আমার বাবা, অশোক মুখোপাধ্যায় (১৯১৩-১৯৬৯) নিজের পরিচয় বোঝাতে, চিঠিতে তাঁর নামের পাশে সব সময় লিখতেন ‘চিত্রকর’; আর সেই নাম ইংরেজিতে লিখলে, ‘Artist’। এই নামেই প্রচুর চিঠি আসতো তাঁর খড়দার বাড়িতে। আমাদের মনে এ-নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি কখনও। পোস্টম্যানও তা দিয়ে যেত, একরকম চোখ বুজেই। দমদমের মতিঝিলে মা বাসা নিলে, সেখানকার পানওয়ালা নগেনদা অবশ্য বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘হিন্দি না বাংলা – কোন সিনেমার ‘আটিস’ আপনি!’। বাবা কোনও উত্তর দিলেন না; ওরই দোকান থেকে ফাঁকা চারমিনারের প্যাকেট নিয়ে, তার ভেতরে খোলা বন্ধ করার হলুদ কাগজটি (inner slide) নিলেন; সবসময় ব্যবহার করা, ব্রাউনকালির ফাউন্টেন পেনটি নিজের সেই শান্তিনিকেতনী কাঁধঝোলা থেকে বার করে, তাতেই খুচ খুচ করে এঁকে ফেললেন নগেনদার মুখেরই একটি স্কেচ। আঁকা কাগজটি তাকে ফিরিয়ে দেবার আগে, নীচে নিজের নাম বাংলায় লিখে, পাশে জুড়ে দিলেন — ‘আর্টিস্ট’ । এই আর্টিস্ট শব্দটি নগেনদার কাছে অপরিচিত হলেও, বাবা যে ‘আর্ট’ বিষয়ের লোক সেটা সে বুঝল। পরে, আবার একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আর্টের ঠাকুর গড়েন?’। এ- নিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যে বিস্তর হাসাহাসি হওয়াতে সেদিন এটুকু বুঝেছিলাম যে, আর্ট আর আর্টিস্ট কিন্তু মোটেই এক নয়।

আরও একটু বড় হতে শুনলাম, ‘আর্টিস্টিক’ শব্দটি। বছর বারো বয়স। বাবা চলে গেছেন। খড়দার পাট উঠিয়ে, তখন আমরা পাকাপাকিভাবে কলকাতায়। নতুন ইশকুলের প্রায় সব দিদিমণিই বলতেন, ‘অন্যসব বিষয়ে এত আর্টিস্টিক! অথচ হাতের লেখার অবস্থা অমন কাগের ঠ্যাং-বগের ঠ্যাং কেন?’। না বুঝতাম আর্টিস্টিক, না বোধগম্য হতো, কাক-বকের ঠ্যাং। মনে পড়ত, ঠাকুমার গুরুদেব, ধরণীধর পণ্ডিতের কাছে হাতেখড়ি হওয়া সত্ত্বেও , বাবা আবার হাতেখড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল বসন্ত গাঙ্গুলি, সরস্বতী ঠাকুরের সামনে নিজের কোলে বসিয়ে, নতুন স্লেটে খড়ি দিয়ে আঁকিয়েছিলেন একটা ছুটন্ত খরগোস। এমন হাতেখড়ি দেখে মা-ঠাকুমার মন খুঁত-খুঁত আন্দাজ করে বাবা বলেছিলেন, ‘অক্ষরের ঢের আগে রেখা তৈরি হয়েছে; এটাই তাই আসল হাতেখড়ি। মনে পড়ে, হস্টেলে আমাকে যে চিঠি লিখতেন, sender’s address-সমেত সে-সবও সচিত্র; শব্দের যে ছিটেফোঁটা থাকতো, তা শুধু সেই ছবিগুলি বুঝতেই।
হাতের লেখা মকশো না করায়, মা বকুনি দিলেই বাবা বলতেন, ‘খুব কি দরকার! কুচকাওয়াজের সৈন্যদের মতো, হাতের লেখাতেও uniformity?’

আর কাকের-ঠ্যাং, বকের-ঠ্যাং? সে-ও তো আশৈশব তাঁকে দেখেছি বারান্দার রেলিং, ছাদের আলসেতে বসা বা গঙ্গার পাড়ে চরা কাক-চড়ুই, ছাতারে, শালিখ, টুনটুনি, পানকৌড়ি, সাদা বক—- এদের কাঠি-কাঠি পা, নখ এবং তার বিচিত্র গড়ন কত সময় নিয়ে ‘লাইভ স্কেচ’ করতে! মনে পড়ে, আমার আকাশি রঙের ফ্রকে, তাঁর এঁকে দেওয়া উড়ান টানা সেই বকদুটো, যাদের কাঠির মতো হলুদ পা-দুটি, ঠোঁটের সঙ্গে একই রেখায় কেমন টান টান! তাঁর চোখ দিয়েই তো দেখতে শিখেছি, বসার সময় পাখি তাদের নখ বিছিয়ে ডানা দুটি কেমন মুড়ে রাখে; আর ডানা মেলে ওড়বার সময়, নখ গুটিয়ে সেই পা-দুটোই কেমন টান-টান করে নেয়! আর একটু বড় হয়ে, বন্ধুরা যখন নগ্নতাকে নিষিদ্ধ ভাবতে শুরু করেছে এবং সিনেমা পত্রিকায় ছাপা সে-সব সাদাকালো ছবি লুকিয়ে দেখে চাপা হাসিতে গুঞ্জন করছে, সহজভাবেই আমি তখন বলে ফেলেছি, ‘আমাদের বাড়ি এমন অনেক বই আছে; সেগুলোকে বলে, ‘nude study’ । হস্টেলে গার্ডিয়ান কল করে, মাকে ডেকে পাঠানো হলে, বাবা বলেছেন, ‘ইস্কুল ছাড়িয়ে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এসো।’
ক্রমে বুঝেছি যে, সাজপোশাক চলা-বলা এমনকী হাত পায়ের গঠন আর্টিস্টিক হলেও তা কিন্তু আর্ট নয়; এবং আর্ট মানেই যে আর্টিস্ট এমনটাও নয়; সেইসঙ্গেই ভাবতেও শিখেছি আর্টিস্ট মানেই কি ছবি আঁকিয়ে—তাও তো নয়! এমন সব সংশয়ের উত্তর পাবার আগেই বাবা চলে গেলেন। আমি তখন ‘পোর্ট্রেট’, ‘প্রোফাইল’, ‘লাইভ স্কেচ’, ‘স্টিল লাইফ’ এবং জলরঙে মনের আনন্দে ছবি আঁকার পর্যায়ে; সবে তেলরঙে কাজ করার অনুমতি পেয়েছি। বাবার মস্ত ইজেলের পাশে, একটা উঁচু টুলের ওপর ম্যাসোনাইট বোর্ড রেখে, আগে আঁকা জলরঙের স্টিল লাইফটাই এবার তেল রঙে আঁকছি, নতুন করে। হলুদ পোরসিলেনের সেই ঘড়াটাতে, একইভাবে সাজানো হলুদ কলি-সমেত গাঢ় সবুজ রঙের সেই কচুপাতাগুলোই। জল রঙে যখন এঁকেছিলাম, ফুলদানির গায়ে এসে পড়েছিল, পুবদিকের বারান্দার রোদ। জায়গা বদল করে, এবার যখন সেটা অন্যদিকে একটা জানলার ওপর সাজানো হল, আলোর মুখ ঘুরে, পাতা সমেত ফুলদানিটার গায়ে তখন এক আবছায়া আলো। সেই আবছায়াকে ধরতে-না-ধরতেই পুজোর ছুটি শেষ হয়ে এল। আর ইস্কুল খোলার আগেই, ভাই ফোঁটার পরদিন বাবাও চলে গেলেন। সেবছর ওই ডিসেম্বর মাসেই আমারাও চলে এলাম শহর কলকাতায়। পড়ে রইল আমার সেই শেষ না-হওয়া অয়েল-ছবিটাও; রঙিন আবছায়ার বদলে, জানলা দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বাবার সেই অন্ধকার স্টুডিও ঘরে। অনেক পরে বাবার ছবির মধ্যে থেকেই খুঁজে পেয়েছিলাম, হলুদ ঘড়ায় সাজানো, সবুজ কচুপাতার একটা ছবি। কী আশ্চর্য!
ক্রমশঃ
মন্দার মুখোপাধ্যায়
জন্ম -1957, কলকাতা।
নেশা – সাহিত্যশ্রম, আড্ডা আর বেড়ানো।
লেখার বিষয় – গল্প, কবিতা, উপন্যাস , প্রবন্ধ , ফিচার ও অনুবাদ সাহিত্য।
সাহিত্য সম্মান
‘আশকথা পাশকথা’ (প্রকাশক: গাঙচিল) বইটির জন্য বাংলা অকাদেমি প্রদত্ত ‘সুধা বসু স্মৃতি পুরস্কার’, 2014
‘শতাব্দীর মূল্যবোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ (দে’জ সুবর্ণ জয়ন্তী সংস্করণ) বইটির জন্য সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিতে গড়িয়া গ্রন্থমেলা ২০২৫, ‘সাহিত্য সম্মান’।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত