অণুগল্প :
এখনো কানে বাজে সেই ‘মা’ ডাক ! প্রথম প্রথম ডাকটা মিষ্টি শোনাতো কানে, মনে না হলেও। তার পর যত দিন চলে গেছে ভবিষ্যতের পানে তার প্রাণে ডাকটা বিষ ঢেলে দিতো। মেরিনা নিজেকে অসহায় মনে করতো! পরিত্রাণ পেতে চাইতো । পথ খুঁজে পায় নি। অতঃপর বিয়ের পর তার নিষ্কৃতি মেলে। বস্তুত বিয়ের পথেই তার সংকট মুক্তি ঘটে।
তার বড়দা প্রথম তাকে নিয়ে যায় লোকটার কাছে। নামী-দামী মানুষ । বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর। মুসলমান সমাজে তো বটেই , অন্য সমাজেও স্বীকৃতি কেড়ে নিয়েছেন তিনি। মেরিনা মেধাবী ছাত্রী । সে তখন ডাক্তারি পড়ছে। ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। তার ভাইয়ার ভালো লাগতো বোনকে বড় বড় নাম-খ্যাতি পাওয়া মানুষদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। মেরিনার পছন্দ হতো না ভাইয়ার এই ধরনের মানসিকতা। তবু সে তার কথা অমান্যও করতে পারতো না। সেভাবেই পরিচয় ঘটে লোকটার সঙ্গে। ধনী ব্যক্তি। দুই বালক সন্তানের বাবা। স্ত্রী ব্যারিস্টার-কন্যা। দীঘাঙ্গী। সুদর্শনা না হলেও সুরূপাই বলা চলে । লোকটা কিছুদিন পরিচয় হওয়ার পর থেকে ‘মা’ ‘মা’ ডাকে মন কেড়ে নিয়ে আসল স্বরূপ প্রকাশ করতে থাকলো।
– চলো মা। আজ একটা ভালো অনুষ্ঠান আছে রবীন্দ্র সদনে। গানের অনুষ্ঠান। শুনবে চলো ।
– আজ চলো। তোমাকে একজন মস্ত ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।
– আজ এমন একজনের কাছে নিয়ে যাবো যাঁর সহায়তা পেলে তুমি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে আসতে পারবে! তারপর তোমার উন্নতি রোখে কে দেখবো!
এমন সব কথা বলে ভোলানোর কৌশল লোকটা অবলম্বন করতে থাকলো। মেরিনার ইচ্ছে করে না এসব ডাকে সাড়া দিতে। তবু অভদ্রতা করতে সে শেখেনি। ফলে তার সঙ্গে যেতে থাকে নিজের তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এখানে-সেখানে।
দু-তিন মাস যেতে লোকটি তার গোপনাঙ্গে হাত নিয়ে যাওয়ার সাহস দেখালো একটি অনুষ্ঠানে পাশে বসে। তারপর গাড়িতে যেতে যেতে মুখে মুখ ঠেকানো চলতে থাকলো। ক্রমে ক্রমে সাহস যেন তার বাড়তে থাকলো।
মেরিনা হতভম্ব! এও সম্ভব! একটা মাঝবয়সী ভদ্র সভ্য সমাজের সদস্য শিক্ষিত মানুষ এমন হতে পারে! সে তীব্র প্রতিবাদ করতে পারছে না। কি করবে বুঝে পায় না। ভাইয়া তার অভিভাবক। তাকে কিছু বলতেও পারছে না! লোকটা ক্রমে সাহসী হয়ে উঠলো আরও । তার স্তন স্পর্শ করে ‘মজা’ পেতে থাকলো। কিছুদিন পর পর গাড়িতে করে এর বাড়ি ওর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পথে সরাসরি বুকে মুখ রাখার স্পর্ধাও দেখিয়ে ফেললো। মেরিনা কিছুই বলতে পারছে না। মৌন। নির্বাক। যেন তার বোবা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সে লোকটাকে ভাইয়ার শেখানো ‘চাচামনি’ বলে ডাকতো। সে ডাক সে বর্জন করলো। লোকটার কিন্তু ‘মা ‘ ‘মা’ ডাক আরও বেড়ে গেলো। ভন্ডামির চূড়ান্ত! মেরিনা কাকে বলে সেসব কথা! ভালো না লাগার আগুনে পুড়তে থাকলো প্রতিদিন। ইতিমধ্যে সে ডাক্তারি পাশ করেছে। অকস্মাৎ একটি বিয়ের সম্বন্ধ আসাতে সে সম্মতি প্রকাশ করে ফেললো। তা দেখে বাড়ির সকলে অবাক! এতদিন ধরে সে বলে আসছিল- ‘বিয়ে করতে চাই না। করবো না।’ তার এই সম্মতিতে তাই সকলে খুশি । বিয়ে হয়ে গেলো ধূমধাম করে। মেরিনার মনে হল, তার জীবনে যেন কালসাপের দংশনজ্বালা থেকে মুক্তি ঘটলো! তারপর দিন কেটে গেছে দিনের নিয়মে। লোকটা তাকে ছেড়েছে।
মেরিনা এক পুত্র সন্তানের জননী আজ । জীবনসঙ্গী মানুষটি চলনসই। ডাক্তার হিসেবে সে আজ প্রতিষ্ঠিত। রোগীরা সকলেই তার আপনজন হয়ে পড়ে । সে তাতেই মহা আনন্দ উপভোগ করে। খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে চলেছে তার জীবন। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে লোকটাকে আর ভাবে পুরুষের কাম কেন এতো ভয়াবহ হয়! এই কাম দুর্দমনীয়। বয়স মানে না। মেয়েদের অসহায় বানায়। সে আজও বসে সেই কথাগুলোই ভাবছিল এবং প্রায়ই ভাবে সে । অকস্মাৎ একটি খবর পেয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে বসেছিল এতক্ষন । লোকটি গতকাল রাতে কলকাতার বাইরে থেকে ফেরার পথে ট্রেনের মধ্যেই হার্ট ফেল করে মারা গেছে।
মেরিনার বহুবছর ধরে চেপে রাখা চোখের পানি আজ আর বাধা মানলো না!
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫