Jibansmriti Archive

Quick,something big is there!

বেবুন পরিবার । ছবি – রাজদীপ দেব

মনের সুখে এক বেবুন পরিবারের খুনসুটির ছবি তুলছিলাম,হঠাৎ তাড়া লাগাল রাফায়েল,আমাদের সারথি।গত চারদিনের অভিজ্ঞতায় এটা বুঝে গেছি যে এই আদেশের অর্থ হল অতুলনীয় কিছুর সাক্ষী হওয়ার সুযোগ। তাই ঝটপট ক্যামেরা গুটিয়ে নিলাম,ল্যান্ড রোভার ছুটল।

আসলে পুজোর শহরে আগাগোড়া পড়ে থাকা একটা দুর্বিসহ ব্যাপার। তাই মা দুর্গাকে একটু হাই-হ্যালো করেই পায়ের তলায় সর্ষে,এটাই থাকে রুটিন।তবে কিনা এবার আমাদের বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল মহালয়ার দুদিন পরেই,ফিরতে ফিরতে এক্সটেন্ডেড বিসর্জনটাও মিটে যাবে,তাই মনটা একটু খচখচ করছিল। ভিড়ভাট্টা নিয়ে যতই নাক উঁচু হইনা কেন, বাঙালি হয়ে পুজোর টান একেবারে এড়িয়ে যাওয়া না-মুমকিন।কিন্তু প্রলোভনটা ছিল বিশাল।সেই কোন ছোট ক্লাসে শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সায়েন্স সিটিতে। স্পেস থিয়েটারে দেখেছিলাম সেরেঙ্গেটি জঙ্গলের অ্যানিমাল মাইগ্রেশন।সে এক ধুন্ধুমার ব্যাপার।মনের কোণে তখন থেকেই গেঁথে ছিল চাক্ষুষ করার অদম্য বাসনা।তাই সুযোগ আসতে সেই আহ্বান গ্রহণ করলাম দুগ্গা দুগ্গা বলেই।

তবে কিনা যাওয়ার হ্যাপা কম নয়।প্রথমে মুম্বই, তারপর নাইরোবি,সেখান থেকে তৃতীয় ফ্লাইট ধরে তানজানিয়ার আরুশা শহরের কিলিমাঞ্জারো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট।আকাশে মেঘ থাকায় কিলিমাঞ্জারো পর্বত শৃঙ্গ দেখা দিল না কিন্তু নাম মাহাত্ম্যতেই নিজেকে কেমন শঙ্কর-শঙ্কর বোধ হতে লাগলো।

এয়ারপোর্টে “নমস্তে” বলে স্বাগত জানাল আমাদের তানজানিয়ান গাইড তথা সারথি হিন্দি সিনেমার পোকা রাফায়েল। ওখানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত টানা সাফারি। প্যাকড ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ মজুত করার জন্য সাফারির ল্যান্ড রোভারে ছোট ফ্রিজ রয়েছে। আর আছে বিন ব্যাগ,বাইনোকুলার এবং কমিউনিটি রেডিওসেট।

প্রথম গন্তব্য তারাঙ্গিরে ন্যাশনাল পার্ক।সে এক অদ্ভুত জগৎ।নীল আকাশের নিচে রুক্ষ দিগন্ত বিস্তৃত ঘাসজমি,মাঝে মাঝে ফ্ল্যাট-টপ অ্যাকাশিয়া আর পেল্লায় পেল্লায় বাওবাব গাছ।ফলে দৃষ্টি বাধাহীন।সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে দলেদলে উইলডেবিস্ট, জেব্রা,জিরাফ, বিভিন্ন প্রজাতির অ্যান্টিলোপ, হরেক রকম পাখি, কাকে ছেড়ে কাকে দেখি।

তবে প্রধান আকর্ষণ হল আফ্রিকার বিগ ফাইভ: লায়ন, লেপার্ড, এলিফ্যান্ট, রাইনো, কেপড বাফেলো।কেউ নিরাশ করেনি।এক চিতাবাঘ শিকার ধরতে আমাদের সামনেই দৌড়দৌড়ি করলেন,ঠিক যেন বিদ্যুতের চমক।কেপড বাফেলোকে দেখে মহিষাসুরের কথা মনে পড়ে গেল।এখানকার হাতিরা আমাদের হাতিদের চেয়ে অনেক স্লিম,ইয়া বড় বড় দাঁত তাদের।কেবল একটি গণ্ডারকে দেখতে পেলাম গোরঙ্গরো ক্রেটারে।চোরাশিকারের কারণে তাদের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে শুনে মন ভারাক্রান্ত হল।লেক মানিয়ারা গিয়ে দেখি জল গোলাপি…আসলে হাজারে হাজারে ফ্লেমিঙ্গো লেক জুড়ে।উটপাখির দৌড় থেকে পাইথন,গোল্ডেন ক্র্যাব থেকে আগামা লিজার্ড,কিছুই বাদ গেল না।দেখলাম বিশাল আকারের নাইল ক্রোকোডাইল,সে তখন এক উইলডেবিস্টের মাথা ধরে জলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।সেরেঙ্গেটির দিঘিতে দেখি ৫০-৬০টি জলহস্তি খেলায় মত্ত।হরিণ মেরে গাছের ডালে বসে ভোজ সারছে সিংহি, কাদায় আটকে পড়া জেব্রার মৃত্যুর অপেক্ষায় ওৎ পেতে রয়েছে শিকারি পাখি।আর দেখলাম মাইগ্রেশন।তখন বেলা পড়ে এসেছে,অস্তগামী সূর্যের আলোয় চরাচর লালচে। দিগন্তরেখা জুড়ে এগিয়ে চলেছে অসংখ্য প্রাণীর সিলুয়েট।মাসাইমারা থেকে রিটার্ন মাইগ্রেশন চলছে।সেই অনির্বচনীয় দৃশ্য ভাষাতীত। বেলুন রাইডের সময় সেই ছবি ধরা দিল অন্য রূপে।পাখির চোখে সেরেঙ্গেটির জীবজগৎ।

মহিষাসুর । ছবি – রাজদীপ দেব
জোড়া জেব্রা । ছবি – রাজদীপ দেব

মাসাই গ্রাম ভ্রমণে গিয়ে তাদের লোকনৃত্যের তালে পা মেলালাম।কী লম্বা চেহারা আর কী কঠিন জীবনযাত্রা।

মাসাই লোকনৃত্য । ছবি – রাজদীপ দেব

তবে কিনা সবচেয়ে বড় চমক অপেক্ষা করছিল রাফায়েলের ওই তাড়া দেওয়াটায়।

তিরবেগে গিয়ে গাড়ি যেখানে থামল সেখানে দেখি পশুরাজ সদ্য শিকার করা উইলডেবিস্ট দিয়ে প্রাতরাশ সারছেন।আমাদের থেকে দূরত্ব মোটামুটি ২০ ফিট মতো হবে।আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ৩ রানি এবং ৫ রাজপুত্র-রাজকন্যা,তাদের পালা আসার অপেক্ষায়।খানিক দূরত্ব রেখে ঝাঁক বেঁধে দাঁড়িয়ে হায়েনার দল,রাজপরিবারের ভোজ মিটলে তারা প্রসাদ পাবে।এক রানি আমাদের গাড়ির চাকা ঘেঁষে ঘুরে আগন্তুকদের মেপে গেলেন,মনে হলনা খুব প্রসন্ন।রাজামশাই ধীরে ধীরে শিকারের বুক-পেট খেয়ে এবার পিঠের চামড়া ছাড়াতে শুরু করলেন।সত্যি বলতে কী,শাটার টিপতে যেন ভুলে যাচ্ছি এই দৃশ্যের সামনে,যেন অ্যানিমাল প্ল্যানেট চলছে।প্রায় ঘন্টাখানেক পর খেয়াল হল,আজ তো অষ্টমী।আড়াই ঘণ্টার তফাতে বাংলায় এখন পুষ্পাঞ্জলি চলার কথা।মায়ের মুখ তো দেখা হয়নি,যেন ওনার কৃপাতেই বাহন বাবাজি স্বমহিমায় দর্শন দিলেন।নিজের অজান্তেই জোড় হাত কপালে উঠে এল।

ফ্ল্যাট-টপ অ্যাকেশিয়া । ছবি – রাজদীপ দেব

ডাঃ রাজদীপ দেব

পড়াশোনা: শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ

নিবাস এবং কর্মস্থল: শ্রীরামপুর

পেশা: চিকিৎসক

নেশা: ভ্রমণ,ছবি তোলা,নাটক এবং সিনেমা দেখা,নতুন নতুন জায়গায় বিভিন্ন রকমের খাবার চেখে দেখা

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫

4 Responses

  1. এককথায় অনবদ্য।মনে হল টুক করে একটু আফ্রিকা টা ঘুরে এলাম ।খুব প্রাণবন্ত লেখা। আরও ভালো লেখ,আমরাও তোর চোখ দিয়ে একটু দেখে নি।

  2. নতুন এই প্রচেষ্টার আন্তরিক সাফল্য কামনা করি। ছবি ও লেখনী খুবই প্রানবন্ত। আরও নতুন সংযোজন এর অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply to তাপস দেব Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *