Jibansmriti Archive

সংস্কৃতে কাব্যধর্মী চারুরচনাকে বৈদিক যুগে বলা হ’ত ‘মন্ত্র’ ; পরে রামায়ণ থেকে তার নাম হয় ‘শ্লোক’। কী তবে পার্থক্য? বৈদিক ঋষিরা তাদের হৃদয়লালিত ভাবনাত্মক প্রকৃতিবন্দনা উদাত্ত,অনুদাত্ত ইত্যাদি স্বরে কণ্ঠধ্বনিমাধুর্যেই প্রকাশ করতেন। তা ছিল অতল মেধাসঞ্জাত সৃজনশীল অভিব্যক্তি কিন্তু রামায়ণের বালকাণ্ডেই দেখা যায় বাল্মীকি দৈবাৎ ক্রৌঞ্চদম্পতির সুখের নীড়ের ভেঙে যাওয়া দেখেই তাৎক্ষণিক আবৃত্তি করেন “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ/যত্ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্//”। এই সহজাত পদ্যরচনাই পরিচিত হল ‘শ্লোক’ ব’লে। আনন্দবর্ধন বললেন শোক থেকেই এর জন্ম বলে তার সংজ্ঞা হোক ‘শ্লোক’। শুধু তাই নয়; তিনি ‘ধ্বন্যালোক’-এ স্পষ্ট উল্লেখ করলেন যে বাল্মীকীয় রামায়ণের প্রধান রস করুণ।

বাল্মীকি প্রতিভা-য় বাল্মীকির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথের রামায়ণপাঠ কবে কখন সম্পূর্ণ হয়েছিল তা তথ্যপ্রমাণের সাপেক্ষে বলা যায়না। তবে তিনি যে সময় থেকে নাট্যরচনা করছেন, সে সময় তাঁর হাতে-খড়ি হয় রামায়ণ দিয়েই। একে তিনি তখন ‘বিলেত ফেরত’, উপরন্তু বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারী দেবীর পুরোদস্তুর নাটক-নভেল-চর্চা চলছে। তাই তিনিও বাদ থাকেননি। তবে সরাসরি রাম-সীতার আখ্যান নয়; তিনি বুঝেছিলেন ততদিনে রামলীলা যাত্রাপালা, পাঁচালি গান, রাবণের অট্টহাসি, রামের বিলাপ, হনুমানের লম্ফঝম্ফকে গ্রামবাংলা অধিকার করেছে; বরং বাল্মীকির কবিত্ব ও রামায়ণের করুণরসাত্মক অল্পখ্যাত একটি উপকাহিনি নিয়েই তিনি রচনা করলেন যথাক্রমে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১) ও ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২)। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এর গঠনমূলক নঞর্থক সমালোচনা লেখার সময়েই তিনি দাবি জানালেন যে  “হে বঙ্গমহাকবিগণ! লড়াই বর্ণনা তোমাদের ভালো আসিবে না…”। তাই তথাকথিত রাম-রাবণের লড়াইকে তিনি সচেতনভাবেই বাদ রাখলেন। একজন দুরাচারী আদিম বন্য প্রকৃতির মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া এক সামান্য ঘটনা-ই যে কীভাবে কাব্যকৃতির উৎস হতে পারে, তা তিনি বলতে চাইলেন তাঁর গীতিনাট্যে। প্রায় সমসাময়িক সময়েই তিনি ‘সঙ্গীত ও কবিতা’ নামের একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধও লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বললেন “সুরের উপরেই কথার ভাব নির্ভর করে।…সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্ম্মাণ করে”। তাই পূর্বোক্ত দুটি গীতিনাট্যেই পদ্যকথাকেই সুরছন্দে তুলে ধরলেন। তাঁর “গানের সূত্রে নাট্যের মালা” বাক্যটির এই গান ছিল দস্যুদলের কথ্য গান। সেই গানকে পেশাদারি চলনের গান বলা যায়না। তাঁর পূর্ববর্তী বাঙালি নাট্যকারেরা যে অপেরার আঙ্গিকে ‘নাট্যরাসক’ লিখেছিলেন এবং তা, মঞ্চসফলও হয়েছিল; তাকেই তিনি আরও সুশৃঙ্খলিত করলেন। তাই বিলাপধর্মী গান যেমন রাখলেন না, তেমনই গানকে ভাষা ও ভাবের সহোদর ক’রে তুললেন। বাল্মীকির দলীয় সংসর্গ বোঝাতেই তিনি দস্যুদলের রঙ্গরসের কার্যকলাপগুলিকে সেখানে রাখলেন কিন্তু একটানা নয়। চিরাচরিত গ্রাম্যরীতিকে উপেক্ষা ক’রেই তিনি পাশ্চাত্য গানের সুরে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। তাই শেষ দৃশ্যের সরস্বতীর আশীর্বাদ-কথনটি গানে নয়; কবিতার আকারে লেখা। এই ভাবনাটির নেপথ্যে কালিদাসের জনশ্রুতির অনুপ্রেরণা ছিল ব’লেই মনে হয়।

বাল্মীকি প্রতিভা-র আরও একটি দৃশ্যে বাল্মীকি-র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যদিও প্রথমটির তুলনায় তাঁর পরের গীতিনাট্যটিকে গানের দিক থেকে অনেকখানিই matured বলা যায়। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র গানগুলি সুরের কাঠমোয় বলে চলা কিছু কথা। এজন্যই ‘জীবনস্মৃতি’তে তিনি তাকে বললেন “সুরে নাটিকা”। রামায়ণ সম্পর্কে তাঁর ধারণা অনেকখানিই ব্যক্ত হয়েছে ‘সাহিত্য’-এর নানা প্রবন্ধে । যেমন আষাঢ়, ১৩০৮ বঙ্গাব্দে (১৯০১) ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘কবিজীবনী’তেই তিনি বললেন “বাল্মীকি সম্বন্ধে যে গল্প প্রচলিত আছে তাহাকে ইতিহাস বলিয়া কেহই গণ্য করিবেন না। …কোন্‌ আঘাতে বাল্মীকির হৃদয় ভেদ করিয়া কাব্য-উৎস উচ্ছ্বসিত হইয়াছিল? করুণার আঘাতে। রামায়ণ করুণার অশ্রুনির্ঝর। ক্রৌঞ্চবিরহীর শোকার্ত ক্রন্দন রামায়ণকথার মর্মস্থলে ধ্বনিত হইতেছে।” এ যেন তিনিই তাঁর রচনা সম্পর্কে পাঠককে কৈফিয়ত দিচ্ছেন। এখান থেকেই বোঝা যায় তিনি রামকথায় নয়; রামায়ণেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেকারণেই ওই বছরেই লেখা ‘ঔপনিষদ ব্রহ্ম’ প্রবন্ধেও তিনি “বাল্মীকির কাব্যরস” শব্দবন্ধের ব্যবহার করেছেন। ভক্তি বা গ্রাম্যরসকে সরিয়ে বা নিজ কবিত্বচ্ছটায় রামায়ণকে তিনি দুর্বল বা একপেশে করে দিতে চাননি। তবে একাজের নেপথ্যে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণাকেও অস্বীকার করা যায়না। ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যে সরস্বতীর সরস বন্দনা আছে ঠিকই; তবে ক্রৌঞ্চবধ বা কোনপ্রকার দুঃখের আবহেই যে গান  রচনা করা যায়, তা তিনি দেখিয়েছিলেন। তবে বাল্মীকি প্রতিভার প্রথম সংস্করণে কোনও বনদেবীর অংশ ছিলনা। সংস্কৃতে মহাকবি কালিদাসের কাব্যে এই চরিত্রেরা রয়েছে। তারা যেমন শকুন্তলাকে প্রকৃতির অলংকারে সাজিয়ে তোলে, আবার তেমনই কখনও রাজা দশরথের শিকারের বেশভূষা দেখে বিস্মিত হয়। এই ভাবনা থেকেই ‘কালমৃগয়া’য় ওই অংশটিকে জুড়ে দেওয়া। ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্যের নবম সর্গের ঘটনার সঙ্গে ‘কালমৃগয়া’য় গঠনগত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এমনকি সেই সর্গের নামও ছিল ‘মগৃয়াবর্ণন’। তাই ওখান থেকেই ‘মৃগয়া’টুকু রয়ে গেল। সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহ বা ‘ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’-এর ভাবনা দূর স্বপ্নেও আসেনি। তবুও তিনি তপোবন ও অন্ধ ঋষির আশ্রমের কথা দিয়ে আবহকে সাজিয়ে তুললেন। এর জন্য কালিদাসের সেই অভিজাত সাহিত্যসম্পদের স্থান-কাল-পাত্রের কথা ভুললে চলবে না। তবে দয়ঃখ বা শোক-ই যে চরম লক্ষ্য নয়; তার জন্য তিনি উপনিষদকেও যথাস্থানে ব্যবহার করলেন একটি কৌশলে। ‘কালমৃগয়া’র তৃতীয় দৃশ্যে অন্ধ ঋষির কণ্ঠে শ্রুত হয়েছে ছান্দোগ্য উপনিষদের সেই মন্ত্র যা বলে পুত্রশোকের ব্যথাকে অতিক্রম করেন মহোত্তম সাধক। তাই একথাই বলা যায় যে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ তাঁর exploratory assignment হলেও ‘কালমৃগয়া’য় মিশেছিল তাঁর সারস্বত শিক্ষা ও সংস্কারের দ্রবীভূত রস। তাই বাল্মীকি-কালিদাস-রবীন্দ্রনাথের এই পরম্পরা নিয়েই ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তের কথা সময়োপযোগী – “বাল্মীকির বীজ তাই ফুটিয়া ওঠে কালিদাসের নূতন ফুলে, আবার কালিদাসের প্রতিভা ও সাধনা বীজরূপে ঝরিয়া পড়িয়া নূতন নূতন ফুল ফুটাইয়াছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টিতে”।

ক্রমশঃ

প্রথম পর্বের লিংক : https://jibansmritiarchive.com/sanskrit-sahitya-o-rabindranatyadhara-samipeshu-das/

দ্বিতীয় পর্বের লিংক : https://jibansmritiarchive.com/sanskrit-sahitya-o-rabindranatyadhara/

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *