এক ছিল আণুবীক্ষণিক জগত, যেখানে খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব ক্ষুদ্র প্রাণীর রাজত্ব। আমাদের চারপাশে, এমনকি আমাদের দেহের ভেতরেও, তারা দিন-রাত তাদের কাজ করে চলেছে। এই আণুবীক্ষণিক সাম্রাজ্যের দুই প্রভাবশালী সত্তা, দুই রাজা – বাক্টেরিও, বিশাল এক পরিবারের দয়ালু শাসক, আর ভিরো, এক ছদ্মবেশী, রহস্যময় অভিযাত্রী।
বাক্টেরিও হলো জীবনের স্থপতি, একেবারে সাক্ষাৎ মহাপুরুষ, যাকে বলে জীবনের আর্কিটেক্ট!
তার রাজ্য অগণিত সদস্যে ভরা – কেউ গোল, কেউ দণ্ডাকার, কেউবা পেঁচানো। তবে সবাই এক নম্বর কর্মী, নিজের নিজের ডিউটি নিয়ে এক্কেবারে পটু।
মাটির গভীরে একদল বাক্টেরিও ২৪ ঘণ্টা ডিউটি দিয়ে মরা পাতা আর পচা ডালপালাকে এমন সুস্বাদু সারে পরিণত করে, যা দেখলে গাছের ও জিভে জল আসে! এদের কেরামতিতেই তো সবুজ বন-জঙ্গল টিকে আছে, নতুন নতুন চারা গজিয়ে উঠছে। আবার আরেকদল বাক্টেরিও গাছের শিকড় আঁকড়ে ধরে এমনভাবে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন টেনে আনে, যেন গাছের জন্য সরাসরি প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট!
তবে বাক্টেরিও সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে মানুষের শরীরকে। সেখানে তো তার কোটি কোটি আত্মীয়-স্বজন বাসা বেঁধেছে, বিশেষ করে আমাদের অন্ত্রে। সারাদিন ধরে খাবার হজম করতে সাহায্য করে, ভিটামিন তৈরি করে, এমনকি খারাপ জীবাণুদের আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষাও করে। বাক্টেরিও যখন দেখে তার পরিবারের পরিশ্রমে একটি শিশুর বৃদ্ধি হচ্ছে, অথবা একজন মানুষ সুস্থ জীবন যাপন করছে, তখন তার ক্ষুদ্র দেহে এক গভীর তৃপ্তি অনুভব করে। সে ভাবে, “আমার অস্তিত্বই তো সৃষ্টির জন্য, জীবনের জন্য!”
আর ভিরো হলো এক সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা। তার স্থায়ী কোনো রাজ্য নেই। সে এক যাযাবর ও ছদ্মবেশী সেনাপতি, যাকে বলে ফ্রি-ল্যান্সার ভিলেন। যার একমাত্র লক্ষ্য হলো বিজয়। ভিরো যখনই কোনো কোষের দেখা পায়, তার চোখে জ্বলজ্বল করে অধিকারের নেশা। সে যেন একটি চতুর চোর, অতি সন্তর্পণে কোষের দরজা খুলে একবার ভেতরে ঢুকতে পারলেই হলো! সোজা গিয়ে কোষের কন্ট্রোল রুম দখল করে নেয়। তারপর কোষের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে বসেই নিজের হাজার হাজার কপি তৈরি করতে শুরু করে, যেন পাইরেটেড ডিভিডি! আর যেই না তার নকল বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায়, তখনই সেই আশ্রয়দাতা কোষটিকে ধ্বংস করে বীরদর্পে বেরিয়ে আসে নতুন কোনো কোষের সন্ধানে।
ভিরোর এই অভিযান প্রায়শই তার আশ্রয়দাতাকে অসুস্থ করে তোলে। মানুষের জ্বর আসে, সর্দি হয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু ভিরোর কাছে এটা তার বংশবিস্তারের একমাত্র উপায়। সে মনে করে, “আমিই তো শক্তি! আমার জন্মই তো রাজত্ব করার জন্য, ছড়িয়ে পড়ার জন্য!”
বাক্টেরিও আর ভিরোর এই অদৃশ্য সাম্রাজ্যে টিকে থাকার কৌশল অভাবনীয়। বাক্টেরিও, যখন কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণের মুখে পড়ে, তখন সে নিজেকে এমনভাবে পাল্টে নেয়, যেন সেই একই অ্যান্টিবায়োটিক দ্বিতীয়বার তাকে আঘাত করতে না পারে। এটা হলো তাদের জিনগত পরিবর্তনের এক বিস্ময়কর ক্ষমতা, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা – প্রকৃতির এক চরম বুদ্ধিমত্তা।
আর ভিরো? সে ছিল আরও এক ধাপ এগিয়ে। যখন একটি শরীর তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ভিরো ততক্ষণে নিজের অসংখ্য ভিন্ন সংস্করণ তৈরি করে ফেলে। এই সংস্করণগুলো এতই নতুন হয় যে, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ওষুধ তাদের চিনতেই পারে না। ফ্লু ভাইরাসের প্রতি বছর নতুন রূপে ফিরে আসার রহস্য এখানেই। সে যেন এক ফ্যাশন সচেতন তারকা, প্রতি বছরই নতুন লুক নিয়ে হাজির হয়!
এভাবেই বাক্টেরিও ও ভিরো, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আর জীবনধারা নিয়ে, এই অদৃশ্য সাম্রাজ্যের দুই প্রধান খেলোয়াড় হয়ে আছে। একজন দেয় জীবন, অন্যজন নেয় পরীক্ষা। একজন গড়ে তোলে সুস্থতার প্রাসাদ, অন্যজন আনে সাময়িক বিশৃঙ্খলা। তাদের এই নীরব যুদ্ধ আর টিকে থাকার মহাকাব্যই আমাদের অদৃশ্য জগতের সবচেয়ে কৌতূহলী গল্প।
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫
Darun to! Besh unique lekha, ebhabe bhaba hoeni.