দুই : খাঁচার পাখি বলে
আজ আমাদের বাড়িতে হঠাৎ আসা একটা লোহার খাঁচা থেকে একটি হলুদ রঙের পাখি দুপুর বেলায় উড়ে কোথায় যে চলে গেল ! ভালো ই হলো! সে তার জায়গায় ফিরে গেছে। তার তো উড়ে যাওয়ার ই কথা। বনে, জঙ্গলে, গাছের ডালে, পাতায় পাতায়। সে এখন নিশ্চয়ই অনেক দিন পর খুব আনন্দে আছে। কিন্তু সত্যি আনন্দে আছে তো ? খাঁচায় যে ছিল তারা ছিল দুজনে। দুটি হলুদ পাখি একসঙ্গে এসেছিল, ছিল জোড়ায়। কী তাদের ঝগড়া!কত তাদের কথা। কত ডাক। কত হাসি। কান্নাকাটি অবশ্য বোঝা যেত না। আমরা ওদের কথাবার্তা নিয়মিত শুনে শুনে, ওদের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেও যেতাম। আবার ওরাও উত্তর দিত যেন।
একদিন হল কী, একটা কালো কাক একজনের হলুদ পা ঠুকরে দিল। আসলে কাকটা ওদের খাঁচায় খাবার চুরি করে খেতে এসেছিল, খাবার পছন্দ হয়নি। তাই রেগেমেগে ঠোঁট দিয়ে এমন ভাবে একজনের পায়ে ঠুকরে দিয়ে গেল যে বেচারা একেবারে কাবু হয়ে গেল। না পারছে হাঁটতে, না পারছে কিছু খেতে। আর এক জনের তখন খুব মন খারাপ। সেও খাবে না। বন্ধু র শোকে মুহ্যমান। ঠোঁট দিয়ে ধীরে বুলিয়ে দিতো ঘা ।
বল্টু বলল, বাবা,ওর চিকিৎসা দরকার। ওষুধ এনে দাও। নাহলে কিন্তু পা ঠিক হবে না। ওষুধ এলো। বল্টু ওষুধ দিয়ে ক্ষতস্থানে নিয়মিত শুশ্রূষা করতে লাগলো। তার আগে স্থানটি হলুদ জলে পরিষ্কার করতো। তারপর তো ওষুধ। শেষে গা নরম তোয়ালে দিয়ে মুছে সুগন্ধি পাউডার ছড়িয়ে দিতো। কী তার যত্ন , সেবা! কদিন পর থেকেই সে ভালো হতে থাকলো। আর খুঁড়িয়ে হাঁটতো না। খাবার খেতে থাকলো, ঝগড়া , হাসি , কথা বলা আবার সব আগের মত। দুজনে দিব্যি বড় হচ্ছিল। হতে হতে আজই দুপুরে এই কান্ড। উড়ে চলে যাওয়া।
ওদিকে দুপুর থেকে আর একজনের তো বেজায় মন খারাপ। তার সঙ্গে কথা বলার কেউ যে নেই। মনখারাপে একেবারে চুপচাপ। খাচ্ছে না। ডাকছে না। দুপুরে ও চলে যাওয়ার পর খুব ডাকাডাকি করছিলো, খুঁজছিল। তারপর ধীরে ধীরে একেবারে চুপ হয়ে গেল। আগেও এরকম একবার হয়েছে। একজন একদিন উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল। হঠাৎ জানলা দিয়ে এক দুপুরে ঢুকে পড়লো ঘরে, খাঁচা র কাছে এসে যেন বলেছিল, টু–কি। আমরা ঘর বন্ধ করে তাকে হাতের মুঠোয় ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে দিতেই,সে কী সোহাগ। বল্টু বলল, ওরা এখন ভালোবাসা- বাসি করুক। চলো আমরা সরে যাই। খাঁচায় ঢাকনা দিয়ে সত্যি আমরা ওদের সেদিন একা থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।
কিন্তু আজ ? সারা দুপুর বিকেল কেটে গেল, সন্ধ্যা নেমেছে, কৈ, তার তো এখনও দেখা নেই। কী হবে ? বল্টু দুপুরে কেঁদেছে খুব। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেল বেলায় উঠে ঘুম জড়ানো গলায় বলে গেল,বাবা, কাল ঠিক ও এসে যাবে। দেখো।
আমাদের বারান্দায়ে ঝুঁকে পড়া ঝামরি বকুল গাছটা এখন কী চকচকে হয়েছে। প্রতিটি পাতা যেন কেউ রোজ মুছে দিয়ে যায় । সকাল বেলা র রোদ্দুর এ ঝিরঝির করে কাঁপে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি। রোজ কত রকম পাখির কিচিরমিচির যে শুনি। এতদিন কোথায় যে ছিল, কে জানে ? গাড়ির শব্দ নেই, গাড়লের মতো কেশে যাওয়া নেই। ধোঁয়া, ধুলো সেই কবে যে বিদায় নিয়েছে, চৈত্র মাসের কতোয়। এখন রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। বৈশাখ এখনও তপ্ত হয়নি। আর ওরা তাদের রাজত্ব বিস্তার করেছে যথাস্থানে। এই ইট কাঠ পাথরের দেশে।
বল্টু কে রাতে আজ বলে রেখেছি, চুপি চুপি, দেখিস কাল ও ফিরে এসে বকুল গাছের পাখিদের ঝাঁকে বসে ডাকবেই, টুকি —টুকি!
— তখন কী করবে ? কী করে ওকে ধরবে ? ও তো বকুলের ডালে বসে থাকবে , তাই না ?
বল্টু র আর্ত জিজ্ঞাসা।
—- থাকুক না। আমরা তো চাই, ওরা দুজনে আবার ভালোবাসা -বাসি করুক, তাই তো ? তুমিও তো তাই চাও। তবে আর ভয় কি ? চুপি চুপি খাঁচা টা ঘর থেকে বের করে, তোমার মা ঘুম থেকে ওঠার অনেক আগেই , বকুল গাছের কাছে এনে খাঁচার দরজাটা খুলে দেবো, বুঝলে ?
বল্টু ফিক করে হেসে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,
— লা জবাব। চলো চলো শুতে যাই। কাল ভোরের আলোয় উঠতে হবে।
কালকের নির্মল আলোয় ও আসুক। বকুল গাছের ডাল আর পাতায়। সাক্ষী থাকবে নীল আকাশ। আর রাতের বৃষ্টি , যা বকুল পাতায় ফোঁটা ফোঁটা থেকে যাবে।
ক্রমশঃ
কিস্তি একের লিঙ্ক : https://jibansmritiarchive.com/ei-asa-jaoyar-kheyar-koole-prasanta-maji/
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫