Jibansmriti Archive


সমীপেষু দাস


ইতিহাস শুধু কোনও বিষয়ে বাঁধা থাকে না; বরং তা সময়রেখায় চলতে থাকা সভ্যতা ও সংস্কৃতির চলমান লিপি। আজ যা ‘হয়’, আগামী দিনে তাই-ই হবে ‘হয়েছিল’। তা কখনও রূপ বদলায়, আবার কখনও সেই বদলেই তার নিজরূপ সৃষ্টি হয়। বাঙালির সংস্কৃতির মধ্যেই গতকালের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্মৃতিচারণা চিরদিনের ঐতিহ্য। অতীতকে আবারও একবার দেখার নামই স্মৃতিকথা। তাই স্মৃতি যতই পুরোনো হোকনা কেন; স্মৃতিকথা সবসময়ই হয় ‘নতুন’। তা পূর্বপুরুষদেরও হতে পারে, আবার হতে পারে তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা অনুষঙ্গ। সচেতন মানুষ নিয়মিত সেই স্মৃতিবিজড়িত সামগ্রীর ধুলো পরিষ্কার করে। তাই বেশ কিছু জিনিস আজও যত্নের সঙ্গেও রয়ে গেছে কিছু বাড়িতে বা গ্রাম, শহরের আনাচে-কানাচে। পথে যেতে যেতেই কখনও চোখে পড়ে পুরোনো ডাকবাক্স, রং ওঠা সাইনবোর্ড বা কখনও পলেস্তারা খসে যাওয়া কোনও স্থাপত্য। বাড়ির চিলেকোঠায় পড়ে থাকে পুরোনো দিনের হারমোনিয়াম, বাসনপত্র, টেলিভিশন, খেলনা, শিশিবোতল আরও কত কি। এরকম পড়ে থাকা জিনিসপত্রেই আজও মিশে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। একথা কেউ বলতেই পারেন যে এই ধরণের ব্যক্তিগত সামগ্রী কীভাবে ইতিহাসের শরিক হতে পারে। সাধারণভাবে ইতিহাস বলতে বোঝায় সমাজবিজ্ঞানের ধারাবিবরণী। সেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি, সুশীল সংস্কৃতি ও সর্বোপরি কোনও জনগোষ্ঠীর নৃতত্ত্বকেই চিনে নেওয়া যায়। হ্যাঁ; একথা অস্বীকার করার কোনও পথ নেই। তবে তারই সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে যে কোনও সামগ্রিক পটভূমির মধ্যেই রয়ে যায় সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও প্রযুক্তিগত কৌশল। ব্রিটিশ যুগে যদি mobile phone, internet ব্যবহার থাকত, তবে হয়ত সেদিনের ঘটনা অন্যরকম হতে পারত। তাই সেকালের চিঠিপত্র অবশ্যই চলমান সংস্কৃতির অঙ্গ।

রাজ থেকে স্বরাজ প্রদর্শনীর ছবি – এক

জরুরি খবর আদানপ্রদান থেকে শুরু ক’রে সুখ-দুঃখের নানা কথা চিঠির মাধ্যমেই পৌঁছাত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। পূর্বপ্রজন্মের কাছে ডায়েরির পাতায় ঝাপসা লেখাও ব’লে দেয় সেকালের ঝর্ণা কলম ও কালির কথা। তাই কোনও মিষ্টান্ন বা বাণিজ্যিক সংস্থার  বিজ্ঞাপন বা সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের সঙ্গে এও দেখতে হবে যে তার ব্যবহারিক দিক কেমন ছিল। ব্রোমাইড ছবির সঙ্গে ক্যামেরা, কালির সঙ্গে কলম, চরকার সঙ্গে খদ্দরের কাপড়, সংবাদপত্রের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনকে না দেখলে ইতিহাসের কাঠামোকে চিনতে অসুবিধা হতে পারে। সম্প্রতি ৬ থেকে ৮ই জুন, ২০২৫ কলকাতার শ্রী অরবিন্দ ভবন ও কলকাতা কথকতা-র যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘রাজ থেকে স্বরাজ : স্বাদেশিকতা ও শিল্প-সংস্কৃতি’ বিষয়ক এক প্রদর্শনী। বিশেষ অংশগ্রহণে থেকেছে দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রম। উদ্বোধন পর্বে উপস্থিত থেকেছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পৌত্রী শ্রীমতী অদিতি মুখোপাধ্যায়, মাননীয় বিচারপতিদ্বয় শ্রী চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় ও শ্রী শ্যামল কুমার সেন মহাশয়। ঋষি অরবিন্দ ঘোষ ও তৎপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গেই ব্রিটিশ যুগের ভারতের অবস্থান ও বিশেষতঃ বাঙালি বিপ্লবীদের কার্যকলাপের স্বাক্ষর মেলে ধরেছে এই প্রদর্শনী। সেখানে স্মৃতির সঙ্গেই উঠে এসেছে সংগ্রহের নানাবিধ নমুনা।

স্বদেশী যুগের বিভিন্ন মুদ্রাসহ যুগান্তরে প্রকাশিত বঙ্গবিভাগের সমর্থন প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট তারিখের  The Statesman সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠার সেই “TWO DOMINIONS ARE BORN” বা অন্যত্র “জাগে নব ভারতের জনতা”র ম’ত কথা যেন সেদিনের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এছাড়াও চোখে পড়েছে বঙ্গেশ্বরী কটন মিলস্ লিঃ, লিও ম্যান্টল্, বঙ্গীয় দিয়াশলাই কার্যালয় বা পোস্ট অফিস ও রেলস্টেশনে ছ আনায় পাওয়া ম্যালেরিয়া কম্পজ্বর, প্লীহাজ্বরের নিরাময়ক কুইনাইন ওষুধের ম’ত বিজ্ঞাপন। একসময় বিলেতি দ্রব্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন স্বদেশী বিপ্লবীরা। তবে সেই বিলেতি দ্রব্যের একটুকরো রেখা সেখানে উঠে এসেছিল। ম্যাঞ্চেস্টারে তৈরি বস্ত্রের লেবেলগুলি অনবদ্য এক নথি। সেখানে দেখা যায় যে দুর্গা, রাম-দরবার, গঙ্গার ম’ত পৌরাণিক চরিত্রের ছবি। সুতরাং বিদেশী হলেও তাতে ছিল ভারতের সংস্কৃতির ছাপ। স্বদেশী যুগ ছিল অগ্নিযুগ। তাই দেশলাইয়ের কথা না বললেই নয়। সেসময়ের বিভিন্ন দেশলাইবাক্স দেখে নেওয়া সম্ভব হয়েছে প্রদর্শনীতে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের হস্তলিপি ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে আবৃত্তির রেকর্ডিং দেখা পাওয়ায় দর্শক ও অতিথিরা এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দের মত মনীষীদের ছবি সহ পুরোনো কলিকাতার বিভিন্ন ছবির সারি দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। সস্ত্রীক গান্ধীজির এমন একখানি ছবি দেখতে পেয়েছে দর্শক যা U Ray & Sons থেকে প্রকাশিত।

রাজ থেকে স্বরাজ প্রদর্শনীর ছবি – তিন

আবার Indian Medical Service-এর কর্মীদের পোশাক মনে করিয়েছে সেকালের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাবধানতার দিক। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের পোশাকের ধরণ ও রং বদলেছে। তাই এগুলিই ইতিহাস থেকে উঠে আসা এক সংগ্রহ। কারোর ঠাকুরদা বা পরিবারের কারোর স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও বর্তমানে তা বিশেষের চেহারা ছেড়ে হয়ে পড়েছে সাধারণের। বিভিন্ন ধরণের লণ্ঠন, ক্যামেরা দেখিয়েছে তখনকার মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল। আবার সুদূর জাপান, জার্মানি থেকে আসা বা বাংলার pottery কেন্দ্রে পোর্সেলিনে প্রস্তুত ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী দেবদেবীর মূর্তিকলার আঙ্গিক তৎকালীন সম্ভ্রান্ত পরিবারের নান্দনিক অভিরুচিকে প্রকাশ করেছে। এই পোর্সেলিনের মূর্তিগুলি থেকে আজকের দিনের মাটি, মার্বেল পাথর বা অন্যান্য উপাদানে তৈরি মূর্তিগুলি কতখানি ভিন্ন হয়েছে বা শৈল্পিক প্রকাশ কীভাবে বাঁক নিয়েছে, তা জানার জন্যই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই এগুলিও হয়ত কারোর কাছে স্মৃতিস্বরূপ, আবার কারোর কাছে ভারতের বা বাংলার শিল্প-ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ।

রাজ থেকে স্বরাজ প্রদর্শনীর ছবি – চার

এমনকি এই প্রদর্শনীতেই স্থান পেয়েছে বিয়ের পদ্য। একসময়ে রঙিন কাগজে মুদ্রিত নবদম্পতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শুভেচ্ছা বার্তা বিয়েবাড়িতে অতিথিদের বিতরণ করা হ’ত। সেখানে বিদেশী পরী, বাঙালি গৃহবধূ, শঙ্খ, প্রজাপতি বা মঙ্গলঘটের ছবি থাকত। সেই বার্তাগুলি ছড়ার আকারে লেখা থাকত। তাই তা বাংলার লোকসংস্কৃতির অংশবিশেষ। এভাবেও যে বাংলা সাহিত্যের ‘ছড়া’ পাওয়া যেতে পারে, তা চাক্ষুস করার সুযোগ করে দিয়েছে এই প্রদর্শনী। আবার তে-থাকি জামাই-ঠকানো গ্লাস কেমন ছিল আর কীভাবে নতুন জামাইয়ের কাছে রসে-ভরা মিষ্টান্ন লুকিয়ে রাখা হ’ত, সেকথাও জানতে বাকি থাকেনি কেউ। আর কেমন ছিল শিশুদের বিনোদন? এর জবাবও দিয়েছে কাঠের তৈরি সচল বায়োস্কোপ যন্ত্র। সুতরাং একদিন যা ছিল সচল, পরে তা-ই হয়েছে স্মৃতি। নানারকম স্মৃতির সম্ভারে ক্রমশঃ তা উঠেছে সঞ্চয়। আবার সেই স্মৃতিসঞ্চয় যখন সেকালের খ্যাতনামা বা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলেছে, তখনই তা বৃহত্তর পরিধিতে ইতিহাসে স্থান ক’রে নিয়েছে। ইতিহাসের যেমন কোনও বেড়া নেই, তেমনই কোনও ব্যবধানও নেই একের সঙ্গে অন্যের। লেখালেখি, আঁকাউঁকি, গল্প-রসিকতা কেউই কাউকে দূরে ঠেলে দেয়না। তাই রাজ থেকে স্বরাজের সময়কার লিপি দিয়েই সেজেছে কলকাতা কথকতা এবং শ্রী অরবিন্দ ভবন।

প্রদর্শনীর ফোল্ডার – সামনে ও পিছনের ছবি
প্রদর্শনীর ফোল্ডার – ভিতরের ছবি

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । কুণাল গুপ্ত

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ২ । ২২ জুন ২০২৫

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *