Jibansmriti Archive

নিজেকে খুঁজতে গিয়ে একজন তার পারিপার্শ্বিক মানুষজনকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। কারণ, মানুষ যেমন একদিকে একাকী তেমনি অন্য দিকে তার জীবন যাপন সমাজের অঙ্গ, তাকে এড়িয়ে বেঁচে থাকার যাত্রাপথ সম্পূর্ণ হতে পারে না। শিল্পী ও শিল্পের এ এক অপরিহার্যতা— এই রকম ধ্যান-ধারণা থেকেই রাজা সেন বিস্তর কাজ করেছেন, যা এক একটা সামাজিক দর্পন।

আত্মীয়স্বজন রাজা সেন এর দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। এক নগর কেন্দ্রিক পরিবারের কাহিনি।  সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস থেকে এই সিনেমা চিত্রিত হয়ে দর্শকদের সামনে আসে গত শতকের একেবারে শেষে নিরানব্বই সালে। এই সিনেমাটির জন্যেও তাঁকে রাষ্ট্রিয় পুরস্কার প্রদান করা হয়।

প্রচারপত্র, সামনের দিক
সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ

সিনেমার গল্প এই রকম—

অধ্যাপক বুদ্ধদেব রিটায়ার করেছেন। তাঁর তিন ছেলে প্রতিষ্ঠিত ও দুই মেয়ে বিবাহিতা। স্ত্রী মনোরমা।  জীবনের শেষ দিকে এসে বুদ্ধবাবুর মনে হয় তাঁর পরিবার, সমাজ ও জীবন থেকে আর কিছু প্রত্যাশা নেই। একই বাড়িতে থেকেও ছেলেরা যেন পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী  হয়ে যাচ্ছে।  হঠাৎ দুই মেয়ের জীবনে নেমে আসে দুই রকমের বিপর্যয়। এমতাবস্থায় তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে আত্মহননের পথে এগিয়ে যান মুক্তির জন্য। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে বেঁচে যান মনোরমা। সংসারকে ভুল বুঝে চলে যাওয়া স্বামীর ভাবনার বিপরীতে  মনোরমার পরিবারের প্রতি ভালোবাসার দর্শনে সিনেমা শেষ হয়।

বর্তমানে সামাজিক মাধ্যমে ‘রিল’ সাম্রাজ্যের জয়-জয়কার। রিলের দৈর্ঘ্য যেভাবে ক্রমাগত ছোট হতে থাকছে অদূর ভবিষ্যতে এক শব্দের কবিতা হয়ে যেতে পারে। সে যা-হোক। এগুলো স্বীকার করে নিয়েও সেই সত্যটা অখণ্ড— যে-কোন শিল্প একটু সময় দাবি করে, না হলে তার সত্তা বোঝা যায় না। রাজা সেন আত্মীয়স্বজন শুরু করেন গান দিয়ে। সাথে কাস্টিং। পর্দায় আলো ছায়ার খেলায় ছায়াই বেশি। শুধুমাত্র চরিত্রগুলো সামান্য আলোকিত থাকে। পরিচালক দর্শককে ধাতস্ত হতে সময় দেন। দর্শককে তৈরি হতে সময় দেন। এর সাথে সাথে সময় নেন। কাস্টিং শেষে রত্নার বাড়িতে প্রবেশের পর এক এক শটে এক এক চরিত্রের পরিচয় হয়ে যায় ডায়ালগের ব্যবহারে এবং সেই অন্ধকার আর আলোর অনুপাত পরিবর্তিত হতে থাকে একটু একটু করে। সব শেষে কাহিনির প্রধান চরিত্র রত্নার দাদু-ঠাম্মির ঘরে পর্দা জুড়ে অনেকটা আলো। এতক্ষণে পুরো বাড়িটার মানুষগুলো সম্বন্ধে একটা সার্বিক রূপ দর্শক পেয়ে গেছে। আর অন্ধকার নেই।

গত শতকে নয়ের দশকে যে ক’টা প্রধান বিষয় সমাজ সচেতক নাগরিকদের ভাবিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম থ্যালাসেমিয়া। রক্তপরীক্ষা না করে শুধুমাত্র ঠিকুজি-কুষ্ঠী মেলানো যে সাজানো বাগান শুকিয়ে দিতে পারে সেই বার্তাটুকু চারিয়ে দিতে পরিচালক এতটুকু পিছপা হন না। সমাজকেই যেন চিনছেন প্রশ্ন করছেন উত্তর খোঁজায় দর্শককে উদ্যোগী করছেন। প্রতিষ্ঠিত হবার মাপকাঠি কি রাত্রে এক পেগ? সেটা ভালো না খারাপ? পড়াশোনার লাভ লোকসান কি অর্থ দিয়ে  আর পদ মর্যাদা দিয়ে মাপা যায়? সমাজের কাছে ঠিক কী কী থাকলে ও না থাকলে ‘প্রেসটিজ’ থাকে? মরণ শ্যাম না ব্যাধ?—এই রকম বহুধাগামী চিন্তা সঙ্গীতের তানপুরার মতো সুর ধরে রাখে। অথচ এই প্রশ্নগুলো সরাসরি এইভাবে পরিচালক না জিজ্ঞাসা করেছেন, না পোস্টারে লিখে পর্দায় দেখিয়েছেন। শুধুমাত্র প্রেক্ষিত কথোপকথন আর সম্পাদনায় চিন্তক তৈরি করেছে দর্শককে।

রাজা সেন যখন পূর্ণাঙ্গ সিনেমায় হাত দিয়েছেন আস্তে আস্তে দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন বাংলা সিনেমার যোগ্য পরিচালকদের উত্তরসুরি হিসাবে। এর প্রধান কারণ স্বকীয়তা ও সিনেমার আঙ্গিককে র্দশকদের কাছে টেনে আনা। সিনেমার ইতিহাস সব মিলিয়ে একশ কুড়ি পঁচিশ সেখানে তাঁর বানানো সিনেমায় দর্শকদের আজও আকর্ষণ করে নিজস্বতার জন্যই। আত্মীয়স্বজন-এর বয়স পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত। অথচ এখনও আলোচিত তাঁর নিজস্ব কৌশলগত কারণেই।

প্রদীপ কাঁপতে কাঁপতে নিভে যাচ্ছে বা পাখি উড়ে গেল গাছ থেকে—এই ধরনের কোন সাহিত্যিক উপাদান মৃত্যু বোঝাতে আত্মীয়স্বজনে ব্যবহৃত হয়নি। সিনেমার বুদ্ধবাবুর চরিত্রের বেশিরভাগটাই পরিবারের সম্বন্ধে আক্ষেপে মৃত্যু কামনা। যখন পরিপাটি মৃত্যুর দিকে ধাবমান বুদ্ধদেব, তখন মৃত্যু পথযাত্রীর সাক্ষী হল চোখ। জীবন-অভিজ্ঞরা  বলেন মানুষের মন চোখে লেখা থাকে। সেই চোখের উপর আলাদা করে আলো পড়ে। তারপর চারপাশের আলো নিভে যায়। পর্দায় শুধুমাত্র মৃত্যুতে মুক্তিকামী বুদ্ধদেবের চোখ। যেভাবে অনুভূমিক পথে চোখের পাতা বন্ধ হয় সেইভাবে অল্প অল্প করে আলো কমতে কমতে শুধুমাত্র মধ্যেখানে আলোকিত হতে থাকে বুদ্ধদেবের চোখ দুটি এবং তারপর সব শেষ। ক্যামেরার সাথে বুদ্ধদেব ও তার সাথে দর্শক যেন আস্তে আস্তে চোখ বুজলো। এই শটটাই পরিচালকের পরিচয় বহন করে।

ক্রমশঃ

প্রচারপত্র, পিছনের দিক
সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫

2 Responses

  1. পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি আলোচনা করেছেছেন সুসাহিত্যিক শ্রী শুভাশিস আচার্য I বেশ ভাল I

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *