Jibansmriti Archive

পোস্টার : ১

পোস্টার ওয়ার্কশপ জন্ম নেয় কয়েকজন শিল্পীর চায়ের গ্লাস হাতে আড্ডার মধ্যে দিয়ে। সেদিন একটা সভা বসেছিল বাংলা পোস্টার নিয়ে আলোচনার জন্য।

আমি একটা সময়, সময়টা মনে নেই, বাংলা পোস্টার জোগাড় করা শুরু করি। যেখানে, যার কাছে বাংলা পোস্টার পাওয়া যাবে শুনেছি, জেনেছি, পৌঁছে গেছি, পোস্টার পেয়েছি। এই সব পোস্টার ছিল ছাপা পোস্টার, কখনও হাতে আঁকা।

একটা সময় বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগ, চারুকলা অনুষদ থেকে নিসার হোসেনের ডাক আসে সেখানে বাংলা পোস্টারের একটা প্রদর্শনী করার জন্য। নিসার চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, আমার বন্ধু। আমি যখন পোস্টার সংগ্রহে বাংলাদেশে যেতাম, সেই থেকেই বন্ধুতার শুরু। চারুকলা অনুষদের আর একজন শিল্প শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্যও আমার বন্ধু।  

নিসারদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চারুকলার প্রদর্শনী ঘরেই বাংলা পোস্টার, দুই বাংলার পোস্টার টাঙানো হলো।

এই অনুষ্ঠানটির বিষয়ে এ বাংলার পোস্টার শিল্পীদের মধ্যে যাদের পোস্টার ঢাকার প্রদর্শনীতে ছিল, তাদের নিয়ে এক আড্ডা বসানো হলো চারুকলা অ্যাকাডেমির একটা ঘরে। অনেকে এসেছিল- শিল্পী, শিল্প-আলোচক, শিল্প-গবেষক। সাধারণ ভাবে পোস্টার নিয়ে কথা বলা, তক্কো করা এই সব।  

পোস্টার : ২

এই আলোচনার দিনটিতে চা-পানের বিরতিতে বাইরে বেরিয়ে দেখি কয়েকজন তরুণ শিল্পী বন্ধু চায়ের গেলাস হাতে আড্ডা দিচ্ছে—বাংলা পোস্টার নিয়ে আজকের আলোচনাতেই ব্যাপারটা শেষ করে না দিয়ে এটাকে কোনোভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। কাঞ্চন, অংশু, অতনু, জগন্নাথ আর সমীর। এদেরই দাবীতে শুরু হলো ‘পোস্টার ওয়ার্কশপ’। অনেকে এসেছে, চলে গেছে। তবে সবসময় জমজমাট থেকেছে ‘পোস্টার ওয়ার্কশপ’। আমার জানা নেই পোস্টার নিয়ে অন্য কোনও দল আছে কিনা।

এক জায়গায় জড়ো হওয়া, যে যার মতো পোস্টার আঁকা। পোস্টারে শুধু কথা, শুধু ছবি, শুধু ছবি-কথা। পরের দিকে আগে থেকে ঠিক করে বিষয়ে আঁকা। যে কটি মনে পড়ছে লিখছি –পরিবেশ, নারীদের অধিকার, ধর্ম, মে দিবস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর, স্বাধীনতা ৭৫, ভাষা, এমন সব বিষয় আগে থেকে বেছে নেওয়া পোস্টার আঁকার জন্য। নানা সময়ে নানা শিল্পী এসেছিল, চলে গিয়েছিল। যতটা মনে পড়ে নাম লিখছি – কাঞ্চন, সমীর, অংশু, জগন্নাথ, অতনু, তাপস, দীপক, মালিনী, শুভেন্দু, মানসী, পার্থ, অনিরুদ্ধ, রাতুল, সম্বরণ, সমীর২, সন্দীপন, সঞ্জীব, শুভেন্দু২, সুকুমার, স্বপ্না, তাপস২,অলকানন্দা, পাভেল, শিবশঙ্কর, সৃজন, সুশান্ত, স্বরূপ, সঞ্জয়, সর্বজিৎ, সোমশঙ্কর, হিরণ, প্রসেনজিৎ, চিন্ময়, সায়নী, তৌফিক, অভিজিৎ, আকাশ, অমিতা, আশিস, ভাস্বর, চিত্ত, মঞ্জুশ্রী, মীরা, রজত, স্বর্ণেন্দু, তনুশ্রী, বিশ্ব, জয়স্মিতা, মিতা, মাধব, শুভেন্দু৩, সুকান্ত, সুমি, সোমা, কৌস্তুভ, শুভঙ্কর, রূপম, পার্থপ্রতিম, উদয়, শমিত।

পোস্টার : ৩

সবার নাম যে লিখতে পারলাম এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারছিনা। কাগজপত্তর গুছিয়ে রাখাটা চালু করা যায়নি।

পোস্টার শুধু আঁকা নয়, পোস্টার নিয়ে আড্ডা, নানা বিষয়ে – পোস্টারের দরকার কেন, পোস্টার আঁকার ধরণ, অক্ষর ও ছবি নিয়ে আলোচনা, পোস্টার দেখানো কিভাবে, এই সব, এরকম সব।

একটা সম্মিলিত বিষয় ছিল – পোস্টারে ছবি ও অক্ষর। সবাই ছবি আঁকতে পারে না, সবার অক্ষর আঁকা ভালো নয়। শুরু হল একটা পোস্টার দুজনে মিলে বানানো। একজনের ছবি, অন্যজনের আঁকা অক্ষর। একজনের অক্ষর, অন্যজনের আঁকা ছবি। কখনো ছবি আঁকা আগে, কখনো অক্ষর আগে আঁকা। একটা পোস্টার দুজনে মিলে বানানো।

শুরুতে রং তুলি যে যার বাড়ি থেকে। কাগজ দল থেকে। পরে রং ও আঠা কেনা দল থেকে। কাগজ ছিঁড়ে কোলাজ দিয়ে পোস্টার বানানোর জন্য আঠা। এসব কেনার পয়সা তোলা হতো আড্ডার শেষে। যে যা পারতো দিতো—সেসব জমিয়ে।

পোস্টার : ৪

পোস্টার ওয়ার্কশপের কোনো কোষাধ্যক্ষ, সভাপতি, সম্পাদক, নির্দিষ্ট চাঁদা এসব ছিল না। সবাই মিলে সবার সংগঠন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সিদ্ধান্তকে কাজে নিয়ে আসা।

পোস্টার ওয়ার্কশপ বসতো সকালে, শেষ হতো সন্ধ্যায়। মাঝখানে একটু খেয়ে নেওয়া। গোল হয়ে বসে, মধ্যিখানে খাবার রেখে খেতে খেতে আড্ডা। পয়সা তুলে কিনে আনা রুটি, আলুর দম কিংবা ডিমের দম।

পরের দিকে একটা পরীক্ষায় নামা হয়েছিল। যে যে পারবে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসবে সবার জন্য। আগে ঘোষণা করা কে কি আনতে পারবে, যাতে আরেকজন সেটি না আনে। অনেক খাবার হয়ে যেতো। মিষ্টি, ভাজাভুজি সরিয়ে রাখা হতো আড্ডা শেষে চায়ের সাথে খাওয়া হবে।

 পোস্টার আঁকার আড্ডা বসতো নানা জায়গায়। ‘একত্রে’ নামের ভাড়া পাওয়া বাড়িতে, তৌফিক, শুভেন্দুর বাড়িতে, অলকানন্দা সন্দীপনের বই ঘরে, বই মেলার মাঠে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে, পার্ক সার্কাস ময়দানে, বিক্ষোভ সমাবেশে, কলেজ স্ট্রিট পাড়ার ফুটপাথে, গড়িয়াহাট ব্রিজের নিচে, উত্তরবাংলার বনবাসীদের মেলায়, বেলুড় শ্রমজীবী পাঠশালা প্রাঙ্গণে। সব জায়গায় যে সবাই যেতো তা নয়, যে পারত সে।

পোস্টার : ৫

আমাদের পোস্টার দেখানো হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, বইমেলায়, চারুকলা মেলায়, শান্তিপুরে মিড-ডে মিল কর্মীদের আন্দোলনে, বইমেলায় নাগরিক মঞ্চের স্টলে, মহাজাতি সদনে সারা ভারত বনজীবী সম্মেলনে, উত্তরপাড়া জীবনস্মৃতি আর্কাইভ এবং সুন্দরবনে।

আমাদের পোস্টার বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কাজে ব্যাবহার করেছে।

চারুকলা মেলায় পোস্টার ওয়ার্কশপ স্টল দিতো। আমাদের আঁকা পোস্টার টাঙানো থাকতো, পোস্টার নিয়ে বই থাকতো, দর্শকরা ভেতরে ঢুকে দেখতো, কিনতো। স্টলের সামনে খোলা জায়গায় আমরা পোস্টার আঁকতাম দর্শকরাও বসে যেতো আমাদের রং আর তুলি নিয়ে পোস্টার আঁকতে। খোঁজ খবর নিতো আমাদের দলের।

পোস্টার : ৬

পোস্টার ওয়ার্কশপের জমে থাকা পোস্টার রাখার কথা হয়েছে দু’ জায়গায়। উত্তরপাড়ার মহাফেজখানায় আর কোন্নগরে প্রস্তাবিত শ্রমিক মহাফেজখানায়। এমন সংগ্রহ আর আছে কিনা জানা নেই।

 পোস্টার ওয়ার্কশপের পোস্টার হতো নানাধরণের। প্রশিক্ষিত শিল্পী, অপ্রশিক্ষিত শিল্পী। প্রশিক্ষিত বলতে শিল্পকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ। হাতে আঁকা অক্ষর কারোর ভালো, কারোর অতটা ভালো নয়। তাই মিলেমিশে পোস্টার বানানো, যৌথতা।

পোস্টার : ৭

পোস্টার ওয়ার্কশপের মধ্যে একটা সংঘবদ্ধতা ছিল। এর রং ও ব্যবহার করছে, ওর তুলি এ কাজে লাগাচ্ছে। ছবি আঁকতে আঁকতে এ ওর সাথে আড্ডা দিয়ে নিচ্ছে। কেউ একজন উঠে গিয়ে চা বানিয়ে সবাইকে দেওয়া শুরু করেছে, আর একজন উঠে গিয়ে দেওয়ার কাজটায় হাত বাড়িয়ে দিল। প্রায়ই আঁকার শেষে গান গাওয়া হতো। গানের মাঝখানে কেউ একজন একটা ডুবগি বাজাতে শুরু করলো। পোস্টার নিয়ে কথা বলায় ভিন্ন রং হয়েছে, ভিন্নতা হয়নি। পুরনো দিনের একটা যৌথ পরিবারের মেজাজ তৈরি হতো।

পোস্টার : ৮

পোস্টার সংগ্রহ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *