Jibansmriti Archive

ভবচক্র বৌদ্ধ দর্শনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণার চিত্ররূপ। জটিল এবং বহুস্তরীয় সেই ছবির বৈশিষ্ট্যগুলির সহজ বর্ণনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই লেখার অবতারণা।

যে কোন অস্তিত্বের জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের যে অন্তহীন প্রবাহ চক্রাকারে ঘুরতে থাকে তা একটি প্রতীকী ছবি দিয়ে বোঝানো হয় ভবচক্রে। কথিত যে প্রথম ভবচক্রের ছবিটি গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং এঁকেছিলেন। দিব্যাবদান নামক বৌদ্ধ আখ্যানমালার রুদ্রায়ণ-অবদানে সেই কাহিনি আছে যেখানে বুদ্ধদেব রাজা রুদ্রায়ণকে ভবচক্র এঁকে ব্যাখ্যা করছেন যে প্রাণীকুল কীভাবে কর্ম অনুযায়ী জন্মজন্মান্তরে যন্ত্রণা পায়।

বৌদ্ধধর্মের মহাযান ধারায় বিশেষত বজ্রযান মতাবলম্বী বৌদ্ধ গুম্ফায় এই ভবচক্রের ছবি হয় দেওয়ালচিত্রে নতুবা থাংকায় আঁকা দেখতে পাওয়া যায়। এই ছবি চেনার সহজ উপায় হল প্রথমেই চোখে পড়বে ভয়ঙ্কর দর্শন এক মূর্তি দুই হাতে একটি চক্র ধরে আছে। এই চক্রটি ক্রমান্বয়ে ছোট থেকে বড় চারটি বৃত্তের সমাহার যার ভিতরে নানা ছবি আঁকা।

চাকাটি ধরে থাকা ভয়াল মূর্তিটি নরকের অধিপতি ধর্মপাল যম। হিন্দু ধর্মের ধর্মরাজ বজ্রযানে আত্তীকৃত হয়ে সদ্ধর্মের রক্ষক ধর্মপাল হয়েছেন। তিনি অনিবার্য মৃত্যুর রূপক। করোটির মুকুট পরে বিস্ফারিত ভীষণ দৃষ্টিতে সংসার চক্রের উপর নজর রাখেন তিনি।

একেবারে বাইরের চাকায় বারোটি প্রতীকী ছবি দেখা যায় যা বৌদ্ধধর্মের দ্বাদশাঙ্গের রূপক। বুদ্ধের দ্বিতীয় আর্যসত্যের (দুঃখের কারণ আছে) উপর আধারিত প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব মতে কারণকে অনুসরণ করেই কার্য উৎপন্ন হয়। সুতরাং দুঃখের উৎপত্তির পিছনে একটি কার্য-কারণ শৃঙ্খলা থাকে। বুদ্ধ বারোটি নিদান বা কারণের কথা বলেছিলেন। ভবচক্রের বাইরের বৃত্তে এই বারোটি কারণের প্রতীকী ছবি থাকে। সেগুলি সাধারণত এই রকম  … ১/ অবিদ্যা – অন্ধ মানুষ, ২/ সংস্কার – কুমোর, ৩/ বিজ্ঞান (চেতনা) – বানর, ৪/ নামরূপ (দেহ ও মন) – নৌকায় দুজন মানুষ, ৫/ ষড়ায়তন (ইন্দ্রিয়) – ছটি জানলা বিশিষ্ট বাড়ি, ৬/ স্পর্শ – আলিঙ্গনাবদ্ধ যুগল, ৭/ বেদনা – চোখে তির বেঁধা ব্যক্তি, ৮/ তৃষ্ণা – জলপানের দৃশ্য, ৯/ উপাদান (বিষয়াসক্তি) – ফল সংগ্রহের দৃশ্য, ১০/ ভব (পুনর্জন্মের প্রবণতা) – কখনও সহবাসে লিপ্ত দম্পতি অথবা ভাবতে থাকা বা লাফ দিতে উদ্যত পুরুষ, ১১/ জাতি (জন্ম) – সন্তান জন্ম দেওয়ার দৃশ্য, ১২/ জরামরণ – মৃতদেহ-বহনকারী মানুষ।

 ভবচক্র – এক

চাকার কেন্দ্রে যে বৃত্তটি থাকে তাতে তিনটি প্রাণীর ছবি থাকে। একটি শূকর, একটি সাপ ও একটি পাখি। এই তিনটি প্রাণী সংসারের ত্রিবিষের প্রতিনিধিত্ব করে। এই তিন বিষ হল অজ্ঞতা বা অবিদ্যা, বিদ্বেষ বা অসূয়া এবং মোহ বা আসক্তি। বরাহ অজ্ঞতা বা অবিদ্যার প্রতীক কারণ সে যত্রতত্র থাকে, অখাদ্য-কুখাদ্য খায়। সাপ বিদ্বেষের প্রতীক কারণ সে সামান্য প্ররোচনায় বিবেচনা না করে ছোবল মারতে যায়। পাখি আসক্তি বা মোহের প্রতীক, জুটি বাঁধা পাখির একে অন্যের প্রতি আগ্রহের কারণেই। পাখির ছবিটি পায়রা বা মোরগ বিভিন্ন রকম হতে পারে। এই তিনটি প্রাণী একে অন্যকে স্পর্শ না করেও থাকতে পারে, আবার শুকরটির মুখ থেকে সাপটি বেরিয়েছে, সাপের মুখ থেকে পাখিটি বেরিয়েছে এবং পাখিটি শূকরের লেজটি কামড়ে ধরে আছে এমন হতেও দেখা যায়। এর ব্যাখ্যায় বলা হয় যে অজ্ঞতা থেকে বিদ্বেষের জন্ম, বিদ্বেষ থেকে মোহের জন্ম। সব শেষে মোহ বা আসক্তি অজ্ঞতা দূর হতে দেয় না। কেন্দ্রীয় বৃত্তের এই তিনটি বিষের সম্পর্ক রয়েছে বাহিরতম চাকার বারোটি কারণের সঙ্গে। এই সংযোগ মাঝের দুটি চাকা দিয়েই সম্প্রসারিত হয় যা রূপকাশ্রয়ী ছবি এঁকে বোঝানো হয়। যেমন কেন্দ্রের ঠিক বাইরের চাকাটি সাদা  ও কালোয় বিভক্ত। সুকর্মের দ্বারা সাদা পথটিতে ক্রমশ উত্তরণ এবং এর বিপরীত হলে অধঃপতনের ইঙ্গিতময় ছবি থাকে এই চক্রে।

 ভবচক্র – দুই

বাইরে থেকে দ্বিতীয় চক্রটি ভবচক্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ। এখানে সংসারের যাবত প্রাণীকুলকে ছয়টি রাজ্যে ভাগ করা হয়েছে। চাকার উপরের অর্ধেক অংশে থাকে তিনটি  উচ্চতর রাজ্য – দেবতা, অসুর ও মনুষ্য। চাকার নীচের দিকে থাকে তিনটি নিম্নতর রাজ্য – প্রেত, তির্যকযোনি এবং নরক।

বৌদ্ধধর্মে দেবতারা মানুষের চেয়ে সামান্য উন্নত হলেও উপাসনার অযোগ্য কারণ তারা অহংকারী এবং সর্বদা প্রাচুর্য ও বিলাসে সময় কাটায়। অসুররা প্রায় দেবতাদের সমান, বলদর্পী ও বিলাসব্যসনে মত্ত। কিন্তু তারা ঈর্ষায় ভুগে একে অন্যের সাথে অথবা দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করে চলে। দেবতা ও অসুরদের রাজ্যের বিভেদরেখাটি একটি গাছের ডালপালা দিয়ে প্রায় মুছে যেতে দেখা যায় কোন কোন আঁকায়; এই গাছের কাণ্ডটি অসুর রাজ্যে কিন্তু শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে গেছে দেবরাজ্যে।

দেবরাজ্যের বাঁ দিকে মানবের রাজ্য যেখানে কামনা আছে, তাই ভোগও আছে। কিন্তু একমাত্র মানবের স্বভাবে অন্বেষণ আছে। তাই তাদের মধ্যে যারা সদ্ধর্ম পালন করে তারা নির্বাণ পায়। শুধুমাত্র এই রাজ্য থেকে তাই মুক্তি সম্ভব।

তিনটি নিম্নতর রাজ্যের সবচেয়ে নীচে থাকে নরক যেখানে প্রাণীরা রাগ ও আতঙ্ক নিয়ে যন্ত্রণাময় দিন কাটায়। নরকের একদিকে আগুন ও অন্য দিকে বরফের ছবি থাকে। তির্যকযোনি হল প্রাণীদের রাজ্য যারা বুদ্ধিবৃত্তিতে মানুষের চেয়ে কম উন্নত, তাই সর্বদা ভয় ও আক্রমণের চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে। নরকের অন্য পাশে প্রেত-রাজ্যে ক্ষুধার্ত ভূতের দল সারাক্ষণ আরও খাওয়ার লোভে আকুল থাকে। তাদের গলাটি সরু, পেটটি বিশাল, খিদে কিছুতেই মেটে না। 

ভবচক্রের উপরের দুটি কোণ ভরানো ঐচ্ছিক। ডান কোণে কখনও দণ্ডায়মান বুদ্ধকে আঁকা হয়। বুদ্ধ হয়তো চাঁদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন।  অথবা শুধু মেঘের মাঝে চাঁদের ছবিও থাকতে পারে। শ্বেতশুভ্র চন্দ্রমা এখানে মুক্তির প্রতীক। বাঁ কোণটি খালিও থাকতে পারে, অথবা নির্বাণ প্রাপ্ত উপবিষ্ট বুদ্ধ বা তাঁর কোন বাণীও লেখা থাকতে দেখা যায়।

সহস্রাধিক বছর ধরে ভবচক্র সাধারণত এই ভাবে আঁকা হয়ে আসছে বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরের দেওয়ালে দেওয়ালে, অথবা  থাংকা অঙ্কন রীতিতে। আমরা একে শুধু একটি ধর্মীয় শিল্প হিসেবেও দেখতে পারি, আবার রূপকের পথ ধরে জীবনদর্শনে সহায়ক কোন গভীর অর্থও খুঁজে পেতে পারি।

 ভবচক্র – তিন

প্রজ্ঞা পারমিতা প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ-সাহিত্যিক, গল্পকার ও অনুবাদক। বর্তমানে বিজ্ঞানী পূর্ণিমা সিংহের জীবন নিয়ে গবেষণা করছেন। বহু বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহী যার মধ্যে অন্যতম বজ্রযানী বৌদ্ধ শিল্প।   

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫

2 Responses

  1. ভারি সুন্দর কাজ করেছো। আমার অনুসন্ধিৎসা আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু সময় এবং সুযোগের এবং হয়ত প্রয়োজনীয় উদো‍্যগেরই আসল অভাব।

    তাই তোমার মত মানুষ আমার খুবই উপকারী বন্ধু। অনেক অনেক এইরকম কাজ করে যাও। আমাদের প্রচুর উপকার করলে। 🙏🏼🙏🏼🙏🏼♥️♥️♥️♥️♥️🤗🤗🤗

Leave a Reply to Madhuri Hazra Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *