
বর্তমানে বাঙালি সমাজে কাঁথা সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে অধিকাংশই বলে ‘সেটা কী ?’, মধ্যবয়সীদের মধ্যে কেউ কেউ বলে ‘আমার জ্যাঠাইমা / দিদিমা / ঠাকুমাকে দেখেছি কাঁথা সেলাই করতে’। অধিকাংশ আবার বলে ‘ও কাঁথা-শাড়ি ? দিব্যি দেখেছি। অনেক দাম’। এইসব শুনলে বড়ো কষ্ট হয়। বাঙালি তার নিজের ঐতিহ্যই জানেনা। খোঁজও রাখেনা। বাজারে বিকল্প প্রচুর ছেয়ে গেছে। কাঁথা সম্পর্কে আমারও যথেষ্ট সচেতনতা ছিল না। আমার দু-তিন বছর বয়সের স্মৃতিতে আছে মা মামার বাড়ির মাটির দাওয়ায় বসে মামার বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে কাঁথা সেলাই করতেন। দেখেছি উঠোনে রোদে কাঁথা ঝুলত। জ্বর জ্বালায় ডবল কাঁথার ওমে দিব্যি ঘুমিয়েছি। কিন্তু কোথাও কাঁথার নকশা চোখেও পড়েনি। ন’বছর বয়সে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে ভর্তি হয়েছিলাম। বাস্তবে অবশ্য কাউকে কাঁথা সেলাই, এমনকি সাধারণ ব্যবহার্য কাঁথাও সেলাই করতে দেখিনি।
শৈশব থেকেই ছবি আঁকতে বড় ভালোবাসতাম, তাও আবার লুকিয়ে। লেখাপড়ায় আমি বড়োদের হিসাবে – ‘ খুবই দুর্বল ছিলাম ‘। ছুটিতে বাড়ি গেলে মারধোর জুটতো। যদিও আমি নিজের পছন্দের বই পড়তে বেশি ভালোবাসতাম। সেই সাথে বিভিন্ন বিষয় জানার জন্য নিজের ভেতরে খুব কৌতূহল বোধ করতাম। আমার যা কিছুই নিজের মতন করে করতে ইচ্ছে করতো তা সকলের চোখের আড়ালেই করতাম।
পাঠভবনের শিল্প-শিক্ষা এবং শান্তিনিকেতনের উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির গভীর প্রভাব পড়েছে আমার ‘পরে। পরে গভর্মেন্ট আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট কলেজের পশ্চিমী শিল্পচর্চার প্রভাব আমার শিল্প চেতনাকে মিশ্রভাবে প্রভাবিত করেছিল। কলকাতা কলেজের ক্রাফ্ট বিভাগেও কাঁথা চর্চার জায়গা ছিল না। অতএব তখনও কাঁথা আমার অপরিচিত।

বিয়ের আগে যতটুকু শিল্পচর্চার সুযোগ ঘটেছিল, তা এক শিল্পী বন্ধুকে বিয়ে করে, অর্থাভাব, সংসারের দায় ও সন্তান পালন সহ চাকরির চাপে আমার পড়াশোনা এবং ছবি আঁকা দুটোই প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আমার স্বামী শিল্পজগতের মূল স্রোতে গা ভাসালেও, শিল্পজগৎ থেকে আমার প্রায় নির্বাসন ঘটল। সংসার না ভেঙ্গেও বড়ো একলা হয়ে গেলাম। স্কুল জীবনে শিল্প-শিক্ষা কালে আমার শিল্প সচেতনতাকে আগলে রেখেছিলাম একাই। শিক্ষকতার মধ্যেই গবেষণার মানসিকতা নিয়ে ছাত্রীদের মনের ভেতরের শিল্প সচেতনতা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দিতে এক নতুন পর্ব শুরু করেছিলাম। অক্লান্ত চেষ্টায় একাই গবেষণা চালাতে থাকি। বলতে দ্বিধা নেই তৎকালীন স্কুল কর্তৃপক্ষেরও যথেষ্ট সমর্থন পেয়েছি। আমার নিজের শৈশব-কৈশোরের বঞ্চনার অভিজ্ঞতা থেকে আমি সচেতন ছিলাম যে, বাংলা জুড়ে সব প্রান্তের সব বয়সের ছেলেমেয়েদের শিল্প-শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থার চরম অবহেলা, অবজ্ঞা ও অজ্ঞতার অসুখ বিরাজ করছে। ফলে আমার উদ্যোগ ছিল ওই বিরাজিত অসুখ থেকে আরোগ্য লাভের উপায় আবিষ্কার। এ বিষয়ে আজও আমার গবেষণা ও শিক্ষকতা অব্যাহতই।
১৯৮৩ সালে অদ্ভুতভাবে আমার জীবনে কাঁথার আবির্ভাব ঘটল। যেন হঠাৎই এক বেদম ধাক্কায় আমার অন্তরে আবদ্ধ সৃজন সত্ত্বার দরজাটা ভেঙে গেল। যেন আমার দ্বিতীয় জন্ম হল। আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলাম। আমি মনে করি শিল্প চেতনার আধার জীবন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। জীবন যুদ্ধে শিল্পচর্চাই সাহস জোগায়। শিল্পকে ব্যাখ্যা করতে গেলে জীবন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে উপেক্ষা করা যায় না। শৈল্পিক যাত্রা জীবনের ঘাত প্রতিঘাত, আনন্দ আবেগ হলো এক একটা মাইলস্টোন।
ছোটো থেকেই প্রবঞ্জনা ও প্রতিকূলতা আমাকে মানসিক ভাবে একলা করে দিয়েছিল। তাই বোধহয় কাঁথা শৈলীকে হৃদয়ে সাদরে আলিঙ্গন করতে পেরেছি। যুগ যুগ ধরে কাঁথার শৈলীর প্রাচীনাদের জীবনের সাথে একাত্ম হতে পেরেছি। আমার চতুর্পাশে আমাকে কাঁথা সেলাই শেখানোর তো কেউ ছিল না। আমার গবেষণাই আমার একমাত্র একান্ত উপজীব্য। অতএব বিগত যুগের প্রাচীনারাই আমার গুরু।
আমার মা প্রচুর বিদেশী সেলাই ফোঁড়াই জানতেন। কেবল অসুবিধা বলতে ছিল তিনি আঁকতে জানতেন না। আমি শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পরে আঁকা-জোকাগুলো করে দিতাম। আমার সন্তান সম্ভবা হওয়ার খবর জানতে পেরে মায়ের ইচ্ছে হয় কিছু নকশা আঁকা ছোট কাঁথা করবেন। আমি কিছু এঁকে দিয়েছিলাম। মায়ের হাতের গুণে সেগুলো ভালোই দেখতে হয়েছিল। সেই সময় আমার পরিচিতা এক শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী মায়ের কাঁথা সেলাই দেখে খুব লোভাতুর হয়েছিল। তার জন্যেও কিছু আঁকা-আঁকি করে দিই। কিন্তু মানুষ কত অকৃতজ্ঞ! সেই প্রাক্তনী গোপনে ব্যবসা পাতানোয় আমার পরিবারে ফাটল ধরলো। একই সময়, আমার স্বামীর নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে তাঁর এক বন্ধু আমার করা ষোলটা পাঞ্জাবীতে সূক্ষ্ম কাঁথা সেলাইয়ের আঁকা ডিজাইন চুরি করে নেয়। চুরি বা হাতিয়ে নেবার এমন সভ্য চোরের সঙ্গে আমার আগে কখনও পরিচয় হয়নি।

যাইহোক, আমার মনে প্রশ্ন জাগল যে, কাঁথার মৌলিক চরিত্র কি, যা নিয়ে এত মাতামাতি, আমার করা ডিজাইন নিয়ে এত টানাটানি ? নিজের অজ্ঞতা অতিক্রম করতে জাদুঘরগুলিতে যাওয়া শুরু করলাম। উপলব্ধি করলাম সাধারণের ধারণায় ‘ক্যাঁতা’-র মধ্যে কাঁথার পরিচয় সীমাবদ্ধ নয়। তার যে বিশাল ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে অপরিমেয় শিল্পশৈলীর বৈশিষ্ট্য আছে। জাদুঘরগুলিতে বিস্ময়ের শেষ ছিল না। একান্তে ডুব দিলাম গবেষণায়। আমারই দেশে আমারই বাংলার মাটিতে যে অপূর্ব শিল্প সৃষ্টি হয়েছিল অধিকাংশ বাঙালি তা জানেই না। নিজের অজ্ঞতার লজ্জা আর কোথায় রাখি! শুরু করলাম ঘন্টার পর ঘন্টা জাদুঘরে আত্মমগ্ন হয়ে কাঁথার সামনে দাঁড়িয়ে সুতোদের লুকোচুরির পথ খুঁজে চলা। স্কেচ পেন দিয়ে আঁকতাম আর বাড়ি এসে কাপড়ে নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতাম। ছোটবেলার মতো সমালোচনাও শুনতে হতো – ‘সংসার ফেলে কী করছিস ?’

মা অনেক সেলাই জানলেও, স্তরীভূত কাঁথা সেলাই করলেও, নকশী কাঁথা কখনও দেখেননি। কাঁথা সম্পর্কে আর পাঁচজনের মতোই তাঁর ধারণা ছিল। কলাভবনে তো কাউকে কাঁথা সেলাই করতেই দেখিনি। জাদুঘরগুলোতে আমার প্রত্যক্ষ কাঁথার গবেষণা ক্রমেই ফোঁড়ের নমুনা সংগ্রহের নেশায় পরিণত হল। এই সময় আত্মীয়-স্বজনদের গায়ে লক্ষ্য করলাম ও শুনলাম যে, ফ্যাশন বাজারে এরকম দামি শাড়ির ঢল নেমেছে। যার নাম ‘কাঁথা ফোঁড়ের শাড়ি’ বা ‘কাঁথা-শাড়ি’। চাক্ষুষ দেখার পরে খটকা লাগল। জানলাম এইসব শাড়ি যারা তৈরি করছেন তারা রীতিমতো উৎপাদন কেন্দ্র খুলে বসেছেন। তাঁরা শান্তিনিকেতনের কলাভবনের আমার অনেক আগের অর্থাৎ আমার সিনিয়র প্রাক্তনী। অথচ সেখানে আদৌ কখনো কাঁথা সেলাইয়ের প্রচলনই ছিল না! তাহলে তাঁরা কাঁথা সেলাইয়ের নামে কী বেচছেন? এক ফেরতা পাতলা কাপড়ে কী করে কাঁথা সেলাই সম্ভব? প্রথমত, কাঁথা স্তরীভূত কাপড়ে তৈরি ও স্তর ধরে রাখতে ফোঁড়ের চরিত্রই আলাদা। উৎপাদনী লক্ষ্য ও সৃজনশীলতা তো এক নয়! দ্বিতীয়ত, কাঁথা তো শাড়ির মতো পড়া যায় না এবং তার ব্যবহারের উদ্দেশ্যও আলাদা। বুঝলাম এ এক ভয়ংকর প্রবঞ্চনা। সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই যে, মানুষের মন ও স্মৃতি থেকে আমাদের এক ঐতিহ্যময় সমৃদ্ধ ইতিহাসকে মুছে দেওয়া হচ্ছে। ‘কাঁথা-শাড়ি’ তো প্লাস্টিকের পাথর বাটির মতন শোনাচ্ছে। উপলব্ধি করলাম এই মুহূর্তে আমার একার পক্ষে এর প্রতিবাদ করার সাধ্য নেই। অতএব আমাকে আমার গবেষণার আরও অতল গভীরে ডুব দিতে হবে। যার লক্ষ্য একদিকে যেমন থাকবে কাঁথা শৈলীর মহা সম্পদকে জনমানসে তুলে ধরা, আর অপরদিকে কাঁথা শিল্পীদের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক সম্পর্ককে বোঝা সহ বর্তমান শিল্প দুনিয়ায় তার অবস্থানকে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিষ্ঠা করা ও শৈলীর পুনরুদ্ধার। উপলব্ধি করলাম, আমার জীবনে কাঁথার আবির্ভাব হঠাৎ শখের জন্য উদয় হয়নি। মানুষের নির্লিপ্ততা, অবজ্ঞা ও প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিটা ফোঁড় যেন প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠতে পারে । এরপরও আমার চর্চা যত প্রকাশ্যে এসেছে তত প্রতিবন্ধকতা সহ সহমর্মিতার অভাব এবং বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু কোনও পরিস্থিতিই আমার শিক্ষকসত্ত্বা ও সৃজন চেতনাকে দমিয়ে দিতে পারেনি। বরং আমার জেদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ কাঁথা আমার জীবনকে দিশা দেখিয়েছে। আমার আত্মদর্শন গড়ে উঠেছে, নিজে শেখা এবং অপরকে শেখানোর মাধ্যমে। ক্রমাগত অনাবিষ্কৃতকে খুঁজতে থাকা । এটাই সৃজনশীলতা।

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫
খুবই ভালো লাগলো, লেখার সাথে, কাঁথার, অসাধারণ কাজের ছবিগুলো। আমি ও কাঁথা শিল্পের ভক্ত। আপনার পরবর্তী লেখার আশায় রইলাম।
পড়তে ভালো লাগছে ❤️❤️