
বাঁদিক থেকে – ডাঃ বিজয় কুমার বসু, ডাঃ এম. আর. চোলকার, ডাঃ মদনলাল অটল, ডাঃ দেবেশ মুখোপাধ্যায় এবং ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস
১৯৩৮ সাল। ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে উত্তাল ভারতবর্ষ। ভারতের প্রতিবেশী চীন দেশে ‘জাপানী আগ্রাসন বিরোধী জোট’ গড়ে দীর্ঘ সংগ্রাম করছেন চীনের মুক্তিকামী জনগণ। তাঁরা ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’-এর কাছে চিকিৎসা-সাহায্যের আবেদন জানালে পরাধীন চীনের পাশে দাঁড়ালো পরাধীন ভারতের মানুষ। বিপুল চিকিৎসা-সরঞ্জাম নিয়ে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৮, সমুদ্রপথে চীনের উদ্দেশে রওনা দিল পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল মিশন – ডাঃ মদনলাল অটল, ডাঃ এম. আর. চোলকার, ডাঃ বিজয় কুমার বসু, ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস এবং ডাঃ দেবেশ মুখোপাধ্যায়।
১৯৩৮-৪৩। চীনের প্রবল প্রতিকূল পার্বত্য পরিবেশে আহত সৈনিকদের চিকিৎসা করে, সংগ্রামী গ্রামবাসীর পাশে থেকে এবং তাদের থেকে পরবর্তী চিকিৎসক বাহিনী গড়ার প্রশিক্ষণে, ভারতীয় মেডিক্যাল মিশন বিশেষ করে বসু ও কোটনিস, বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক নরম্যান বেথুন-এর যোগ্য উত্তরসূরী রূপে মানবসেবা ও আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের এক চিরস্মরণীয় উদাহরণ স্থাপন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিনা বিশ্রামে টানা ৪৮ ঘণ্টা অপারেশন করতে করতে অসুস্থ হয়ে ৯ই ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে কোটনিস প্রাণ হারান।
১৯৪৩-১৯৫৮। দেশে ফিরে বসু স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন এবং জনসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকেন। ১৯৫৭ সালে নয়া চীনের আমন্ত্রণে মেডিক্যাল মিশনের সদস্যরা চীনে যান। সেখানে আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রাচীন ঐতিহ্যশালী চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতিসাধন দেখেন। বসুর নিজের চিকিৎসা হয় আকুপাংচার দ্বারা। ১৯৫৮ সালে পুনরায় চীনে গিয়ে তিনি এই চিকিৎসা বিদ্যা শেখেন।
আকুপাংচার রোগ নিরাময়ের একটি প্রাচীন ওষুধবিহীন চিকিৎসা পদ্ধতি। এর সাহায্যে কয়েক হাজার বছর ধরে সমগ্র বিশ্বে স্বল্প ও দীর্ঘকালীন বহু অসুস্থতার সফল চিকিৎসা হয়ে চলেছে। বর্তমানে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার পর সর্বাধিক প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি হলো আকুপাংচার। এর স্বতন্ত্র তত্ত্ব দ্বারা মানুষের শরীর, রোগ ও রোগ নির্ধারণ এবং নিরাময়ের উপায় নির্ণয় সম্ভব বলে, আকুপাংচার আজ স্বাধীন চিকিৎসা বিজ্ঞান হিসাবে পৃথিবীতে স্বীকৃত। এই চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক মান নির্ধারণ, শিক্ষাক্রম তৈরী ও প্রসারের ক্ষেত্রে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’-এর ভূমিকা অসাধারণI
১৯৫৯ সাল। বসু কলকাতায় আকুপাংচার চিকিৎসা শুরু করেন এবং শিক্ষাও দেন।
১৯৭২ সাল। বর্তমানে ইরিমে কর্মরত ভারতের প্রবীণতম চিকিৎসকদ্বয় ডাঃ চন্দনা মিত্র ও ডাঃ দেবাশিস বক্সী সহ কিছু ডাক্তারি ছাত্র বসুর কাছে আকুপাংচার শেখেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল পাশ্চাত্য ধারার আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে প্রাচীন পরম্পরাগত চিকিৎসার সমন্বয় ঘটিয়ে এমন এক নতুন ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যার দ্বারা চিকিৎসার খরচ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানো এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়।
১৯৭৩ সাল। বসুর সভাপতিত্বে ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটি পুনরুজ্জীবিত হয়। কমিটির শাখাগুলিতে আকুপাংচারকে জনসেবার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার ফলে এই চিকিৎসার বিশেষ প্রসার ঘটে।

১৯৮১ সাল। মূলত বসুর ছাত্রদের উদ্যোগে আকুপাংচারকে কেন্দ্র করে কম খরচে এক সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইন্সটিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন বা ইরিম সংস্থা। বর্তমানে ইরিম, প্রাচীন ঐতিহ্যশালী চিকিৎসাবিজ্ঞান-ভিত্তিক সমন্বিত চিকিৎসা-সেবা, শিক্ষা এবং গবেষণার একটি পরিচিত প্রতিষ্ঠান। ইরিম, আকুপাংচার বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে ১৯৯৬ সাল থেকে লাগাতার ভারতে প্রথম, কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় দ্বারা স্বীকৃতি পেয়ে আসছে, ২০০০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ চিকিৎসা গবেষণা সংস্থা আই.সি.এম.এর.-এর অর্থানুকূল্যে ‘বাত রোগে আকুপাংচারের তুলনামূলক ফলাফল’ বিষয়ে প্রথম গবেষণা প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেছে। বর্তমানে প্রথাগত পাশ্চাত্য চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত সংকটের সময়ে মেডিক্যাল মিশন, কোটনিস ও বসুর শিক্ষাকে স্মরণে রেখে, ইরিম সেবামূলক ভাবে চিকিৎসা করে থাকে। উল্লেখযোগ্য, ইরিম, চীনা আকুপাংচার ও ভারতীয় যোগ চিকিৎসার সমন্বয়ের মাধ্যমে ভারত-চীন মৈত্রীর বাস্তব উদাহরণও স্থাপন করে চলেছে। ২০১৪ সাল থেকে ইরিম, ভারতীয় আকুপাংচারিস্টদের সর্ববৃহৎ সংগঠন, ‘আকুপাংচার সায়েন্স এসোসিয়েশন (আসা) ইন্ডিয়া’-এর মূখ্য কার্যালয় হিসাবে কাজ করছে।

১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ইরিমের উদ্যোগে ‘বিকল্প ব্রত’ (Alternative Mission) শিরোনামে; ভারতীয় মেডিকেল মিশন, ডাঃ কোটনিস, ডাঃ বিজয় বসু ও ইরিম বিষয়ক একটি আর্কাইভ ও স্থায়ী প্রদর্শশালার উদ্বোধন হয়েছে মৌরীগ্রাম, হাওড়া ইরিম ভবনে। এটিই ভারতবর্ষে আকুপাংচার চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাস সংক্রান্ত প্রথম আর্কাইভ।
আর্কাইভ ভাবনা ডাঃ দেবাশিস বক্সী এবং পরিকল্পনা ও রূপায়ণে অরিন্দম সাহা সরদার।
উদ্বোধন করেছেন অধ্যাপক ডাঃ রামগোপাল এবং অধ্যাপক ডঃ শ্যামনারায়ণ পান্ডে।

বাম দিক থেকে : কলকাতার চীনা উপদূতাবাসের উপ-মহাদূত (ডেপুটি জেনারেল), ইরিমের প্রধান ডা: দেবাশিস বক্সী, ইরিমের বরিষ্ঠ আকুপাংচার চিকিৎসক ডা: চন্দনা মিত্র, সংগ্রহশালার রূপকার অরিন্দম সাহা সরদার, আকুপাংচার সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের উপ-সভাপতি ভোপাল নিবাসী ডা: রশ্মি ঝা ও উপদূতাবাসের কর্মী।
ছবি সংগ্রহ : ইরিম ও জীবনস্মৃতি আর্কাইভ
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫