ভোগবাদী ও বস্তুনির্ভর সমাজে, আমরা যা দেখি, অথবা, বলা ভালো, মিডিয়া আমাদের যা দেখায়, তাই-ই গ্রহণ করে নিই চোখ বুজে। আমাদের নিজস্ব সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলি এই দেখার অভ্যাসে। কল্পনার জায়গা, নিজের ভাবনার অবকাশ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে। ফলে, পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপনের ভাষায় নারীদেহ রূপ নেয় ‘পুরুষ চোখ’-এর চাহিদার এক বস্তুগত প্রতিফলনে।

এই প্রেক্ষাপটে, যখন আমি প্রথম দেখলাম অরিন্দম সাহা সরদারের নির্মিত চলমান কথাচিত্র ‘শরীর রেখা’, তখন এক নারী হিসেবে আমার ভিতরে নানা প্রশ্ন, অনুভব, ও উপলব্ধির ঢেউ খেলতে থাকে। এই বিশ্বায়নের জগতে, যেখানে আমাদের সকল ইচ্ছের দ্রুত পূরণ হওয়া চাই,  সেখানে এই কথাচিত্র আমায় যেন থমকে দাঁড়াতে বলে। অরিন্দমের ক্যামেরা আমাদের সামনে এক নারীর শরীরকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেখানে সেই শরীর মিশে যায় অসংখ্য নারীর অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের সম্মিলনে। তবুও সে তার নিজস্ব স্বর হারায় না; বরং শিল্পের পরম্পরায় সে পুনরাবিষ্কৃত হয়, এক নতুন ব্যঞ্জনায়।

কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ২

এই কথাচিত্র নির্মিত হয়েছে চিত্রকর হিরণ মিত্রের ভাবনা ও তাঁর তুলিতে আঁকা নারীর দেহভঙ্গিমার ওপর ভিত্তি করে। তাঁর চিত্রভাষায় নারীদেহ যেভাবে ধরা পড়েছে, তা-ই চলচ্চিত্রটির মূল ভিত্তি। একজন রক্ত-মাংসের নগ্ন নারীর দেহরেখা কীভাবে শিল্পীর তুলির স্পর্শে এক ভাবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়, এবং সেই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় শিল্পী কীভাবে নিজেকেও আবিষ্কার করেন, সেটাই এই কথাচিত্রের কেন্দ্রীয় বয়ান।

চলচ্চিত্রটি শুরু হয় কোয়েলি সরকারের মাধুর্যময় কণ্ঠে রাগ ‘যোগ’-এর আলাপ দিয়ে। এই সঙ্গীত প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, কেন এমন এক মুহূর্তে ধ্রুপদী রাগ, তাও আবার ‘যোগ’এর ব্যবহার ? সঙ্গীততত্ত্বের দৃষ্টিতে, মার্গসঙ্গীত আমাদের দৈনন্দিন ইন্দ্রিয়জ জগতের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছে দেয়। রাগের সুর আমাদের অন্তর্জগতের গভীরে এক আত্মিক সংযোগ তৈরি করে।

কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ৩

রাগ ‘যোগ’-এর সৌন্দর্য নিহিত তার রেশ ও ভাবগাম্ভীর্যে। ‘যোগ’ শব্দটি এসেছে ‘যোগী’ শব্দ থেকে, যার অর্থ সংযুক্তি, মিলন। এই রাগ এক আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা থেকে যাত্রা শুরু করে এক প্রগাঢ় মিলনের আবহে পৌঁছায়। নারী কণ্ঠে এই রাগের আলাপ কথাচিত্রে এক অভিন্ন মাত্রা যোগ করে, যেখানে নারীদেহ কেবল বস্তুগত নয়, বরং চিত্রকরের তুলির টানে আত্মিক এক উপস্থাপনায় জেগে ওঠে। এই ব্যবহার যেন আমাদের বলে, রাগ ‘যোগ’ এখানে  শিল্প ও শিল্পীর মিলনের এক ভাষ্য। যেমন একজন কণ্ঠশিল্পী তাঁর সুরে নিজেকে বিলীন করে দেন প্রকৃতির সঙ্গে, তেমনই চিত্রকরও তাঁর স্ট্রোকে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দেন তাঁর শিল্পে।

হিরণ মিত্রের রেখাচিত্র । কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ৪

এই একাত্মতার প্রকাশ আমরা দেখি হিরণ মিত্রের গভীর আত্মমগ্ন উচ্চারণে । তাঁর  উচ্চারণের ভঙ্গিমা এমন, যেন তিনি দর্শকের উদ্দেশ্যে কিছু বলছেন না; বরং নিজের ভিতরকার এক স্পর্শযোগ্য ভাবনার সঙ্গে কথা বলছেন একান্তে। আমরা দেখি, তিনি একটি টুলে বসে, নিচু হয়ে একাগ্র মনে আঁচড় টেনে চলেছেন। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে নগ্ন নারীর বিভিন্ন অঙ্কন, যাদের তিনি অন্বেষণ করছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। যেন তাঁদের বুঝতে, অনুভব করতে, তিনি এক ধ্যানস্থ শিল্পসাধনায় মগ্ন।

চিত্রনির্মাতা এই শিল্পীসত্তাকে ঘিরে তৈরি করেছেন এক ঝাপসা হলুদ আলোর আবহ। এই আলোয় ঘেরা ঘরে যখন ছবিগুলি ফোকাসে আসে, মনে হয় যেন এক অনুভবের স্তরে প্রবেশ করছি, যা স্বচ্ছ আলোয় ধরা দেয় না। ক্যামেরা এক ছবির রেখা থেকে আরেকটির মধ্যে ক্রমশ ডিসলভ করছে, ক্রমাগত গতি ধরে রেখেই, যেন শিল্পীর স্ট্রোক ও দৃষ্টির মতোই এক অন্তহীন অনুসন্ধানে সেও নিয়োজিত।

হিরণ মিত্রের রেখাচিত্র । কথাচিত্রের একটি স্থিরচিত্র : ৫

কখনো কখনো, যখন ক্যামেরা সরাসরি শিল্পীর মুখাবয়বে স্থির হয়, তখন হলুদ আলো বিবর্ণ হয়ে সাদা-কালোর এক মিশ্র আবহে পরিণত হয়। এই সাদা-কালোর আভা যেন দর্শকদের এক অনুভবযোগ্য অথচ অধরা সত্যের সামনে দাঁড় করায়। আমরা দেখি, শিল্পী ও মডেল দুজনেই এই আলোয় অবগাহন করছেন, যেন চিত্রাঙ্কনের বাইরেও এক আন্তরিক উপলব্ধিতে তাঁরা জড়িয়ে পড়েছেন। মডেল কেবল আর এক দেহমাত্র নন, তিনি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন শিল্পীর দৃষ্টিতে।

এই আলো ও চিত্রভাষার সম্মিলনে আমাদের মনে হয়, শিল্পী ও মডেল এক নতুন বাস্তবতায় একে অপরকে খুঁজে পাচ্ছেন। এই মিলনের জন্য কোনো রঙের প্রয়োজন নেই, কেবল আত্মার সংযোগই মুখ্য। এই নিঃশব্দ সংলাপেই সাদা-কালোর আলো আমাদের সামনে উন্মোচন করে এক নিরাভরণ সত্য, যা সব মুখোশ ও আবরণের ঊর্ধ্বে।

এই ঝাপসা আলোয় আমরা দেখি নারী মডেলের দেহভাঁজ— স্তন, কোমর, জানু, নিতম্ব— যা কাছ থেকেও একরকম অধরা। অথচ আলো যেন স্বাভাবিক নিয়মে সেই ভাঁজগুলিকে উন্মোচিত করে তোলে, প্রতিটি রেখায় ফুটে ওঠে অনাবিল সৌন্দর্য।

চিত্রকর হিরণ মিত্র

কথাচিত্রের লিংক : https://youtu.be/BwKcj2EpEcA

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক : যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার (অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ) এবং বিয়াস ঘোষ (সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ)

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা

হিরণ মিত্রের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রকাশ – ৪ । ১১ জুলাই ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *