উত্তরণের পথই এনে দেয় মুক্তির আস্বাদ। আর এই মুক্তির স্বাদ পেতে মন যখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তখন আমাদের অবলম্বন, আমাদের আশ্রয় হয়ে ওঠেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। জীবনের সর্বত্র, যে কোনোরকম পরিস্থিতিতে, অভিব্যক্তিতে, তিনিই হয়ে ওঠেন আমাদের পথপ্রদর্শক। তাঁর সৃষ্টি, তাঁর জীবনবোধের মধ্যেই আমরা খুঁজে পাই আমাদের দিশা, আমাদের প্রশ্নের উত্তর। আরো নিবিড়ভাবে খুঁজে পেতে চাই আমাদের মুক্তি।
উদাত্ত মন, প্রসারিত মনন, গভীর অন্তর্দৃষ্টিই এনে দিতে পারে আমাদের মনে মুক্তি। ‘মুক্তির উপায়’ খুঁজেছেন তিনি বারংবার, নানা ভাবে । কখনও কূপমন্ডুকতা, সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বপ্রকৃতির কাছে মেলে ধরেছেন নিজেকে। তাঁর কাছে প্রতিটি দিন ও রাত্রি সৌন্দর্যের নতুন নতুন সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয়েছে । কখনও বিশ্বাস রেখেছেন কর্মযোগে- যেখানে তিনি ‘রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে, ধূলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে।’
একটি চিঠিতে লিখেছেন… ‘আমি প্রায়ই এক সময়ে ভাবি এই যে, আমার জীবনে প্রত্যহ একটি একটি করে দিন আসছে। কোনোটি সূর্যোদয় সূর্যাস্তে রাঙা, কোনটি ঘনঘোর মেঘে স্নিগ্ধনীল, কোনটি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় সাদা, ফুলের মতো প্রফুল্ল, এগুলি কি আমার কম সৌভাগ্য।’ তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টি আমাদের দেখিয়েছে মুক্তির পথ।
প্রকৃতির কাছে বারংবার তিনি হাত পেতেছেন। সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন নিজেকে। তাঁর চিঠিপত্রের মধ্যেও ফিরে ফিরে এসেছে এই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর একাত্ম হওয়ার আকুতি। একটি চিঠিতে তিনি ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন,
‘আমাকে একবার তোর চিঠিগুলি দিস, আমি কেবল ওর থেকে আমার সৌন্দর্যসম্ভোগগুলো একটা খাতায় টুকে নেব। …তখন আজকেকার এই পদ্মার চর এবং স্নিগ্ধ শান্ত বসন্ত জ্যোৎস্না ঠিক এমনি টাটকাভাবে ফিরে পাব। আমার গদ্যে পদ্যে কোথাও আমার সুখদুঃখের দিনরাত্রিগুলি এরকম করে গাঁথা নেই।’
তাঁর উপলব্ধিতে তিনি অধরাকে অধরা হিসেবেই মান দিতে চেয়েছেন। বুঝেছেন, সব শেষের তল পাওয়া যায় না, তল পেতে নেই। কিছু প্রশ্নের উত্তর অজানা থাকাই শ্রেয়। তাই অজানার প্রতি, অচেনার প্রতি আরো গভীর অনুরাগ জন্মেছে তাঁর। তাঁর মুক্ত দৃষ্টি দিয়ে তিনি বহির্বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে, নিজের মনে। তিনি অনুভব করেছেন, বিশ্বপ্রকৃতির একটি চিরন্তন সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যেন তিনি নিজেই। শৈশবে যে অসম্ভবের প্রত্যাশা নিয়ে তিনি এই চেনা পৃথিবীর সামনে এসে দাঁড়াতেন, পরিণত বয়সেও ঠিক সেভাবেই এসে দাঁড়িয়েছেন এবং প্রতিবারই ঘটেছে দুর্লভ কোনো প্রাপ্তি। তাঁর পথিক সত্তা তাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে এক শূন্যতার সামনে, যেই শূন্যতায় তিনি পরিপূর্ণ হতে চেয়েছেন বারবার। নিজেকে বলেছেন ‘অচেনাকে, চিনে চিনে, উঠবে জীবন ভ’রে’।
যুক্তি বুদ্ধির ঊর্ধ্বে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছেন তিনি।
‘যুক্তি নয়, বুদ্ধি নয়,
শুধু যেথা কত কী যে হয়–
কেন হয় কিসে হয় সে প্রশ্নের কোনো
নাহি মেলে উত্তর কখনো।
যেথা আদিপিতামহী পড়ে বিশ্ব-পাঁচালির ছড়া
ইঙ্গিতের অনুপ্রাসে গড়া–
কেবল ধ্বনির ঘাতে বক্ষস্পন্দে দোলন দুলায়ে
মনেরে ভুলায়ে
নিয়ে যায় অস্তিত্বের ইন্দ্রজাল যেই কেন্দ্রস্থলে, বোধের প্রত্যুষে যেথা বুদ্ধির প্রদীপ নাহি জ্বলে।’
নিজের ভেতর নিজেকে অবিরত খুঁজে যাওয়া, খুঁজে পাওয়া, সেও তো মুক্তি। আপন সত্তা মাঝে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেওয়া। মোহিতচন্দ্র সেন কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন
‘আপনি ছেলেবেলায় অতীতের মধ্যে ছিলেন, আমি ছিলেম একটা অনির্দিষ্ট, অনাগত, অপরূপের অপেক্ষায়। একটা কিছু দেখব, একটা কিছু আসবে, হঠাৎ এক জায়গায় কোথাও যাব, এইরকম ছিল আমার মনের উন্মুখ অবস্থা।’
‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি’…..বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ, পথের নেশা, পথকে চেনা জানার তাগিদ বারবার তাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে বহির্বিশ্বের দরজায়। তাঁর পথিক সত্তা বারবার তাকে প্রশ্ন করেছে, এ ‘পথের শেষ কোথায়’? তাই তো তিনি চেয়েছেন আগামী প্রজন্মও যাতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে বিশ্বের সামনে। সারা পৃথিবীর মহত্ত্ব, ঔদার্যের সঙ্গে যেন পরিচয় ঘটে তাদের। তারা যেন দূর কে তাদের নিকট বন্ধু করতে পারে, তাদের কাছে যেন উন্মোচিত হয় বিশ্বের যত গূঢ় রহস্য। তারা যেন পায় সেই অমৃতের সন্ধান। এই রহস্যকে জানবার তাগিদে তিনি বারবার নিঃসঙ্কোচে হাত পেতেছেন প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির প্রতি এক অদ্ভুত রোম্যান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন কবি। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ঋতু বর্ষা। শান্তিনিকেতনে বর্ষার আগমনকে কৌতুক মিশিয়ে বর্ণনা করেছেন কবি – ‘এতদিন শ্রাবণের দেখা ছিল না, যেই বিশে একুশ হয়েছে অমনি যেন কোনোমতে ছুটতে ছুটতে শেষ ট্রেনটা ধরে হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির। কম হাঁপাচ্ছে না – তার হাঁপানির বেগে আমাদের শালবন বিচলিত, আমলকীবন কম্পান্বিত,তালবন মর্মরিত, বাঁধের জল কল্লোলিত, কচি ধানের ক্ষেত হিল্লোলিত, আর আমার এই জানলার খড়খড়িগুলো ক্ষণে ক্ষণে খড়খড়াইত।’ তাঁর জীবনের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্তির পথের পথিক করেছেন তিনি। তাই তো তিনি বলেছেন : ‘চিরদিন আমি পথের নেশায়, পাথেয় করেছি হেলা’।
‘ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি,
নমহস্তেস্তু মা মা হিংসীঃ।’
রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে তাঁর জীবনদেবতা। বিশেষ করে ‘চিত্রা’ কাব্য রচনাকালে এই জীবনদেবতা তাঁর প্রেমের মহিমায়, কবিসত্তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। তাঁর মনের মুক্তির পথ এই জীবনদেবতা। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় কে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন – ‘ধর্মশাস্ত্রে যাঁহাকে ঈশ্বর বলে, তিনি বিশ্বলোকের; আমি তাঁহার কথা বলি নাই। যিনি বিশেষ রূপে আমার, অনাদি অনন্তকাল, একমাত্র আমার, আমার সমস্ত জগৎসংসার সম্পূর্ণরূপে যাঁহার দ্বারা আচ্ছন্ন, যিনি আমার এবং আমি যাঁহার, যিনি আমার অন্তরে এবং যাঁহার অন্তরে আমি, যাঁহাকে ছাড়া আমি কাহাকেও ভালবাসিতে পারি না। যিনি ছাড়া আর কেহ আমাকে আনন্দ দিতে পারে না।’
এই যে তাঁর সমর্পণ, এটাও তো মুক্তি। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবনদেবতার স্বরূপই বিশ্ববোধ।
‘মুক্ত কর ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়…’
নিজের সমস্ত দূর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে তবেই তো মুক্তির পথ প্রশস্ত হবে। মৃত্যুতেই কি মুক্তি? না, রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর জীবন, তাঁর সৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়েছেন, বাঁচার মত বাঁচাই এনে দিতে পারে মুক্তির স্বাদ। মৃত্যুতেই শেষ বা অবসান নয়। তাই তো তিনি বলেছেন, ‘ফুরায় যা তা, ফুরায় শুধু চোখে’। কিন্তু আসল মুক্তি -বেঁচে থাকা। তিনি বলেছেন: ‘জীবনের ধর্মই হল চলিষ্ণুতা। চলার মধ্যে দিয়েই জীবনকে নবীন থাকতে হয়, নবীন হয়ে উঠতে হয়’। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে – মৃত্যু যেমন আমাদের সীমাবদ্ধ করে, আবার মৃত্যুই আমাদের সীমামুক্ত করে দেয়। আর এইখানেই আমাদের মুক্তি। তাই যা কিছু পঙ্কিল, তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, মননে, চিন্তনে হতে হবে উদার। অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার ইচ্ছে নিয়ে মেলে দিতে হবে দু’ডানা। ধারণ করতে হবে প্রকৃতিকে, লালন করতে হবে স্বপ্নকে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দিতে হবে ন্যায়ের আশ্বাস। শূন্য থেকে পূর্ণের দিকে উত্তরণ ঘটলে, তবেই তো আসবে মুক্তি। তবেই তো বলতে পারব আমরা…
‘আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায়, ঘাসে ঘাসে / এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’।
ছিন্নপত্রাবলি
রবীন্দ্রপত্রে : ডঃ অনিন্দিতা গুহ
গীতবিতান
গীতাঞ্জলি
গুরুদেব : রাণী চন্দ
যুক্তি নয় বুদ্ধি নয় : আকাশপ্রদীপ
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে : গীতাঞ্জলি
জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ
যুগ্ম সম্পাদক : অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।
প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল
সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা
প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫