Jibansmriti Archive

শুভাশিস আচার্য

কিশোর বয়সে গ্রাম মফস্‌সলে ভাত ঘুম ভাঙতে ভাঙতে যদি বিকেল হয়ে যায়, ছেলে মেয়েরা বাড়ির বাইরে এসে কিছুক্ষণ বুঝতে পারে না সকাল হয়েছে না বিকেলবেলা। কারণ, সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত সময়ের নিয়মে আলাদা হলেও আলো ছায়ার খেলা দুই সময়েই প্রায় এক রকম। পরিচালক রাজা সেন ক্যামেরা দিয়ে চলতে চলতে বোঝাতে পারেন ভোর বেলা না সন্ধেবেলা। দামু সিনেমাটি শুরু হয় এক ভোরবেলা থেকে ধীরে ধীরে গ্রামের বেলা গড়ানো অবধি এবং বেলা যত গড়ায় প্রস্ফুটিত হতে থাকে দামু চরিত্রের একটা রূপরেখা—সরল বোকা কর্মঠ পরোপকারী আর দাদা-ঠাকুরের বিশ্বস্ত। এই সূত্র ধরেই গ্রামের পিওনকে একটু বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে তার কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে দামু পৌঁছে যায়; সকল দর্শক পৌঁছে যায়; তার দা-ঠাকুর—পঞ্চানন মুখুজ্যের উঠোনে। এই উঠোন থেকেই নারায়ণ গঙ্গোপাধায়ের কিশোর উপন্যাস পঞ্চাননের হাতি শুরু, যা-থেকে রাজা সেন তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র দামু পরিচালনা করেন। সিনেমাটি দর্শকদের সামনে আসে ১৯৯৬ সালে; অর্জন করে প্রভূত জনপ্রিয়তা; পরিচালক রাজা সেন অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। 

দামু :রঘুবীর যাদব

সিনেমার গল্পটি এইরকম—

সংসারে একা পঞ্চাননের নাতনির তিন বছর বয়সেই একমাত্র মেয়ে মারা যায়। নাতনি থাকে তার জমিদার পিতামহ ত্রিলোচনের বাড়ি। শোকে পাথর পঞ্চানন সে-মুখো হন না। একদিন নাতনির এক চিঠি আসে; সে তাকে দেখতে চায়। আশ্রিত দামুকে নিয়েই তিনি নাতনিকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসতে রওনা দিলেন। রুনকুকে নিয়ে ফেরার আগের দিন খেলাচ্ছলে দামু বলে ফেলে তার দাদুর হাতি আছে ও সেই হাতির পিঠে করে সে রুণকুকে নিয়ে যাবে। ফেরার দিন রুনকু হাতি ছাড়া দাদুর বাড়ি যাবে না, অদম্য জেদ ধরে। পঞ্চানন আর দামু খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ফেরার পথে দামু মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে প্রতিজ্ঞা করে সে হাতি নিয়ে রুনকুকে বাড়ি নিয়ে আসবে। হাতির জন্য সে দিন-রাত এক করে, নানা গ্রাম জঙ্গল স্টেশন চষে, বিচিত্র অভিঘাতের শেষে এক সার্কাসে হাতির দেখা পায়। 

একই লেখকের রম্যরচনার ভাষা আর সমাজ বিশ্লেষণী উপন্যাসের ভাষা আলাদা হয়। এটাই দস্তুর। এই কারণেই, লেখকের সাথে পাঠকের অভিজ্ঞতা এক বিন্দুতে মিলতে সহায়তা করে। সিনেমার ক্ষেত্রেও এক এক সিনেমার মেজাজ এক এক রকম। আলো ছায়া ভাষা অভিনয় বস্তু নিসর্গ সঙ্গীত ও চরিত্র—সবটা নিয়ে এক মৌলিক মেজাজ তৈরি করে একটা ভালো সিনেমা। রাজা সেন দামু তৈরি করার সময় পরিকল্পনা পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে কিশোর দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রত্যন্ত গ্রামীণ আচার ব্যবহার ভাষা ও দেশজ মার্কা মারা বস্তু সমূহকে প্রতিফলিত করেছেন। প্রথমে ভাষার দিকটা দেখা যাক। পাঁঠা না বলে ‘প্যাটা কাটি, মোষ কাটি’—ভাটুর এই কথায় গ্রামের নির্দিষ্ট চরিত্রটাকে চিহ্নিত করা যায়। আত্ম-অনুশোচনায় মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নামার সময় দামু নিজেকে বলে ‘অকম্মার ধাড়ি’। কলিম শেখ মেয়েকে ডাব কেটে আনতে না বলে ডাবের মুখটা ‘ছুলে’ আনতে বলে। অন্য গ্রাম বোঝাতে বলে ‘ভিন গাঁ’— এই সব গ্রাম বাংলার ভূমিশব্দ, এর ঝংকারে দর্শকের মনে এক জায়মান গ্রাম্য আবহ তৈরি করে। কিছু বস্তুর দিকে চোখ রাখা যাক। দুটি শটে দুটি বাচ্চার হাতে সাদা এনামেলের পাত্র; নীল পাড় সাদা কাপড় জড়ানো বৌ-ঝিয়ের গোবর ছড়া দিয়ে ঘর নিকানোর প্রস্তুতি; বাড়ির মাটির পাঁচিল থেকে ঘুঁটে তুলে নেওয়ার পর থেকে যাওয়া ছোপ; গরুর গাড়ির খোলা চাকা; উঠোনে উলটে রাখা বেতের বোনা ঝুড়ি; দরজায় ছিটকিনির বদলে তিন বালার লোহার শেকল—এ সবই পরিবেশের অনুষঙ্গ যা দর্শককে আর অন্য কিছু ভাবতে সময় দেয় না। দৃষ্টিকোণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। পঞ্চাননের পুকুরের টলটলে জলে মুখ হাত ধুয়ে নেওয়ার পর দূরে ল্যান্ডস্কেপে বাড়ির খড়ের উঁচু মাথাটা অবধি দেখা যায়। আদিগন্ত শূন্যতা মাঝে মধ্যে দুই একটা বস্তু আর এক পাশে গ্রাম। ছবির মতো। কিশোর কল্পনায় আরো পোচ পড়ে যখন সারা সিনেমার সমস্ত চরিত্র আসলে সাদাসিধে। দারোগাবাবু নিজেকে দারোগা বলার চাইতে চোরের চিকিৎসক বলে বেশি খুশি হন। দুটো পেঁপে হাতিয়ে নিতে ছলচাতুরি করে হাটু। সে যা শক্তিশালী অনায়াসে ওগুলো পেতে পারত। দুটি চিত্রনাট্যই সিনেমাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রযুক্ত করে দিয়েছেন রাজা সেন।

দামু (১৯৯৬) চলচ্চিত্রের তথ্যপত্রীর প্রচ্ছদ
দামু (১৯৯৬) চলচ্চিত্রের তথ্যপত্রী

দুই পাশে কবাটের মতো দুটি দেওয়াল। বাড়ির দাওয়া বা গ্রামে যাকে বলে পিঁড়ে তার মতো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো নায়ক দামু ও স্টেশন মাস্টার কথোপকথনরত। দামু যখন হাতি খোঁজার উদ্দেশ্য বলছে প্ল্যাটফর্মের পরেই স্বপ্নের উড়ানের রেলপথ হয়েছে উঠোন, উঠোনের পর ওপারের প্ল্যাটফর্ম ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের কারণে প্রায় একই স্তরে রেলপথ ও তারপর  লোহার পাঁচিল যেন বেড়া দেওয়া সীমানা। বেড়া ঘেঁষা বাড়ির মতো দু’চারটে লোহার রেলিং সংলগ্ন গাছ। এর ফাঁক দিয়ে দেখা যায় দূরের সবুজ ও আরো সবুজতর হতে হতে নীল পাহাড়ের মতো দিগন্তরেখা টেনে দিয়েছে এক অনুপম দৃশ্যের ব্যঞ্জনা। একটাই ফ্রেম। এতগুলো ভাবনা। যেন দর্শকের কিশোর মনের জানলা দর্শন। এই হল সাহিত্য উত্তর চলচ্চিত্রের নির্মাণ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মন্ধীয় অক্ষর দিয়ে এক রাস্তা বানিয়েছেন সেই ধরতাই নিয়ে রাজা সেন দিলেন সিনেমাসুলভ সৃষ্টিপথ। 

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি শেষ হয় গড়িয়াহাটের রাস্তায় দামুর রূপকথার অনুরণনকে আরো স্পষ্ট করতে এক বিপরীতধর্মী আবহ পাশাপাশি রাখার সফল সাহিত্য ধর্ম নিয়ে। সিনেমায় শহরের কোলাহল একেবারে বাদ দিয়ে রাজা সেন ছুটে যান বোলপুর, শান্তিনিকেতন, গোয়ালপাড়া,  তালতোড় কোঁপাই স্টেশন, আদিত্যপুর, যজ্ঞনগর, খোসকদমপুর, মহুলা, পাথর চাপড়ির গ্রামগঞ্জে। নির্মাণ করেন রূপকথা। সিনেমার শেষে রেশ রেখে দেন সেই আর এক দেশজ অনুষঙ্গের ব্যবহারে। সিনেমার শুরুতে ছিল সকালের লাল সূর্য ও আস্তে আস্তে সেই আলো বাড়তে থাকা পরবর্তী শটে— সূর্যোদয় বোঝাতে। তখন গল্প শুরু ছিল। একেবারে শেষে দামু লোক লস্কর নিয়ে রুনকুকে হাতির পিঠে চাপিয়ে পঞ্চানন মুখুজ্যের উঠোনের দিকে স্বপ্নের সার্থকতার মতো এগিয়ে চলে। পর্দায় সেই লাল সূর্য দূরে আস্তে আস্তে ঢলতে থাকল; আলো কমতে থাকল; সবাই সুখে শান্তিতে থাকল। পরিচালক বললেন, আমার গল্প ফুরোল এবার তোমরা ঘুমোও। বাংলার গ্রামে গঞ্জে যেভাবে সন্ধের পর বাচ্চারা রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। 

ক্রমশঃ

দামু (১৯৯৬) চলচ্চিত্রের শুটিং-স্টিল । পরিচালক রাজা সেন

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫

2 Responses

  1. নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অনেক দুর্ধর্ষ রচনা সফল চলচ্চিত্র হতে পারে নি। সেই নিরিখে দামু চলচ্চিত্র হিসেবে সফল। রাজা সেন মোটামুটি মূল গল্পের ঘটনা ও কিছু সংলাপ ধরে রেখেছেন। যদিও শুরুতে দাদুকে বোকা দেখাতে সিন দীর্ঘায়িত করেছেন। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্ট সবসময়ই নাটক ঘেঁষা হলেও দামু সেদিক দিয়ে ভালো। দু’জন অভিনেতা খুব ভালো অভিনয় করলেও চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নন। দামুর চরিত্রে রঘুবীর যাদব আর পটাইয়ের চরিত্রে সব‍্যসাচী চক্রবর্তী।
    সঙ্গীত অবশ‍্যই আরও ভালো হতে পারতো। দৃশ‍্য সজ্জাও।

  2. সিনেমাটিতে রঘুবীর যাদবের অভিনয় অনবদ্য।

Leave a Reply to Debdas Mukherjee Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *