
সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ
সালটা ছিল ১৯৪২। তার ঠিক এক বছর আগে কানন দেবী নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে চুক্তি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। এরপরের বছরটি তিনি কোনও সিনেমা বা গানের কাজ পাচ্ছিলেন না। এমন সময়েই একদিন তাঁর দেখা হয় চিত্রপরিচালক ও অভিনেতা প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে। কয়েক বছর আগেই তাঁরা একসঙ্গে ১৯৩৭ সালে ‘মুক্তি’ সিনেমায় অভিনয় করে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাই যখন বড়ুয়া এম. পি. প্রোডাকশনের পক্ষ থেকে নতুন ছবি ‘শেষ উত্তর’-এর প্রস্তাব নিয়ে আসেন, কানন দেবী আগ্রহের সঙ্গেই রাজি হয়ে যান।
১৯৪২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শেষ উত্তর’ চলচ্চিত্রটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তবে এই ছবির একটি বিশেষ গান আজও বাঙালির মনে নস্টালজিয়ার আবেশ ছড়িয়ে রেখেছে— গানটি ‘আমি বনফুল গো’। এই গানের সুরকার ছিলেন কমল দাশগুপ্ত এবং গীতিকার প্রণব রায়। আজও এই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং রিয়্যালিটি শোতে নতুনভাবে পরিবেশিত হয়। তবে কানন দেবীর কণ্ঠে এই গানটি একটি বিশেষ সময়কে প্রতিফলিত করে— সেই সময়, যখন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে বাঙালি আধুনিকতার দর্শনকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টায় ছিল। সেই চিন্তার ছাপ যে শিল্প-সংস্কৃতিতেও পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এই গানে কাননের কণ্ঠ সেই সময়কালীন আধুনিক ভাবনার একটি নিদর্শন হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রের কাহিনির সঙ্গে গানটিকে যথাযথভাবে সংযুক্ত করেছেন বড়ুয়া। সিনেমাটিতে কানন দেবী অভিনয় করেছেন ‘মীনা’ নামে এক গ্রাম্য নারীর ভূমিকায়। তাঁকে একজন সহজ, বিনয়ী ও যত্নপরায়ণা নারী হিসেবে তুলে ধরা হয়। ঘটনাচক্রে মীনার প্রেম হয় জমিদার মনোজের সঙ্গে, যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বড়ুয়া নিজেই। কিন্তু মনোজের বাগদত্তা হিসেবে অনেক আগেই স্থির করা হয়েছে রেবাকে । রেবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন যমুনা বড়ুয়া। রেবা চরিত্রটি মীনার সম্পূর্ণ বিপরীত— তিনি একজন উচ্চশ্রেণির শিক্ষিতা, কঠোর মনোভাবাপন্ন, বুদ্ধিমতী ও নারীবাদী মহিলা।
গানটি শুরু হওয়ার ঠিক আগে রেবাকে দেখা যায় এক রেডিও স্টেশনে বক্তৃতা দিচ্ছেন, যেখানে তিনি বলছেন, “আমরা নতুন যুগের নারী, আমরা আর অন্ধকারের মধ্যে বনফুল হয়ে থাকতে চাই না।” এই কথার ঠিক পরেই মীনার চরিত্রে কানন গানটি গাইতে শুরু করেন। গানটির লিরিক্স নীচে দেওয়া হল-

সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ
এই গানের কথা সাধারণভাবে দেখতে গেলে একটি গ্রাম্য, প্রাকৃতিক পরিবেশের আবহকে প্রকাশ করে । এর কাব্যিক ছন্দে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে ঘিরে এক ধরনের রোমান্টিকতার প্রকাশ দেখা যায়। এখানে একটি নারীকেই কেন্দ্র করে রাখা হয়েছে। এবং সে চিত্রিত করছে একটি গ্রাম্য জলা জংলা পরিবেশ যার বিপরীতে রয়েছে চল্লিশের দশকের নতুন গড়ে ওঠা আধুনিক নাগরিক পরিবেশ।
এই দুই বিপরীত ধারার দ্বন্দ্ব গানটিকে বিশেষ করে তোলে। রেবার মতো উচ্চশিক্ষিত নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করা শহুরে নারীর পাশে দেখা যায় মীনার মতো গ্রাম্য নারীদের অবস্থান। কিন্তু গানটির কথা যদি একটু মন দিয়ে শোনা যায়, তাহলে কি দেখা যায় না যে এখানেও এক ধরনের নারীর স্বাধীন চেতনার প্রকাশ ঘটছে?
যেমন ধরা যাক: ‘লতার কোলে চাঁদনি রাতে বাসর জাগি চাঁদের সাথে’, অথবা ‘ভোরের বেলা নয়ন কোনে দোলে শিশির দুল গো’। এই লাইনগুলিতে কোথাও সরাসরি নারী স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি, তবুও একটি নারীর স্বাধীন উচ্ছ্বাস, আনন্দময় মন, প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক, এইসবই যেন উঠে আসে। এই ব্যাখ্যায় বলা যায়, রেবার নারীবাদ যদি হয় শহুরে যুক্তিনির্ভর নাগরিক পরিসরে গড়ে ওঠা, তবে মীনার চরিত্রটি বিশেষ করে এই গানটিতে হয়ে উঠেছে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করা এক স্বাধীন নারীর প্রতিমূর্তি।

সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ
তবে চিত্রায়নে দেখা যায়, কানন দেবী গানটি গাওয়ার সময় নিজেকে স্ক্রিনে উপস্থাপন করেছেন এক মার্জিত, শান্ত, বিনীত ভঙ্গিতে। তাঁর দেহভঙ্গিমা ছিল অতি সংযত। বেশির ভাগ সময় তিনি একটি জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে গানটি পরিবেশন করেন। গানটির কথায় যে উচ্ছ্বলতা ও স্বাধীনতার ইঙ্গিত রয়েছে , তার প্রতিফলন কাননের মুখভঙ্গি বা অঙ্গভঙ্গিতে ধরা পড়ে না।
এছাড়াও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গানটির সুর এবং কাননের কণ্ঠস্বর। কমল দাশগুপ্ত এখানে অর্কেস্ট্রাল অ্যারেঞ্জমেন্টে গ্রামীণ গানের স্বাভাবিক বাদ্যযন্ত্র যেমন দোতারা বা ঢোল ব্যবহার করেননি। বরং মার্জিতভাবে তবলা, হারমোনিয়াম ও অর্গান ব্যবহৃত হয়েছে— যেগুলি মূলত আধুনিক গানেই বেশি দেখা যায়। এই কারণে সুরে একটি সাধারণত্ব থাকলেও তা গ্রাম্যতাকে প্রকাশ করে না। বরং সুরটি যেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটি সংমিশ্রণ।
কানন দেবীর কণ্ঠস্বরেও কোনও লোকসংগীতের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না। তাঁর কন্ঠস্বরের পরিধি লোকগীতির ভঙ্গিমায় উচ্চ নোটে যায় না। বরং হাফনোট, টাচনোট এবং কোথাও কোথাও মীর ব্যবহার করে তিনি সূক্ষ্ম কারুকাজ ফুটিয়ে তোলেন। বাংলার আধুনিক গানে এই রকম সূক্ষ্ম অলঙ্কার ব্যবহার কাননের গায়কির বিশেষত্ব। উচ্চাঙ্গসংগীতের ভোকাল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার না করেও যে নিখুঁত নান্দনিকতা তৈরি করা যায়, কাননের কণ্ঠ তার উদাহরণ। বলা চলে, এই সূক্ষ্ম গায়কির ভঙ্গি তিরিশের দশক থেকে গড়ে ওঠা নতুন ধারার বাংলা আধুনিক গানের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়— যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং অভ্যন্তরীণ ভাবনার প্রকাশকে গুরুত্ব দেয়।
এই জায়গায় এসে প্রশ্ন ওঠে, গানটির কথা ও তার আবহ যদি গ্রামীণ আবেগকে প্রকাশ করে, তবে কাননের গায়কিভঙ্গি ও গানটির সুর কি তার বিপরীতে শহুরে আধুনিকতাকে তুলে ধরে না?
এই লেখাটি তাই আমি কিছু প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই। গানটিতে যে গ্রাম্যতার ছবি আঁকা হয়েছে, সেটি কি বাস্তবিক গ্রামের পরিবেশ, নাকি শহরের চোখে কল্পিত এক গ্রাম্যতা? গানটির সুর ও কণ্ঠ কি শহুরে রুচির অনুসারে এক ধরনের রোমান্টিক গ্রাম্যতাকে নির্মাণ করে নেয়নি? এই দ্বৈততা, কথার মধ্যে গ্রামীণ রোমান্টিকতা এবং সুর ও কণ্ঠে শহুরে মার্জিত আধুনিকতা, গানটিকে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। তাই গানটি তার সুর, কথা ও কন্ঠের দিক থেকে অনেক স্তরযুক্ত এবং ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়ের সদ্য গড়ে ওঠা আধুনিক সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য।

সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ
গানের লিংক : https://youtu.be/QIMV6LRovIE?si=JKcuHitjJ5lTerPL
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫
Very informative and interesting article to read about.