Jibansmriti Archive

দ্বিতীয় কিস্তি

আমি তখন ক্লাস সেভেন ১৯৭০। নতুন ইস্কুল, নতুন পাড়া এবং নতুন পরিবেশে। শ্যামবাজার –  বাগবাজারে বাস, ট্রাম, হাতেটানা রিক্সা, সিনেমা হল, ফুটের বাজার, অলি-গলি এবং নকশালদের ধড়পাকড়ে যখন তখন পুলিশের তাড়া। খড়দা নামের ছোট এক মফসসলে থাকলেও, মস্ত-মস্ত মাঠ, জোয়ারভাঁটা খেলা গঙ্গা, দুটো পুকুর সমেত বাগানওয়ালা দাদামশায়ের বাড়ি, দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে দৌড়নো আমাদের তিনতলা বাড়ি, শিল কুড়োনো ছাদ এবং দশটা জানলা আঁকা বাবার  স্টুডিও ঘর —-এ সবের মধ্যেই তো বড় হয়েছি; যেখানে এ-পাড়া ও-পাড়া বা সে-পাড়ার সবাই সবাইকে চেনে এবং ডেকে-হেঁকে খোঁজ রাখে। যাঁরা কলকাতায় ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি’ করতেন, চাকরি সেরে দিনান্তে তাঁরাও ফিরে আসতেন যার-যার বাড়িতে। বাসে করে কলকাতা যাওয়ার চল প্রায় ছিলই না। সকলের অভিমুখ ছিল খড়দা-স্টেশন এবং একটি মান্থলি টিকিট। আত্মীয়বৎ আর ছিল, রিক্সাওয়ালা এবং কাজের মাসিরা যাদের সকলেরই থাকার জায়গা ছিল। এখানে এসে দেখলাম, দলে-দলে ফুটপাথবাসী; সকলেই যে পাগল বা ভিখারি তা-নয়। দেখলাম, খালপাড়ের নীচে সারবাঁধা ঝুপড়িতে বাসকরা, ‘অ্যান্টিসোশাল’ দের। এই মস্ত শহর কলকাতায় এসে রাস্তাঘাট, ইস্কুল সবই বড় হয়ে গেল, কিন্তু একচিলতে হয়ে গেল ঘরের মাপ। আর আমরাও হয়ে গেলাম, দেড়খানা ঘরের ভাড়াটে;  দেখলাম, ছবি আঁকা মানে শুধুই সপ্তাহে একদিন ইশকুলের ড্রইং-ক্লাস; যেখানে সেলাই-দিদিমণি  আম, কলা, পেঁপে আর টবে গজানো ফুল আঁকান ব্ল্যাক বোর্ডে। একটা নিভৃত-জীবনের ছবি এক মাসের মধ্যেই কেমন হু-হু করে বদলে যেতে লাগল, বাবা মারা যাওয়ায়!

চিত্রকর : অশোক মুখোপাধ্যায় (১৯১৩-১৯৬৯)

কলকাতায় থিতু হয়ে , মা তবুও বিশেষভাবে উদ্যোগী হলেন, একটা আঁকার স্কুলে পাঠাবার। সেই সঙ্গে লেগে পড়লেন বাবার ছবির প্রদর্শনী করতেও। এতদিন বাড়িতে যাঁরা আসতেন, তাঁরা মূলত বাবার পরিচিত বা শিল্পানুরাগী; এবার এক অন্যদল আসতে লাগলেন মায়ের চাকরির পদমর্যাদার যোগাযোগে। আর্ট কলেজের সংযোগে এলেন, ইন্দুভূষণ রক্ষিত, গনেশ হালুই এবং তরুণ ছাত্র অসিত পাল। এইসূত্রেই জানা গেল, মৃত্যুর কয়েক মাস আগেই বাবা নাকি একটি  পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন, সদ্য প্রকাশ-পাওয়া শিল্প-বিষয়ক লিটল ম্যগাজিন- ‘প্রমিতির’ সম্পাদক রতন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সংযোগ বাড়ল, প্রদর্শনীও হতে লাগল মায়ের উৎসাহে। পরিতোষ সেন, গণেশ পাইন—এরাও সহযোগ দিলেন তাঁর ‘মরণোত্তর প্রদর্শনী’ আয়োজনে। কিন্তু আমার কাছ থেকে ক্রমেই যেন হারিয়ে যেতে লাগল, ছবি আঁকাকে ঘিরে এক অতি বাস্তব জীবন এবং তার  জন্যেই অনায়াসে বিলিয়ে দেওয়া জীবনের শ্বাস ও প্রশ্বাস। হারিয়ে গেল, World Art Friendship Exchange Programme ঘিরে, Fredrick এবং Maude Muller-দের সঙ্গে যোগাযোগ;  পেন্সিলভেনিয়া অবধি পৌঁছে যাওয়া আমাদের আঁকা ছবি। তাঁদের পাঠানো ক্রেয়ন- কাগজ, বই এবং ওখানকার বাচ্চাদের আঁকা ছবি সাজিয়ে বাবা-মায়ের উদ্যোগে অবাক করে দেওয়া এক প্রদর্শনীও। পরে বাবার আঁকা কিছু ছবি দেওয়ালে ঝুললেও  বেশিরভাগই বন্দি হয়ে পড়ল বড় দুটি তোরঙ্গে।  এক-ঘর রঙের বদলে, হাতে রইল ভাড়াঘরের সিমেন্ট বাঁধানো ছোট্ট একটা তাক, ক্যামেল টিউবের কাগজের বাক্স আর গোনাগুনতি কয়েকটা তুলি ও পেন্সিল।  সেই অগুন্তি রঙের বাক্স, গোছা-গোছা তুলি, বড়-বড় জলপাত্র— হু হু করে উড়ে যেতেই বাড়িটাও চিহ্নিত হল অন্য মালিকানায়। ফোল্ডিং ইজেলটার ঠাঁই হল, দরজার মাথার লফ্টে । মনে-মনে কোণঠাসা হয়ে পড়া আমিও ধাপে-ধাপে সিঁড়ি ভেঙে, অনিচ্ছাকৃতভাবেই এঁটে গেলাম লেখা পড়ার জগতে। এই প্রথম বুঝলাম, ছবিআঁকা নিয়ে জীবন কাটানো যে কতবড় বিলাসিতা! ছবি বিক্রি হলে টাকা আসে ঠিকই, কিন্তু বিক্রি না হলেও যে এঁকে যেতেই হয়! ‘পেট চালাবার দায় নেবে কে?’  ফলে, সংসারের আসল চাহিদা কিন্তু ওই অনেক টাকার পরিমাণ নয়; তা হল প্রতিদিনের যাপনে খেয়ে-ঘুমিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে বেঁচে থাকার রসদটুকু। এ-ও তো ক্রমেই বুঝলাম যে, ছবি আঁকা আসলে এক জীবিকা। ‘ব্রোমাইড’ না ‘ফোটো-ফিনিশড, বা চারকোল না মোটা পেন্সিলের ড্রইং— সে বিচারে না গিয়ে সরাসরি ভাবা, যে কতটা ‘বেচন’ যোগ্য হল ছবিখানি! আর এইখানে এসেই ঠেকে গিয়েছিলেন আমার বাবাও;  নিজের স্পৃহা ও চিত্রশিক্ষাকে পেশার উপযুক্ত করে তুলতে পারেননি একেবারেই। সুযোগ পেয়েও মন চায়নি, কোন একটা দলে ঢুকে, যৌথতায়  চিহ্নিত হতে। সে ডাকও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাই নিজের কাছেও সর্বতোভাবেই ‘ব্যর্থ’ হয়েছিলেন। অভিমানে লিখে গেছেন, ‘A failed father’ ।

ক্রমশঃ

চিত্রকর অশোক মুখোপাধ্যায়

কিস্তি একের লিঙ্ক : https://jibansmritiarchive.com/chitrakar-baba-mandar-mukhopadhyay/

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫

2 Responses

  1. অপূর্ব লেখা। অনেক অজানা তত্ব কথা জানত পরছি তোমার পরিপক্ক লখার মধ্য় দিয়ে। আমার জানামতে (যতদূর জানি) শিল্পীদের বাবা মা যতই নাম করা বড় শিলপী হক, তাদের সন্তানরা বেশীর ভাগেই উদাসীন। সেই ক্ষেত্রে তুমি ব্য়তিক্রমী। তোমার বাবার ওপর যে সঙ্কলন বইএর কথা বলেছিলে তার জন্য় আমার লেখা আমি জুলাই মাসে লেখবো। তুমি এর মধ্য়ে হয়তো মুম্বাই থেকে কোলকাতা ফিড়েছ। কথা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *