Jibansmriti Archive

তৃতীয় কিস্তি :

শিল্পীর বাংলা স্বাক্ষর

শুনেছি যে, বাবা পড়তে চেয়েছিলেন কলাভবনে। উড়িষ্যার রাভেনশ কলেজিয়েট ইশকুলে পড়বার সময় থেকেই এটাই স্বপ্ন ছিল যে, বন্ধুনী মৈত্রী সেনাপতি আর তিনি একসঙ্গে চলে যাবেন কলাভবনে পড়তে। বাদ সাধল ব্রিটিশ সরকারের অধীনে, আমার ঠাকুরদা প্রফুল্ল কুমার মুখোপাধ্যায়ের পুলিশের চাকরি। তিরিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গতিবিধি মোটেই সুবিধের ঠেকতো না সাহেবদের কাছে। ফলে মৈত্রী কলাভবনে গেলেও, বাবাকে ভর্তি হতে হল, কলকাতার সরকারী আর্ট কলেজে। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত শুভানুধ্যায়ীদের প্রভাবে, ঠাকুরদা অনুরোধ করলেন, পেইন্টিং নিয়ে না পড়ে, কমার্শিয়াল আর্ট বিভাগে পড়াশোনা করতে। স্বাধীন-সত্তায় ছবি আঁকার  ইচ্ছেটা মনের মধ্যে যাপন করেই, দ্রুত শিখে নিতে লাগলেন কমার্শিয়াল আর্টের যাবতীয় কারিকুরি। মাস্টারমশাই সতীশ সিংহ এবং অধ্যক্ষ বসন্ত গাঙ্গুলি বিশেষভাবে চিহ্নিত করলেন তাঁকে। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়, শান্তিনিকেতনে দিনকয়েক কাটিয়ে , ‘রবি ঠাকুরকে’ সামনে থেকে দেখে আঁকবার জন্য, কলেজ থেকে যে গুটিকয় ছাত্রদের বেছে নেওয়া হল, সেই দলে বাবাও ছিলেন। এই বিরল যোগাযোগের গল্প এবং তাঁর আঁকা রবীন্দ্রনাথের সেই প্রতিকৃতির একটি প্রিন্ট আমি হাতে পেলাম এই কয়েক বছর আগে, প্রয়াত পরিমল রায়ের সৌজন্যে। সেই ছবিগুলি খুঁজে পেয়ে তা দিয়ে শ্রী রায়, অমূল্য এক প্রদর্শনীর সঙ্গে, একটি  ক্যালেণ্ডারও প্রকাশ করেন। কলেজে শেষ পরীক্ষা দেবার আগেই কোনও এক সিনেমার স্টুডিওতে কাজ করার জন্য ‘বোম্বে’ থেকে যখন ডাক এল , কিছুটা যেন মুক্তি পেতেই বাবা চলে গেলেন সেখানে। ডিগ্রী নেওয়া হল না; অন্যদিকে মানিয়েও নিতে পারলেন না ফিল্মের-জগতে। ঠাকুরদার অনুমতিতেই  ফিরে এলেন খড়দায়। সেখানেই তখন বানানো হয়েছে,  বড় এক স্টুডিও ঘর। নানা ওঠাপড়ায় জীবন কাটতে লাগল। তাঁর চাকরি থেকে অবসর নিয়েই মারা গেলেন ঠাকুরদা। বাবা আর ঠাকুমার সংসারে আয় বলতে তখন বাড়ি-ভাড়া আর জমানো কিছু টাকা। মায়ের সঙ্গে পরিচয় এবং বিয়েও এই সময়। দুজনের জীবনেই জোয়ার এল ভালোবাসা আর বিশ্বাসের। মা এসে সেই-যে হাল ধরলেন সংসার এবং স্বামীর চিত্রী-জীবনের, সেখান থেকে আর একচুল সরেননি তিনি।

চিত্রকর অশোক মুখোপাধ্যায়

সতীশ সিংহ ডেকে চাকরি দিয়েছেন, ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ছাত্র পড়াবার; পোর্ট্রেট আঁকার দক্ষতা  দেখে বসন্ত গাঙ্গুলিও চেয়েছেন, পেশাদারি ভাবে অর্ডারি পোর্ট্রেট আঁকার জগতে বাবাকে টেনে রাখতে; প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত বিনয় দত্ত চেয়েছেন, ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করুন বাবা; কিন্তু সব জায়গাতেই সামান্য এগিয়েই ইতি টেনেছেন তিনি। বলতেন, ‘অন্য কাজ করার সময় কোথায়! ছবি আঁকা মানে, স্টুডিওতেই মেলা কাজ’।

ঠিকই তো! নতুন তুলি এলেই জলে ডুবিয়ে-ডুবিয়ে কাগজে জলের আঁক কেটে সেগুলির ছুঁচলো মুখ কতটা মসৃণ সেটা পরীক্ষা করা;  পছন্দের নানা পাত্রে ভাগে-ভাগে সাজিয়ে রাখা জল-রং ও তেল রঙের তুলি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছুতোরের সঙ্গে বসে, ছবির ফ্রেম বানানো। বালতি বালতি জলে রং ধুতে-ধুতে ‘ওয়াশের’ ঠিক রঙটি আনা। মনোমতো না হওয়ায় সারারাত ধরে ইজেলের  সামনে অস্থির পায়চারি; সিগারেট প্যাকেটের ভেতরের কাগজটিতে এঁকে রাখা গোছা গোছা পেজ মার্ক। ফলে তাঁর মৃত্যুতে, আঁকা ছবিগুলো অচিরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দিনরাত জুড়ে মেতে থাকা এইসব ‘মেলা’ কাজের তালিকা থেকে। হয়ে গেল বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী বা আসবাব। তবে বাবার আঁকা ছবিগুলি, বিক্রি না হয়েও সেগুলি যে বাতিল হয়ে গেল না, তার একমাত্র কারণ আমার মায়ের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু আশি সালের পর থেকে প্রায় হারিয়েই গেলেন চিত্রকর অশোক মুখোপাধ্যায়।

The Face of a woman – oil on Canvas 1963

আবার যে নাড়াচাড়া পড়ল, প্রায় চল্লিশ বছর পার করে, সেও এক আশ্চর্যই বটে। পাবলিক  রিলেশনে থাকা অন্য এক অশোক কুমার মুখোপাধ্যায় এবং গোপীনাথ ঘোষের যৌথ উদ্যোগে উত্তর কলকাতার ‘সুতানুটী পরিষদ’ থেকে প্রকাশ পেল, ছ’টি ছবির প্রিন্ট নিয়ে একটি ফোল্ডার;  আনুষ্ঠানিকভাবে যেটির প্রকাশ হল , ১৯৯৭— তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় জ্যোতি বসুর ‘চেম্বারে’। মায়ের বিশেষ অনুরোধে  শিল্পী-পরিচিতি লিখলেন চিত্র সমালোচক সন্দীপ সরকার এবং উপস্থিত থাকলেন চিত্রী বিকাশ ভট্টাচার্যও। এর পরে-পরেই আমার আনাড়ি উদ্যোগে সাড়া দিয়ে যেমন এগিয়ে এলেন, চিত্র সমালোচক মৃণাল ঘোষ এবং সেন্টার আর্ট গ্যালারির দায়িত্বে থাকা কল্যাণ সেন, তেমনই এগিয়ে এলেন আমার মা। তাঁর জীবদ্দশায় পঞ্চাশটি ছবি নিয়ে সেই শেষ প্রদর্শনী ১৯৯৯ , যেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন চিরাচরিত সপ্রতিভ উজ্জ্বলতায়। মায়ের অনুমতিতেই সেই প্রদর্শনীটি নিয়ে যাওয়া হল, কলাভবনের ‘নন্দন’ আর্ট গ্যালারিতে, ২০০০  সালে। মৃণাল ঘোষের সঙ্গে এবারে সাহায্য করলেন, জনক ঝঙ্কার নারজারি , সোমনাথ হোর , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সৌম্য  চক্রবর্তী । আবার আলোচনা হল প্রায় সমস্ত কাগজে; দেখানো হল, দূরদর্শনেও। তাঁর ছবি সংগৃহীত হল, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল— এই সব চিত্রশালায়। নতুন করে চিনলাম, চিত্রী বিষ্ণু বসু, পার্থপ্রতিম দেব, সোহিনী ধর, সনাতন দিন্দা, অতীন বসাক এবং কৃষ্ণেন্দু চাকীকে। কিন্তু ইতিমধ্যে মায়ের এক দুরারোগ্য অসুস্থতা এবং আমার চাকরির চাপে আবার সব থিতিয়ে গেল। তবে নতুন করে এবার বুঝলাম যে, ছবির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সাড়ম্বরে তৎপর হয়েছেন গ্যালারি মালিকরাই। চিত্রী এবং তাঁর ছবি– এ দুটিই হয়ে উঠছে ক্রয় এবং বিক্রয়জাত সামগ্রী। শিল্পের মান আসলে শিল্পীর আঁকা ছবির বাজার এবং ব্যবসায়ী  নিলামও। গয়না, বাড়ি, জমির মতোই ‘Investment with Return’ ;  আর দেশীয় বা আন্তর্জাতিক এই শিল্প-বাজারে,  শিল্পীরা যে পা-রাখতে পারছেন, তা কিন্তু সর্বতোভাবেই এই গ্যালারিগুলিরই আনুকূল্যে ; ফলে প্রাইভেট গ্যালারি কালচারটাও সেই বড় মাপের ব্যবসা, যার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বাজার।

ক্রমশঃ

Red wrapper -Water Colour

প্রথম কিস্তির লিংক : https://jibansmritiarchive.com/chitrakar-baba-mandar-mukhopadhyay/

দ্বিতীয় কিস্তির লিংক : https://jibansmritiarchive.com/chitrakar-baba-mandar-mukhopadhyay-2/

ছবি সংগ্রহ : মন্দার মুখোপাধ্যায়

ছবির নামকরণগুলি লেখকের ইচ্ছে অনুযায়ী বাংলা ও ইংরেজিতে করা হয়েছে।

জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ব্লগ

যুগ্ম সম্পাদক অরিন্দম সাহা সরদার অবেক্ষক এবং সভাপতি, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ । 

বিয়াস ঘোষ সম্পাদক, জীবনস্মৃতি আর্কাইভ ।

প্রধান সহযোগী সম্পাদক : মৌমিতা পাল

সহযোগী সম্পাদক মণ্ডলী : প্রমিতি রায় । অঙ্কুশ দাস । সুজাতা সাহা

প্রথম বর্ষ । প্রকাশ – ৩ । ৭ জুলাই ২০২৫

One Response

  1. খুবই ভালো লাগলো।এমন কত অজানা শিল্পীর কথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। ওনার কাজ ও জীবনের ছবি, এই লেখাটির মাধ্যমে জানতে পেরে ঋদ্ধ হোলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *