আষাঢ়ের ভরা পোয়াতি আকাশ। বৃষ্টির দমকে গঙ্গার উপরে কুয়াশার মতো মায়া ছড়িয়ে আছে। বেলুড় আশ্রমের ঘর থেকে দেখা যায় শত শত মাছ ধরার নৌকা– স্বামীজি কাজ ভুলে দেখেন জেলেদের ইলিশ ধরার আনন্দ। অসুস্থ শরীরে চিঠিপত্র লেখেন, তাতেও এসে যায় ইলিশ-উচ্ছ্বাস। মার্কিনি ভক্তকে বলেই ফেলেন, তাঁদের দেশের ইলিশের থেকে আমাদের ইলিশ অনেক সুস্বাদু। সেবার গঙ্গার একটা প্রমাণ মাপের ইলিশ কেনা হল। সেই মাছ দেখে স্বামী বিবেকানন্দ শিশুর মতো হয়ে গেলেন। প্রথমে প্রেমানন্দের সঙ্গে মাছের দাম নিয়ে বেশ রহস্য করে তারপর এক বাঙাল শিষ্যকে ডেকে বললেন, ‘তোরা নূতন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর’; একাদশী করে স্বামীজির নাকি খিদে খুব বেড়ে গেছে– হয়তো ইলিশানন্দে একটু মজা করতে ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। ‘আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন’- লিখেছেন স্বামী প্রেমানন্দ। দ্বিপ্রাহরিক এই তৃপ্ত ভোজন স্বামী বিবেকানন্দের অন্তিম আহার। সেই রাতে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণলোকে যাত্রা করলেন। সেটা ছিল জুলাই মাসের চার তারিখ, শুক্রবার, ১৯০২ সাল।
ব্রিটিশ প্রভুদের ভারতশাসনে ফুল বিছানো থাকলেও তাদের ইলিশপ্রেম তেমন জমেনি। কারণ ইলিশ-অভিসারের পথ কণ্টকাকীর্ণ! তাই শ্বেতচর্ম রাজেশ্বরদের এই স্বর্গীয় স্বাদের ভাগ দিতে বঙ্গদেশের কতিপয় অভিজাত হোটেলে পাওয়া যেত কণ্টক-মুক্ত ‘স্মোকড ইলিশ’। রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী এর বঙ্গীকরণ করেছিলেন ‘ধূমপক্ক ইলিশ’। রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেবেলা’-য় আবদুল মাঝির গল্প বলতে গিয়ে পদ্মানদী থেকে জ্যোতিদাদার জন্য নিয়ে আসা ইলিশ মাছের স্মৃতিচারণ করতে বিস্মৃত হননি। আবার তিনি ছড়ায় জানিয়েছেন: ‘ইলিশের ডিম ভাজে বঙ্কিম/ কাঁদে তিনকড়ি চট্ট।’ কোনও সবজান্তা যদি এই ‘চট্ট’ ব্যখ্যায় ‘তিনকড়ি’কে বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মীয় করেন, তবে কাঁটালপাড়ায় আলোড়ন উঠবে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। রবিবাবু তাঁর ‘খাপছাড়া’ বইটিতে মাছেদের ‘মুড’ বোঝার চেষ্টা করেছেন: ‘তিমি ওঠে গাঁ গাঁ করে, চিঁ চিঁ করে চিংড়ি/ ইলিশ বেহাগ ভাজে যেন মধু নিংড়ি।’ ছড়ার আপাত মজা ছেড়ে ‘সিরিয়স’ রবীন্দ্রনাথেও উঠে আসে রাজর্ষি মাছের উদাহরণ: ‘ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়- প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই সর্বনাশ।’
সেই কবে কোন কালিদাসের কালে জীমূতবাহন আর সর্বানন্দ ‘ইল্লিষ’-এর প্রশস্তি করে গেছেন। ইতিহাসবেত্তার কলমে সেটা দ্বাদশ শতক। সর্বানন্দের ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে আছে ইলিশ-তেলের কথা। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে একে ‘বলবর্দ্ধক’ বলে চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি এও বলা হয়েছে: ‘ইল্লিশো মধুর/ স্নিগ্ধ রোচনো।’ ইলিশ নাকি নিরামিষ মাছ! এক উদ্ভট শ্লোকের দাবি এমনই: ‘ইলিশো খলিশশ্চৈব…পঞ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ’– এখানে ইলিশ ছাড়াও আরও চারটি মৎস্যকে তালিকাভুক্ত করেছেন সেই উদারহৃদয় শ্লোকস্রষ্টা। মনসার-মাস শ্রাবণে চাঁদ সদাগরের ভৃত্য দুইভাই জালু ও মালু নদীতে হাজারো প্রচেষ্টায় কোনও মাছ পায় না। শেষে সর্পদেবীর স্তুতিফলে জাল ভরে ওঠে অগণ্য মাছে, ‘ইলশা ধরিল কাতলাগুটি’ (ক্ষেমানন্দ); আসলে পঞ্চদশ শতাব্দের বিজয়গুপ্ত, ষোড়শ শতাব্দের দ্বিজবংশীদাস হয়ে পলাশী-দেখা ভারতচন্দ্র রায়– মঙ্গলকাব্য জুড়ে ইলিশের মাঙ্গলিকী। বিজয়গুপ্তের রন্ধনশালায় ‘আনিয়া ইলিশ মৎস/ করিল ফালা ফালা/ তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন/ দক্ষিণ সাগর কলা’। তাঁর ‘পদ্মাপুরাণে’ তারকা নন্দাই লখিন্দরের জন্য ‘সরিষার শাক রান্ধে ইলিশার শিরে’। দ্বিজবংশীদাসের হেঁশেল থেকে সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে ‘ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা’র কারণে। মেদিনীপুরের রামেশ্বর চক্রবর্তীর ‘শিবকীর্তন’-এ কৃষক মহাদেব প্রেমের পরীক্ষা দিতে বর্ষার জলডুবু ধানক্ষেতে নেমে নানা ধরনের মাছ ধরছেন: ‘ভেটকি ইলিশ আড়ি মাগুর’ ইত্যাদি। রায়গুণান্বিত ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও ‘চিতল ভেটুক’-এর সঙ্গে ধরা পড়েছে তপসিয়া আর ‘ইলিশা’।
লাজুক মুখে নতুন জামাই দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। এবার তার ‘ইন্টারভিউ’! খুড়িশাশুড়ি গোত্রের কেউ ধাঁধা জিজ্ঞেস করবেন: “এবার বলো তো বাবাজীবন,
‘রূপোর পাতে মারে ঘা/ পানির বুকে ফেললে পা’, এর উত্তর কি হবে?” জামাই বলবে ‘ইলিশ’; সঠিক উত্তর দানে মিলল তার প্রবেশাধিকার। ইলিশ-পর্ব জামাইদের জীবনে এখানেই শেষ নয়। কুমিল্লা জেলায় বিজয়া দশমীর দিন ইলিশ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়। তাকে পিঁড়িতে বসিয়ে, কুলোর উপর মাছটি রেখে গান ধরেন এয়ো বধূরা: ‘…ইলিশ মাছ কাইন্দা বলে/ আমরা লো বড় সতী/ আমাগোরে খাইতে হইলে/ আনো কচুর লতি।’ ফরিদপুর, মাদারিপুর ও বিক্রমপুরের কিছু অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান সব পরিবারে জামাইয়ের প্রশংসা বা নিন্দা নির্ভর করে ইলিশের উপরে। শ্বশুরবাড়ি এসে সে একদিন বাজার থেকে ইলিশ কিনে আনবে, এটাই নিয়ম। মাছের আকার ছোট হলে ঠাকুমা-দিদিমাদের নিন্দা-ছড়া: ‘জামাই ইলিশ আনছে খাইবার লিগা?/ না চায়া চায়া দেখবার লিগা?’ এর সঙ্গে শ্যালক-শ্যালিকার ছড়ায় রসিকতা: ‘ট্যাকেতে নাই পয়সা/ জামাইবাবু আনছে ইলশা।’ ওই অঞ্চলে বিজয়া দশমীর দিন ইলিশের ডিম খাওয়ার রীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিবিড় সংস্কার। শারদপ্রাতে যদি ডিম না মেলে, এই আশঙ্কায় বর্ষাকালেই ইলিশের ডিম সংগ্রহ করে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করে রাখে তারা।
ইলিশ নিয়ে গান দুই বঙ্গে শুধু জনপ্রিয় নয়, রীতিমতো লোকাচারের অন্তর্ভুক্ত। পূবদেশে বিয়েবাড়িতে উনুনকে বরণ করার সময় মহিলাদের বন্দনাগীতি: ‘ইলিশ মাছ কাটে বউ/ ধার নাই বটি দিয়া/ ইলিশ মাছ রান্ধে বউ/ কচু বেগুন দিয়া।’ মেদিনীপুরে বিবাহ আচারে ‘কাঁদন গীত’ আবশ্যিক। বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নেবার সময় কনেকে কাঁদতে কাঁদতে গাইতে হয়: ‘ইলিশ মাছের চেতরা কাঁটা, দাদা গো…।’ আবার রাঢ় দেশে ইলিশ সহজলভ্য নয় তাই তারা ‘পোস্তপন্থী’। টুসুগানে উঠে আসে এর সমর্থন: ‘অ টুসু ইলিশ ইলিশ করিস না/ ইলিশ লিয়ে তুর লালসা মানায় না।/ গঙ্গা পদ্মায় যেমন ইলিশ মেলে/ রাঢ়েরা খুশি পুস্তু পেলে।’ এর সঙ্গে যেন মিলে যায় নিরামিষ আহারী বৈষ্ণবদের খেদোক্তি: ‘কেন মাইতবো ইলিশে/ পুস্ত আমার কম কিসে?’ ভাদুগানে টুসুর মতো পোস্তপন্থা না নিয়ে ভাদুকে দেওয়া হয়েছে ইলিশ-আশ্বাস: ‘ভাদ্রমাসে ভাদু খাবে ইলিশ/ গেলে পদ্মায় গঙ্গায়।’ পৌষ সংক্রান্তির দিন অথবা সরস্বতী পুজোর দিন নানা অঞ্চলে ইলিশ-কেন্দ্রিক লোকাচার আছে। জোড়া ইলিশ সিঁদুর-হলুদ মাখিয়ে, প্রদীপ জ্বেলে, ধান-দুব্বা সহযোগে বরণ করে ঘরে তোলা হয়। উলুধ্বনির সঙ্গে কোথাও আবার গানের রীতি আছে: ‘…ইলিশ মাছ হাইস্যা বলে/ খলসা মাছ রে ভাই/ তুই থাকস ঝাড় জঙ্গলে/ আমি পদ্মায় যাই…।’ বরণীয় ইলিশ কাটার পর তার আঁশগুলি ঘরের প্রধান খুঁটির নীচে পুঁতে রাখা হয় এই বিশ্বাসে– মেয়ের বিয়ের সময় এগুলো পয়সা হয়ে যাবে! নুরপুর, তারাগঞ্জে জেলেরা প্রথম যে ইলিশটিকে ধরে তার আঁশ কপালে টিপের মতো পরে।
গোপাল ভাঁড়কে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একবার বললেন: ‘গোপাল, তুমি নদীর পাড় থেকে একটা ইলিশ মাছ কিনে আমার দরবার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে আসবে, অথচ কেউ তোমাকে সেই ইলিশ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে পারবে না– এমন যদি পারো তাহলে তোমাকে আমি পুরস্কার দেব।’ গোপাল এক কথায় রাজি। তাকে পাহারায় থাকল মহারাজের অনুচর। এরপর কীভাবে গোপাল ভাঁড় সেই পুরস্কার জিতে নিল তা যে কোনও গোপাল-ভক্তই জানেন। রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের রম্যনাটক ‘কষ্টিপাথর’-এ বাবু নবীন এক টাকায় একজোড়া ইলিশ কিনে দর্শকদের দেখিয়ে বলছে: ‘রাজপুত্তুর মশাই রাজপুত্তুর। কী যে গড়ন যেন ননীর চাপ থেকে কেটে তুলেছে। দিব্বি দোহরা, একটু পাশ থেকে গোলাপীর আভা মাচ্চে।’ ১৮৯৭-এর এই নাটকের আশেপাশের সময়ে বঙ্গদেশের এক থিয়েটার-মালিক জনপ্রিয় থিয়েটারগুলোকে টেক্কা দিতে নাটক শেষে দর্শকদের উপহার দিতেন আস্ত একটা ইলিশ! সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ভাষ্য ছিল এরকম: ‘অভিনয় দেখিতে আসিবার সময় গৃহিণীকে বিশেষ করিয়া বলিয়া আসিবেন যেন শেষ রাত্রে উনানে আগুন দিয়া তৈল প্রস্তুত রাখেন। অভিনয় দেখিবার পর, বাড়ি গিয়া গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজা খাইয়া মন ও রসনায় তৃপ্তি সাধন করিবেন।’ রসরাজ অমৃতলাল বসু নাটক রচনার আগে নকশার জন্য নিয়মিত গান লিখতেন। অক্ষরবৃত্তে রচিত চোদ্দ পংক্তির একটি দুষ্প্রাপ্য অমৃত-কবিতা উদ্ধার করেছেন ‘ইলিশ পুরাণ’ গ্রন্থের লেখক দিগেন বর্মন। সম্পূর্ণ কবিতাটি ইলিশ গন্ধে মন মাতাল করে তুলতে পারে সহৃদয়-ইলিশ-সংবেদীকে: ”পাড়াতে কড়াতে কেহ মাছ ভাজে রাতে।/ রন্ধনে আনন্দ বাড়ে গন্ধে মন মাতে।।/ লাউপাতা সাথে ভাতে সর্ষেবাটা মাখা।/ সেই বোঝে মজা তার যার আছে চাখা।।/ ভাতে মেখে খাও যদি ইলিশের তেল।/ কাজে দেবে যেন কডলিভার অয়েল।।/ গরম গরম ভাজা খিচুড়ির সঙ্গে।/ বর্ষাকালে হর্ষে গালে তোলে লোকে বঙ্গে।।”
“…আকাশ-ভাঙা বর্ষণমুখর গহিন রাতে ষাঁড়াষাঁড়ির বান-ডাকা ফেনা ওগরানো নদীতে ইলিশের জাল ফেলে উদ্দাম চিৎকারে গান জুড়েছে কলিমদ্দি মাঝি। তার সঙ্গী দুজন দাঁড়ি কানাই আর ইয়ার আলী নাচ জুড়েছে হাত তুলে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে”– লিখেছেন আবদুল জব্বার। ১৯৬৯-এর জুলাই থেকে টানা একবছর সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার পাঠক অপেক্ষায় থাকতেন তাঁর ‘বাংলার চালচিত্র’ পড়ার জন্য। সেই ধারাবাহিকে এই রচনাটির শিরোনাম ছিল ‘মিঠেজল: রূপালী ইলিশ/ পাথর কালো জেলে’। জব্বার সাহেবের ‘ইলিশ মারির চর’ উপন্যাসকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র পরিপূরক বললে অতিশয়োক্তি হবে না। এই দুই গ্রন্থের পাশে বইয়ের তাকে রাখতে হবে সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’, আশিস মণ্ডলের ‘ইলিশের দিন’। বাংলাদেশের মঈনুল হাসান ও মোজাফফর হোসেনের সম্পাদনায় ‘কল্পে গল্পে ইলিশ’ বইটি মাছের মতোই আকর্ষণীয়: প্রমথনাথ বিশী, গুলজার, ইমদাদুল হক মিলন, শৈবাল মিত্রদের ইলিশ-গল্পের মায়াবী টান এই সংকলনে। তবে বাংলা সাহিত্যে ইলিশের প্রতি যথাযোগ্য সম্মাননা জ্ঞাপন করেছেন বুদ্ধদেব বসু। তাঁর ‘ইলিশ’ শীর্ষক সনেটের ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ কথাটি এখন প্রবাদ গোত্রভুক্ত। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের দুটি কবিতায় উঠে আসে ইলিশ-কথন: ‘জেলেরা ইলিশ মারে মারুক/ কাছে এসে দরদাম পাড়ুক/ এক হালি দুশো বিশ বলে/ দরদাম তবুও তো চলে’-তে জেলেজীবন ধরা পড়েছে, তেমনি দ্বিতীয়টিতে ‘ইলিশের নেতা জানে, ইলিশের ক্যাবিনেট জানে’ পংক্তিসমূহে রাজনৈতিক শ্লেষ অনন্য ‘শক্তি’-সাধনার উদাহরণ।
বু.ব-র ‘ভোজনশিল্পী বাঙালী’ রন্ধন-সাহিত্যের উজ্জ্বল শস্য। সেখানে ‘পঞ্চপদী ইলিশ’-এ মধুময় সুখাদ্য বিলাসের ইশারা পাবেন পাঠক। ইলিশের মুড়োর সঙ্গে স্নিগ্ধ লাউ, কাঁটা দিয়ে রাঁধা ঘন মুগডাল, কচি কুমড়োর সঙ্গে কালোজিরে দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল, ‘সর্ষপমণ্ডিত’ কলাপাতায় মোড়া পাতুরি, সবশেষে একটা ঠাণ্ডা অম্বল যেখানে কালোজিরে আর কাঁচালঙ্কার সঙ্গে ‘ইলিশের ওঁচা অংশ ল্যাজার দিকটা ভাসমান– রান্নার গুণে সেই অধমও’ হয়ে ওঠে উত্তম। রসিকেষু পরিমল গোস্বামী ১৯৭১-এর ৬ জুন আকাশবাণীতে ইলিশ বিষয়ক রম্যকথিকা পাঠ করেছিলেন: ‘গীতায় ভগবান বলেছেন যে আমাকে যে যেমনই ভজুক তাকে আমি তুষ্ট করি, আর আমাদের ইলিশ বলেন যে, যে যেমন করেই আমাকে ভাজুক, আমি তাকেই তুষ্ট করি।’ এই রসজ্ঞ লেখক তাঁর ‘স্মৃতি চিত্রণ’-এ জানিয়েছেন ‘ইলিশ মাছের লুকার বড়া’র কথা। দেশের বাড়িতে বাল্যকালে তাঁরা ভোর থাকতে নদীর পাড়ের মাছ-কাটারুদের কাছ থেকে কিনে আনতেন ‘লুকা’ (যকৃৎ)। প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা-ও ইলিশ-ভক্ত: ‘এক পা বাড়ালেই তো ডায়মণ্ডহারবার। ওখানকার ইলিশ…একবার মুখে দিলে আর ডায়মণ্ডহারবার ছাড়তে ইচ্ছে করবে না।’ ফাদার দ্যতিয়েন লিখেছেন অ্যান্টনি গোমেশের কথা যিনি বাঙালিদের মতোই ‘পান খেয়ে পিক ফেলেন আর ইলিশ-ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তোলেন।’ বুদ্ধদেব গুহর একটি গল্পের বইয়ের নাম ‘ইলিশ’, সেই সংকলনের প্রথম গল্পের নামও তাই– প্রধান চরিত্র নৃপেনবাবু ইলিশ স্মৃতির ‘তেলতেলে পিছুটানে’ জর্জরিত। এরই পাশে নবনীতা দেব সেন তুলেছেন মোক্ষম প্রশ্নটি: ‘জোড়া ইলিশ মাছের বদলে জোড়া কবিতার বই দিলে বেশি খুশি হবো কি আমরা?’
বহুঘাটের ইলিশ খেয়ে যশস্বী যমদত্তের উপলব্ধি: ‘পূবদেশের ইলিশে তেল আর কলকাতার ইলিশে সুগন্ধ বেশি।’ কিন্তু কমলকুমার মজুমদারের প্রশ্ন: ‘গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে কোম্পানির তেল খেয়েছে। এই ইলিশের সঙ্গে অন্য ইলিশ পাল্লা দেবে কি করে?’ শুটিংয়ের জন্য আট মাস বাংলাদেশে ছিলেন ‘কপিলা’ রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র সৌজন্যে: ‘সে সময় সারা দিন-রাত ইলিশই খেতাম। তবু আমি গঙ্গার ইলিশের ভক্ত। কেন তা ব্যখ্যা করে বলতে পারব না।’ ইলিশের পদ্মা-গঙ্গা, বাঙাল-ঘটির ‘ঝগড়া’য় ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন লীলা মজুমদার: ‘ঘটিরা বাঙালদের মতো কাঁচা ইলিশের ঝোল রান্না করে দেখাক তো!’ মুখের উপর জবাব দিয়ে দিয়েছেন জোৎস্না দত্ত: ‘দই-ইলিশ ঘটিদেরই দান।’ দুই বাংলা জুড়ে ইলিশ পদাবলীতে কমবেশি সাড়ে চারশো পদের সমাহার, তাদের বাহারি সব নাম: ইলিশ তিলোত্তমা, ইলিশের পাটিসাপটা, ইলিশের লটপটি, আরও কত কী! এত কিছুর পর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দ্বৈরথে পূর্ববঙ্গের প্রতীক ‘ইলিশ’ কেন– এটা বুঝে ওঠা দায়!
ভোজনরসিক কলকাতার বাঙালিবাবুরা একদা ইলিশ চেখেই বলে দিতে পারতেন মাছটি কোন ঘাটের– বাবুঘাটের না বাগবাজার গঙ্গার ঘাটের, নাকি মাঝ গঙ্গার। এই আশ্চর্য প্রতিভাবানরা হারিয়ে গেছেন বলে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত আফসোস করেছেন। তারপরেও ইলিশের প্রতি অনিবার্য টানের কাহিনিরা ঘুরে বেড়ায় শহর বা দূরের অজানা জনপদের নানা কোণে। সুপ্রিয়া দেবী শক্তি সামন্তের ‘আরাধনা’ ছবিতে রাজেশ খান্নার বিপরীতে অভিনয় করবেন। অগ্রিম নিয়েছেন। গোল বাঁধল ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শে। টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন ইলিশ খেতে পারবেন না বলে। ভি বালসারা সর্ষে-ইলিশ খাওয়ার লোভে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর নিমন্ত্রণ যেচে নিতেন। সুভাষ ভৌমিক নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে যেতেন ডায়মণ্ডহারবার, রূপোলি শস্যটির আশায়। বাম আমলে কলকাতার এক সাংবাদিক তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে প্রতি বছর পৌঁছে দিতেন একটি ইলিশ এবং তৎসম্পর্কিত ছড়া: ‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে/ ওরা সেবা করে চলে/ জানা নেই নাম/ ইলিশ প্রণাম’। অমর্ত্য সেনও ইলিশ-প্রেমিক। কলকাতায় থাকলে গঙ্গার ইলিশ তাঁর অবশ্যই চাই। নোবেল প্রাপ্তির পর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় এলে অভিনেত্রী নুসরাত জাহান উপহার পাঠান আড়াই কেজির ইলিশ। হুমায়ুন আহমেদের পরামর্শ ছিল বাংলা বর্ণমালা কেন্দ্রিক: শিশুশিক্ষার বইয়ে ‘ই’-তে ইলিশ করে দেওয়া হোক। পদ্মাপারে মাওয়া ঘাটে ইলিশ-ভ্রমণের জন্য ঢাকা শহর থেকে যে বাসটি ছাড়ে তার নাম– ‘ইলিশ’! বাংলাদেশ রেডিওতে এই সেদিনও ভেসে আসত এমন বিজ্ঞাপনী: ‘মাছের রাজা ইলিশ/ বাতির রাজা ফিলিপস’।
উত্তরবঙ্গের সকরিগলি, মণিহারিঘাট এবং পূর্ববঙ্গের বুক জুড়ে গোয়ালন্দ-বরিশাল-ঝালোকাঠি-নোয়াখালির স্টিমার ঘাট, ইলিশ আর স্টিমার মিলেমিশে একাকার বাঙালির স্মৃতি, সত্তা ও সাহিত্যে। মুজতবা আলী থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়– কে না লিখেছেন এই জলপথের ইলিশমঙ্গল। অকালপ্রয়াত পিনাকী ঠাকুরের কবিতায় স্টিমার ঘাটের আন্তরিকতার চোরকুঠুরিতে অর্থনীতির সহবাস: ‘নাম শোনছেন গোয়ালন্দ? স্টিমার ঘাটে ভাতের হোটেল।/ ইস রে, সে কী ইলশা মাছের সোয়াদ–/…বেকুব বানায় প্যাসেঞ্জারে। কেমনে জানেন?’ স্বামী বিবেকানন্দ একবার স্টিমারে গোয়ালন্দ যাচ্ছিলেন। যাত্রাপথে একটা নৌকার দিকে চোখ গেল। জেলেদের জাল জুড়ে রূপসী ইলিশ। ‘বেশ ভাজা ইলিশ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে’– স্বামীজির কথার ইশারা সারেঙ বুঝল। দু-টাকায় কেনা হল ষোলটা ইলিশ, সঙ্গে দু-চারটে ফাউ। এবার স্বামীজির আকাঙ্ক্ষা: ‘পুঁইশাক হলে বেশ হত, সঙ্গে গরম ভাত।’ স্টিমার এক গ্রামের পাশে দাঁড় করিয়ে জনৈক গ্রামবাসীর বাগান থেকে জোগাড় হল পুঁইশাক। ইলিশের মুড়ো সহযোগে সেই শাক খেয়ে আহ্লাদিত স্বামী বিবেকানন্দ ফেরার পথে পুঁইবাগানের মালিককে দীক্ষা দিয়ে গেলেন। শতবর্ষ আগে রটনা ছিল দ্বিপ্রহরে ইলিশের গুরুপাক ভোজনেই নাকি তাঁর অকালপ্রয়াণ। এইসব রটনায় বিশ্বাস করতে মন সায় দেয়না, হয়তো মাছের নামটা ইলিশ বলেই।
কৃতজ্ঞতা: দিগেন বর্মন, সোমা মুখোপাধ্যায়, সিমন মৃধা
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫